গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোও কাজে গতি পায় না। নির্ধারিত মেয়াদ ও খরচে শেষ হয় না। এমনকি বিদেশী ঋণের প্রকল্পগুলোরও একই দশা। খাদ্যনিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য দেশে আটটি আধুনিক খাদ্যগুদাম বা স্টিল সাইলো নির্মাণ কার্যক্রম এখন এক যুগে দাঁড়াচ্ছে। যেখানে সাড়ে ছয় বছরে শেষ করার কথা। আর এই কাজে সময় ও ব্যয় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পের খরচ এখন দ্বিগুণের বেশি হয়ে ৪ হাজার ৪৫ কোটি টাকায় উন্নীত। আর আটটি সাইলো বানাতে তিন ধরনের পরামর্শকেই যাচ্ছে পৌনে ৩০০ কোটি টাকা। প্রতিটির পেছনে পরামর্শক খরচ সোয়া ৩৪ কোটি টাকা। এ দিকে ঢাকার স্থলে নওগাঁয় প্রকল্প স্থান পরিবর্তনে বিশ্বব্যাংক অনাপত্তি প্রদান করলেও অতিরিক্ত অর্থায়নে অসম্মতি জানিয়েছে বলে পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে। প্রকল্প পরিচালক ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো: রেজাউল করিম শেখ জানান, অতিরিক্ত অর্থায়ন, টেন্ডার ও করোনার কারণে প্রকল্পের প্রায় পাঁচটি বছরে কোনো কাজ করা সম্ভব হয়নি। ফলে স্বাভাবিকভাবে প্রকল্পের কাজে সময়টা কমই।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প প্রস্তাবনা থেকে জানা গেছে, ভৌগোলিক অবস্থান ও জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি হওয়ায় এ দেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগকালে অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণ। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ ঝুঁকির মাত্রা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৩ কোটি ৩০ লাখ টন চাল উৎপাদন হয়। কিন্তু মাঝে মাঝে প্রাকৃতিক বা দুর্যোগ জনিত কারণে এবং ফসল তোলা থেকে সংরক্ষণ পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে প্রায় ১২ লাখ টন চাল মজুদ ঘাটতি সৃষ্টি হয়। আমদানির মাধ্যমে এ ঘাটতি পূরণ করতে হয়। দুর্যোগকালে বিশ্ববাজার থেকে চাল আমদানি কঠিন হয়ে পড়ে। এ কারণে খাদ্য মজুদ বৃদ্ধি করেই দুর্যোগকালে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হয়। ২০০৭ সালে সাইক্লোন, সিডর পরবর্তী সময়ে বিশ্ববাজারে খাদ্যমূল্য বিশেষ করে চাল ও গমের মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়। কোনো কোনো দেশ খাদ্য রফতানি বন্ধ করে দেয়। ফলে খাদ্য সরবরাহ বিঘ্নিত হয় এবং খাদ্যনিরাপত্তা ঝুঁকি দেখা দেয়। এসব কারণে বাংলাদেশ সরকারের খাদ্যনিরাপত্তা বৃদ্ধি, বাজার স্থিতিশীল রাখা এবং দুর্যোগকালীন প্রয়োজন মেটানোর জন্য সরকারি খাদ্যমজুদ সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। প্রকল্প এলাকা পরিবর্তন, মেয়াদ বৃদ্ধি ও ব্যয় বৃদ্ধিসহ প্রকল্পের অবশিষ্ট কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের নিমিত্তে প্রকল্পের তৃতীয় সংশোধনী প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রেক্ষাপটের তথ্য বলছে, ২০১৪ সালে প্রকল্পটি এক হাজার ৯১৯ কোটি ৯৭ লাখ টাকা ব্যয়ে আটটি আধুনিক খাদ্যগুদাম বা সংরক্ষণাগার নির্মাণের প্রস্তাব অনুমোদন দেয়া হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নে বৈদেশিক ঋণ ছিল এক হাজার ৮৭৬ কোটি ৬২ লাখ টাকা। ২০২০ সালের জুনে সাড়ে ছয় বছরে প্রকল্পটি সমাপ্ত করার কথা ছিল। কিন্তু দুই দফায় সময় ও খরচ বাড়িয়েও প্রকল্পের কাজ শেষ করতে পারেনি খাদ্য অধিদফতর। প্রথম ধাপে সময় তিন বছর তিন মাস বাড়ানো হয়। খরচ প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে