দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দেওয়া তথ্য যাচাই করার সক্ষমতা নেই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি)। এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দেওয়া তথ্য যাচাই ছাড়াই বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে তারা। এই প্রতিবেদন প্রতিবছর রাষ্ট্রপতির কাছে হস্তান্তর করা হয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়েও নানা প্রয়োজনে এই তথ্যই ব্যবহার করা হয়।
ইউজিসি গত মাসে ৪৮তম বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদনে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাথাপিছু ব্যয়ে অসামঞ্জস্য দেখা গেছে। এই অসামঞ্জস্যকে অস্বাভাবিক বলে স্বীকার করলেও বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বা ইউজিসির তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইউজিসির একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, মূলত দুই কারণে তথ্য যাচাই করতে পারে না ইউজিসি। প্রথমত, এত বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য যাচাইয়ের সক্ষমতা ইউজিসির নেই। মাত্র দুজন কর্মী দিয়ে এই কাজ করতে হয়, কোনো পরিসংখ্যানবিদ নেই। দ্বিতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে তথ্য দেয়, সেই তথ্যের ওপরই পূর্ণ আস্থা রাখা হয়।
ইউজিসির প্রকাশিত প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে চার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বার্ষিক মাথাপিছু ব্যয় বেড়েছে ২৮ গুণ পর্যন্ত। এক বছরের ব্যবধানে এই পার্থক্য অস্বাভাবিক।
প্রতিবেদন মতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) এক বছরের ব্যবধানে শিক্ষার্থীদের মাথাপিছু বার্ষিক ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৯ গুণ। ২০২০ সালে ব্যয় ছিল ২১ হাজার ২৩৮ টাকা, ২০২১ সালে তা বেড়ে হয়েছে এক লাখ ৮৭ হাজার ৯০২ টাকা। একইভাবে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) মাথাপিছু ব্যয় বেড়েছে ১২ গুণের বেশি। ২০২০ সালে ব্যয় ছিল ২৩ হাজার ৯৬০ টাকা, ২০২১ সালে তা হয়েছে দুই লাখ ৯৮ হাজার ৬৬০ টাকা। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যয় বেড়েছে তিন গুণের বেশি। ২০২০ সালে ব্যয় ছিল ৭৫ হাজার টাকা, ২০২১ সালে ব্যয় হয়েছে দুই লাখ ৩৭ হাজার টাকা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভিয়েশন অ্যান্ড এরোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যয় বেড়েছে ২৮ গুণের বেশি। ২০২০ সালে ব্যয় ছিল ৫৮ হাজার ৯৪৮ টাকা, ২০২১ সালে শিক্ষার্থীপ্রতি বার্ষিক ব্যয় হয়েছে সাত লাখ ৮৮ হাজার ৩৪৬ টাকা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইউজিসির একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিশ্ববিদ্যালয় ও এরোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম। অবকাঠামো ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের কারণে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যয় বেশি হয়েছে। তাই এমন পার্থক্য। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটের ব্যয়ে যে পার্থক্য রয়েছে তা অস্বাভাবিক। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হয়তো ভুল তথ্য দিয়েছে।
বুয়েটের কম্পট্রোলার অধ্যাপক জসিম উদ্দিন আকন্দ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের মাথাপিছু ব্যয়ের পার্থক্যের বিষয়টি আমার জানা ছিল না। ইউজিসির দেওয়া ছকে আমরা তথ্য পাঠাই, গড় হিসাব তারা করে। আমাদের সমস্যা থাকলে ইউজিসি থেকে খোঁজ নেওয়ার কথা। তবে এক বছরেই মাথাপিছু ব্যয়ের পার্থক্য এত বেশি যে এটা প্রায় অসম্ভব।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রথমে এই হিসাব আমার নিজের কাছেই অস্বাভাবিক মনে হয়েছে। হিসাব বিভাগ থেকে জানতে পেরেছি, হয়তো বার্ষিক মাথাপিছু ব্যয়ের পরিবর্তে শিক্ষার্থীদের মাসিক মাথাপিছু ব্যয় দেখানো হয়েছে। তাই এমন পার্থক্য।’
প্রতিবেদন মতে, গত বছরের তুলনায় শিক্ষার্থীদের মাথাপিছু ব্যয় বেড়েছে ২২ বিশ্ববিদ্যালয়ে। একই সময়ে ১৬ বিশ্ববিদ্যালয়ে কমেছে মাথাপিছু ব্যয়। আবার শিক্ষার্থীদের মাথাপিছু ব্যয়ে সর্বোচ্চ স্থানে রয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভিয়েশন অ্যান্ড এরোস্পেস ইউনিভার্সিটি। প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য বছরে গড় ব্যয় সাত লাখ ৮৮ হাজার ৩৪৬ টাকা। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, তাদের মাথাপিছু ব্যয় পাঁচ লাখ ৯৩ হাজার টাকা। তৃতীয় অবস্থানে থাকা বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাথাপিছু ব্যয় চার লাখ তিন হাজার টাকা।
ইউজিসি কর্তৃপক্ষ জানায়, বর্তমানে ৫০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এর মধ্যে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান, চিকিৎসা, প্রকৌশল ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় সব সময় বেশি হয়ে থাকে এবং সেটাই স্বাভাবিক।
ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদন মতে, ২০২১ সালে শিক্ষার্থীদের মাথাপিছু ব্যয়ে সবচেয়ে পিছিয়ে ছিল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, মাত্র ৭৪৩ টাকা। এর পরের অবস্থান উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের। এখানে মাথাপিছু ব্যয় দুই হাজার ৭৯৩ টাকা।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মশিউর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ভিন্নতা রয়েছে। তার পরও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মাথাপিছু ব্যয় অপেক্ষাকৃত কম। শিক্ষার্থীদের ফি থেকেই শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ইউজিসি থেকে আলাদা কোনো বরাদ্দ নেই। যদিও শিক্ষকদের বেতন-ভাতা দেওয়াসহ অবকাঠামোগত উন্নয়নে সরকার অর্থায়ন করে থাকে। এসব ব্যয় নিয়ে হিসাব করা হলে শিক্ষার্থীদের মাথাপিছু ব্যয়ের চিত্রে ভিন্নতা আসতে পারে।
সার্বিক বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক মো. সাজ্জাদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সব বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য যাচাই করার সক্ষমতা ইউজিসির নেই। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া তথ্য নিয়ে প্রতিবেদন করি, তথ্যের দায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের।’ তিনি আরো বলেন, ‘অফিশিয়াল ডাটা দেয় বলে তাদের ভুল তথ্য দেওয়ার সুযোগ থাকে না। বরং আমাদের টাকার হিসাব যেভাবে হয়, সেটা বিজ্ঞানসম্মত নয়। যেমন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক ধরনের বিনিয়োগ করা হয়। সেভাবে পর্যবেক্ষণ না করায় কিছু পার্থক্য দেখা যায়। উল্লিখিত চার বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কমিশন থেকে দেখা হয়েছে, সেখানে তথ্যগত কোনো সমস্যা পাওয়া যায়নি।’
সোর্স : কালের কন্ঠ