রাষ্ট্র পরিচালনায় সঠিক পরিসংখ্যানের কোনো বিকল্প নেই। বিভিন্ন বিষয়ের পরিসংখ্যান তৈরির জন্য জরিপ করে অথবা রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে গিয়ে যেসব তথ্য সরকারি দলিলে লিপিবদ্ধ হয় সেগুলো পরিসংখ্যানের মৌলিক তথ্য। একটি দেশ যতই বাজারমুখী হয়, ততই নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যানভিত্তিক তথ্য প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়ায়। সামন্তযুগে রাজতন্ত্রের মধ্যেও সাম্রাজ্যের প্রয়োজনে তথ্য সংগ্রহ করা হতো। ভারতবর্ষে মৌর্য সম্রাটরা রাজ্যের বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতেন। মৌর্য আমলে রাজার পরামর্শদাতা হিসাবে কৌটিল্যের ভূমিকা সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যায়। কৌটিল্যের লেখা অর্থশাস্ত্র গ্রন্থটি বলে দেয় সে যুগেও পরিসংখ্যানের কত গুরুত্ব ছিল। তখনকার দিনে রাজা বা সম্রাটের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হতো রাজস্বসংক্রান্ত তথ্য। মৌর্য রাজাদের আমলে বড় আকারে ব্যবসা-বাণিজ্য চলত। ব্যবসায়ীরা বাণিজ্য কাফেলায় অংশগ্রহণ করে নিজ নিজ পণ্যসামগ্রী রাজ্যের এক অংশ থেকে অন্য অংশে নিয়ে যেত। কাফেলার মাধ্যমে বাণিজ্য পরিচালনার অন্যতম সুবিধা ছিল নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। মৌর্য রাজারা ব্যবসায়ীদের নানা কারণে বিশ্বাস করত না। কারণ বাণিজ্য কাফেলায় অংশগ্রহণকারীরা রাজ্যের এক অংশ থেকে অন্য অংশে অসন্তোষের বীজ ছড়িয়ে দিতে পারে, এমনটি ভাবা হতো। বাণিজ্য কাফেলার ওপর রাজার গুপ্তচররা নজরদারি করত। কোথায় কী পরিমাণ পণ্য বিক্রি হচ্ছে, তার ওপরও নজর রাখা হতো। দেখা যাচ্ছে, ব্যবসায়ী শ্রেণি সামন্ত শ্রেণির অবিশ্বাসের উৎস হলেও তারা ব্যবসা-বাণিজ্যকে বাধা দিত না। অর্থাৎ রাজা বা সম্রাটের চোখে তখনকার দিনে ব্যবসায়ী বা বণিক শ্রেণি ছিল এক ধরনের Necessary Evil. বাণিজ্য অর্থনীতি এবং সামন্তবাদী অর্থনীতির মধ্যে এক ধরনের আঙ্গিক সম্পর্ক ছিল, যা বজায় রেখে সামন্ত অর্থনীতির সমৃদ্ধি অর্জিত হতো। এ কারণেই ব্যবসায়ী বা বণিকদের সম্পর্কে Necessary Evil-এর তকমাটি ছিল বাস্তবসম্মত।
Advertisement
মোগল আমলেও রাজ্যের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা হতো। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শিরিন মুসভি মোগল অর্থনীতির ওপর নিবিড় গবেষণার মাধ্যমে এ বিষয়ে একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। এ গ্রন্থ থেকেও আমরা বুঝতে পারি মোগলরা নিছক খেয়ালখুশির বশে রাজ্য পরিচালনা করতেন না। তাদের সিদ্ধান্ত অনেকাংশে রাজ্যের অর্থ ভান্ডারের ওপর নির্ভর করত। ফ্রান্সের সামন্ত রাজারাও অর্থনৈতিক হিসাব-নিকাশের ব্যাপারে বেশ আগ্রহ দেখাতেন। ফরাসি সামন্তবাদ তার অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত রাখতে জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি, বিশেষ করে অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ শুনতেন। ফ্রান্সের তৎকালীন অর্থনীতিবিদ কিনে (Quesnay) এবং মিরাবোঁ লুই রাজাদের অর্থনীতি বিষয়ে নানাবিধ পরামর্শ দিতেন। কিনে, যার পুরো নাম ফ্রাঁসোয়া কিনে, পেতিত এগ্রিকালচার এবং গ্র্যান্ডি এগ্রিকালচার সম্পর্কে চমৎকার তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করেছেন যা আজও প্রাসঙ্গিক। পেতিত এগ্রিকালচার হলো খুদে চাষিদের কৃষি এবং গ্র্যান্ডি এগ্রিকালচার হলো বৃহৎ জোতের কৃষি। কিনে এ দুই ধরনের কৃষি সম্পর্কে তার মূল্যবান পরামর্শ রেখে গেছেন। তার সবচেয়ে বড় অবদান হলো tableau economique. এটি আধুনিক অর্থনীতিতে ইনপুট-আউটপুট তত্ত্বের আকার ধারণ করেছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, কী সামন্তবাদী অর্থনীতি, কী পুঁজিবাদী অর্থনীতি-সব ক্ষেত্রে সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য সঠিক পরিসংখ্যান প্রয়োজন হয়। পরিসংখ্যান নিছক সংখ্যার যোগ-বিয়োগ, গুণ-ভাগ নয়। পরিসংখ্যান শাস্ত্র সংখ্যার কাঁচামাল ব্যবহার করে যে কোনো ব্যবস্থার মূল কথাটি বের করে নিয়ে আসে।