তিন হাজার ৫৬৮ কোটি ৯৪ লাখ টাকা করা হয়। মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত নেয়া হয়। তাতেও প্রত্যাশিত অগ্রগতি হয়নি। এখন খরচ আরো ৪৭৫ কোটি ৯১ লাখ টাকা এবং সর্বমোট ২ হাজার ১২৫ কোটি টাকা বৃদ্ধির ফলে প্রকল্পের বাস্তবায়ন খরচ চার হাজার ৪৪ কোটি ৮৫ লাখ টাকায় উন্নীত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। আর মেয়াদ আরো দুই বছর দুই মাস বাড়ানো হচ্ছে। ফলে মোট বাস্তবায়নকাল ১২ বছরে উন্নীত হলো। প্রকল্পের প্রধান প্রধান কার্যক্রমে দেশের আটটি ভৌগোলিক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সরকারি পর্যায়ে ৫ লাখ সাড়ে ৩৫ মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন আনুষঙ্গিক সুবিধাদিসহ আটটি (চাল ছয়টি ও গম দুইটি) আধুনিক স্টিল সাইলো নির্মাণ। উপকূলীয় ও দুর্যোগপূর্ণ এলাকার ১৯টি জেলার ৬৩টি উপজেলায় ২৮ হাজার লাখ মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার পাঁচটি হাউজহোল্ড সাইলো নির্মাণ। ফুড পলিসি গবেষণা ও অনলাইন ফুড স্টক ও মার্কেট মনিটরিং সিস্টেম স্থাপন।
অগ্রগতি পর্যালোচনার তথ্য থেকে জানা গেছে, দুই দফায় সময় বাড়িয়েও প্রকল্পের মাধ্যমে সাইলো নির্মাণকাজ ২০২২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত পৌনে ৯ বছরে বর্ধিত মেয়াদে হয়েছে মাত্র ৬২ শতাংশ। বছরে গড়ে প্রায় সাত শতাংশ। অর্থব্যয় হয়েছে এই অগ্রগতির পেছনে মাত্র ৪২.৫৯ শতাংশ। এখন এই প্রকল্পের কাজ শেষ করার জন্য খাদ্যমন্ত্রণালয় আরো দুই বছর দুই মাস সময় বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে পরিকল্পনা কমিশনের মাধ্যমে একনেকের কাছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য থেকে জানা গেছে, প্রকল্পের আওতায় সাতটি স্টিল সাইলো নির্মাণকাজ চলমান। ওই সাইলোর মধ্যে চারটি সাইলোর (বরিশাল, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও খুলনা) নির্মাণব্যয় অনুমোদিত দ্বিতীয় সংশোধিত ডিপিপিতে এক হাজার ৪৪৪ কোটি ১১ লাখ টাকা নির্ধারিত ছিল। প্রতিটির জন্য ব্যয় ৩৬১ কোটি ৩ লাখ টাকা। তৃতীয় সংশোধন প্রস্তাবে চারটি সাইলোর জন্য ১০০ কোটি ৪৬ টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে খাদ্যমন্ত্রণালয়। ফলে খরচ প্রতিটির জন্য বেড়ে হবে ৩৮৬ কোটি ১৭ লাখ টাকা। আবার ডলারের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় তিনটি সাইলোর জন্য ১২৬ কোটি টাকা অতিরিক্ত প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবিত তৃতীয় সংশোধিত ডিপিপিতে কোনো বৈদেশিক মুদ্রা পরিলক্ষিত হচ্ছে না বলে পরিকল্পনা কমিশন বলছে।
প্রকল্পের আওতায় বর্তমানে চলমান সাতটি সাইলো নির্মাণকাজসহ অন্যান্য কিছু অঙ্গে প্রস্তাবিত অতিরিক্ত ৩১৮ কোটি টাকা জিওবি খাত থেকে সংস্থান করা যায়। তবে নওগাঁ সাইলোর জন্য প্রস্তাবিত ৩১৩ কোটি টাকা বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে জিওবি থেকে সংস্থান না করে নওগাঁ সাইলো নির্মাণের জন্য আরেকটি নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা সমীচীন হবে বলে পরিকল্পনা কমিশন থেকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ঢাকার সাইলো নির্মাণের জন্য পিডব্লিউডির রেট শিডিউল ২০১৪ অনুসরণ করে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছিল ১৫৬ কোটি টাকা। বর্তমানে ঢাকার পরিবর্তে প্রস্তাবিত নওগাঁয় সাইলো নির্মাণের জন্য একই রেট শিডিউল ২০২২ অনুযায়ী নতুন করে ডিজাইন-ড্রইং প্রণয়ন করায় ব্যয় প্রাক্কলন ৩১৩ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা ঢাকার ব্যয় থেকে ১৫৭ কোটি টাকা বেশি।
প্রসঙ্গত, নওগাঁয় প্রকল্প স্থান পরিবর্তনের বিষয়ে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক অনাপত্তি প্রদান করা হলেও অতিরিক্ত অর্থায়নের ক্ষেত্রে অসম্মতি জানিয়েছে। অর্থাৎ নওগাঁ সাইলোর জন্য প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত ১৫৭ কোটি টাকা জিওবি থেকে প্রদান করতে হবে। তৃতীয় সংশোধনীতে অতিরিক্ত দুই বছর দুই মাস মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে তার মূল কারণ নওগাঁয় সাইলো নির্মাণের জন্য দরপত্র আহ্বানসহ পূর্তকাজ সম্পাদন।
খাদ্যমন্ত্রণালয় বলছে, প্রকল্পের আওতায় আটটি জেলায় আটটি স্টিল সাইলো নির্মাণের জন্য নির্ধারিত আছে, যার মধ্যে একটি ঢাকায় খাদ্য মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব জমিতে নির্মাণের জন্য নির্ধারিত ছিল। সম্প্রতি সরকার ঢাকা মহানগরীর চার পাশে সার্কুলার রোড এবং এলিভেটেড রেল রোড নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়ায় ঢাকায় নির্মিতব্য স্টিল সাইলোটির জন্য প্রয়োজনীয় জেটি নির্মাণ করা সম্ভব হবে না। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়ন সংক্রান্ত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে খাদ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক ঢাকার পরিবর্তে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে কোনো স্টিল সাইলো না থাকায় নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলায় সাইলোটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগ বলছে, তৃতীয় সংশোধনে জিওবি ব্যয় অনুমোদিত দ্বিতীয় সংশোধিত ব্যয় থেকে ৭১৪.৮৩ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে জিওবি খাতে এ ব্যয় বৃদ্ধির যৌক্তিকতা প্রতীয়মান হয় না। বর্ধিত ব্যয়ের জন্য প্রকল্প ঋণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে খাদ্য মন্ত্রণালয় ও ইআরডি উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। আর নওগাঁয় সাইলো বর্তমান প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ না করা হলে অতিরিক্ত প্রকল্প মেয়াদ বৃদ্ধি এবং পরামর্শক ব্যয়সহ রাজস্ব খাতেও ব্যয় সাশ্রয় হবে। প্রকল্প পরিচালক ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো: রেজাউল করিম শেখের সাথে গতকাল প্রকল্পের ব্যাপারে মুঠোফোনে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ২০১১-১২ সালে প্রাথমিকভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই হয় এই প্রকল্পের জন্য। প্রকল্পটি করা হয় ২০১৪ সালে। আর প্রথম টেন্ডার করা হয় ২০১৭ সালে। তখন দেখা যায় এই টাকায় সাইলো করা সম্ভব নয়। পরে আমরা অতিরিক্ত অর্থায়নের জন্য বিশ্বব্যাংকের সাথে কথা বলি। তখন তাদের সাথে চুক্তি করে টেন্ডারে যেতে তিন বছর চলে যায়। তারপর যখন কাজ শুরু করব তখন দেড় বছর কোভিডেই নষ্ট হয়। তিনি বলেন, ফলে অতিরিক্ত অর্থায়নের আলোচনা, টেন্ডার ও কোভিডের কারণেই চার-পাঁচ বছর চলে যায়। এখন বর্ধিত সময় পেলে কাজ শেষ হবে। তিনি বলেন, নতুন করে পরামর্শকের কোনো প্রস্তাব দেইনি।
নওগাঁ সাইলোতে বাড়তি খরচে বিশ্বব্যাংক রাজি না হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, রাজি হয়নি তা নয়, তারা তাদের অবশিষ্ট যে অর্থ সেটা দেবে। বাকিটা সরকারকে দিতে হবে। অর্থাৎ ৩০ শতাংশ বিশ^ব্যাংকের টাকা ব্যবহার করতে পারব। বাকি ৭০ শতাংশ সরকারি অর্থায়ন করতে হবে। তবে সেটা যদি সরকার রাজি হয় তাহলে হবে।
সোর্স : নয়া দিগন্ত