সংবাদপত্রে দেখলাম, বাংলাদেশের রপ্তানি আয় নিয়ে তথ্যবিভ্রাট বিদ্যমান। সরকারের একাধিক সংস্থা রপ্তানি আয়ের যে পরিমাণ দেখিয়েছে, তাতে দেখা যায়-এক সংস্থার হিসাবের সঙ্গে অন্য সংস্থার হিসাবের কোনো মিল নেই। ২০২১-২২ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানির পরিসংখ্যান একেক সংস্থায় একেক রকম। অ্যাসাইকুডার হিসাব অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি আয় হয়েছে ৪,০৮০ কোটি ডলার। চট্টগ্রাম ও বেনাপোল বন্দর এবং ঢাকা বিমানবন্দর দিয়ে যেসব পণ্য বিদেশে রপ্তানি হয়েছে, এটা তারই হিসাব। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে আয় হয়েছে ৫,২০৮ কোটি ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের (বিওপি) হিসাব অনুযায়ী, এ সময় রপ্তানি হয়েছে ৪,৯২৪ কোটি ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংক (রিসিপ্ট) হিসাব অনুযায়ী, রপ্তানি আয় ছিল ৪,৩০৬ কোটি ডলার। রপ্তানি বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ খাত। রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যমে লেনদেনে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা হয়। একটি স্বাধীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বৈদেশিক মুদ্রার নানাবিধ উপযোগ থাকে। এ কারণে রপ্তানির মাধ্যমে যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়, সে সম্পর্কে সঠিক পরিসংখ্যান না পাওয়া গেলে নীতিনির্ধারণের অনুশীলনও কঠিন হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশ ব্যাংক, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সর্বশেষ অর্থবছরের রপ্তানি পরিসংখ্যানে কোনো মিল পাওয়া যাচ্ছে না। এ বিষয়ের ওপর দৈনিক বণিক বার্তার প্রতিবেদক বদরুল আলম একটি সুনির্দিষ্ট প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। ইপিবি জানিয়েছে, এ সময় বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয়েছে ৫২ বিলিয়ন ডলারের। এনবিআরের নিজস্ব প্রতিবেদনে মোট রপ্তানির অর্থমূল্য দেখানো হয়েছে ৪০ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে বলা হয়েছে, গত অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে ৪৯ বিলিয়ন ডলারের। এগুলোর মধ্যে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যটিকেই উপস্থাপন করা হয় রপ্তানিসংক্রান্ত জাতীয় পরিসংখ্যান হিসাবে। রপ্তানির অর্থমূল্য ৫০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করায় সংশ্লিষ্ট মহলগুলো উচ্ছ্বাস প্রদর্শন করেছে। কিন্তু অন্য দুই সংস্থার তথ্যে রপ্তানির পরিমাণ দেখানো হয়েছে ৫০ বিলিয়ন ডলারের নিচে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো তার পরিসংখ্যানের ভিত্তি হিসাবে এনবিআরের তথ্য ব্যবহার করে। কিন্তু এনবিআরের হিসাব রক্ষণাবেক্ষণের স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা অ্যাসাইকুডার তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর, বেনাপোল স্থলবন্দর ও ঢাকা বিমানবন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া মোট পণ্যের অর্থমূল্য ছিল ৪০ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। এখানে মোংলা বন্দর থেকে রপ্তানির হিসাব ধরা হয়নি। মোংলা বন্দর দিয়ে খুব সামান্যই রপ্তানি হয়। অ্যাসাইকুডার হিসাব অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ৩ হাজার ৭৬০ কোটি বা ৩৭ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি পরিমাণ পণ্য রপ্তানি হয়েছে। বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে রপ্তানি হয়েছে ৭৯ কোটি ৭৮ লাখ ডলারের পণ্য। এ ছাড়া ঢাকা বিমানবন্দর দিয়ে ২৪০ কোটি ৩০ লাখ বা ২.৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে।
সরকারি সংস্থা প্রদত্ত রপ্তানির হিসাবে এমন তারতম্য কেন হচ্ছে, তা গভীরভাবে অনুসন্ধান করে দেখা উচিত। এটি দেশের জন্য যেমন প্রয়োজন, তেমনি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের প্রতি আস্থা ও শুভেচ্ছা বজায় রাখার জন্যও রপ্তানির হিসাবে তারতম্যের নিরসন হওয়া দরকার। আইএমএফ থেকে ঋণ নেওয়ার জন্য সরকার এ সংস্থাকে যে চিঠি দিয়েছে এবং এ পরিপ্রেক্ষিতে আইএমএফের টিম ঢাকায় এসে যেসব তথ্য জানতে চেয়েছে, তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ছিল দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সম্পর্কে। সরকার ও আইএমএফের হিসাবে গরমিল পেয়েছে আইএমএফ। এ কারণে আইএমএফ আমাদের সরকারকে বলেছে, রিজার্ভসংক্রান্ত তথ্য সঠিকভাবে উপস্থাপন করা অত্যন্ত জরুরি। অর্থনীতি এমন একটি বিষয়, যা নিয়ে লুকোচুরি খেলা যায় না। অর্থনীতিসংক্রান্ত পরিসংখ্যানগুলো যত সঠিক ও নির্ভরযোগ্য হবে, ততই নীতি প্রণয়ন সহজসাধ্য হবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে লক্ষ করা গেছে, বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিক্সের (বিবিএস) তথ্যকে ক্ষমতাসীনরা চ্যালেঞ্জ করায় বিবিএস বাধ্য হয়েছিল একজন মন্ত্রীর ইচ্ছানুযায়ী তথ্য পালটে দিতে। এর ফলে দেশের কী লাভ হয়েছিল তা আমার জানা নেই। তবে বাস্তব ক্ষেত্রে পরিসংখ্যান বদলে দেওয়ার ফলে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। সত্য চাপা দেওয়া যায় না। যেমন, সূর্য উঠলে আলোর সৃষ্টি হবে, তাকে আড়াল করা সম্ভব নয়।
পরিসংখ্যান ব্যুরো আমাদের কাছে অতিপরিচিত আদমশুমারির পরিবর্তে জনশুমারি শব্দটির প্রচলন করেছে। এতে কী ফায়দা হলো বোঝা কঠিন। হতে পারে এটি বাংলা ভাষায় আরবি ও ফার্সি শব্দগুলো পরিহার করার একটি চেষ্টামাত্র। এসব ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি ফলদায়ক হয় না। গত বছরের জুলাইয়ে প্রাথমিকভাবে জানানো হয়েছিল, দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ। এ তথ্য যখন পরিবেশিত হলো তখন বিশ্বাস করা যায়নি। মনে হয়েছে, বাংলাদেশের জনসংখ্যা আরও বেশি হবে। বিআইডিএস আয়োজিত সেমিনার থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জনশুমারি ও গৃহগণনার প্রাথমিক প্রতিবেদনে ২.৭৫ শতাংশ মানুষ বাদ পড়েছে। এ ছাড়া ওই শুমারিতে গ্রামের চেয়ে শহরে বাদ পড়ার হার বেশি। বিবিএসের শুমারিতে গ্রামে বাদ পড়েছে ২.৫৪ শতাংশ মানুষ আর শহরে বাদ পড়েছে ৩.১৯ শতাংশ। তবে সবচেয়ে বেশি বাদ পড়েছে সিটি করপোরেশনে-৩.৭০ শতাংশ। প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, বিবিএসের শুমারিতে সিলেট বিভাগের ৩.২৮ শতাংশ, ময়মনসিংহ বিভাগের ২.৯৬ শতাংশ বাদ পড়েছে। ৬ মাস আগে প্রকাশ করা প্রতিবেদনে জানানো হয়, দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬ জন। গত এক দশকে জনসংখ্যা বেড়েছে ২ কোটি ১১ লাখ ১৪ হাজার ৯১৯ জন। প্রতিবেদনে দেখা যায়, জনসংখ্যার বার্ষিক গড় বৃদ্ধির হার ১.২২। পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বিআইডিএসের সেমিনার থেকে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, চূড়ান্ত হিসাবে এখন জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৯১১ জন, যা প্রাথমিক প্রতিবেদনে ছিল ১৬ কোটি ৫১ লাখ। অর্থাৎ চূড়ান্ত হিসাবে জনসংখ্যা ৪৭ লাখ বেড়েছে। সরকারিভাবে জানানো হয়েছে, জনশুমারির বাকি তথ্য এক সপ্তাহের মধ্যে জানানো হবে।
আমার জীবদ্দশায় অনেক আদমশুমারি দেখার সুযোগ হয়েছে। ছোটবেলায় শুনতাম কারফিউ দিয়ে আদমশুমারি করা হয়। কারফিউয়ের সময় লোকজন ঘরে থাকে বলে গণনা প্রায় সঠিক হয়। এবার যখন প্রাথমিক গণনা হয়েছিল, তখন অনেকের কাছে শুনেছি তাদের ঢাকার বাসায় গণনাকারীরা যায়নি। না যাওয়ার কারণ সম্ভবত সঠিক মনিটরিংয়ের অভাব। এবার গণনাকারীদের একটি করে ট্যাব দেওয়া হয়েছিল। শুমারির জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার বিষয়টিকে আকর্ষণীয় করলেও দেখা যাচ্ছে শুমারির বাস্তব প্রক্রিয়ায় সৎ কর্মীর অভাব ছিল। আমরা চাই সঠিক পরিসংখ্যান। সঠিক পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে নির্ধারিত হোক জননীতি।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ
সোর্স : যুগান্তর