সরকার সম্প্রতি চলতি বছরের হজ্ব প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন এবং এই প্যাকেজ অনুযায়ী এ বছর হজ্বে যেতে হলে জনপ্রতি ৬,৮৩,০১৫.০০ খরচ পড়বে, অর্থাৎ প্রায় ৭ লাখ টাকা। হজ্বের সময়ে হাজী সাহেবদের পকেট খরচ, ছেলে মেয়ে বন্ধু বান্ধব পাড়া প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনের খেজুর, আতর, জায়নামাজসহ অন্যান্য গিফট আইটেম ও জমজমের পানির দাম ধরলে এই খরচের পরিমাণ অন্যূন আট লাখ টাকা হতে পারে বলে অনেকে অনুমান করছেন। এর সাথে কুরবানির খরচও যোগ হবে। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করতে গেলে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের কারুর পক্ষে এই চড়া মূল্য দিয়ে এবছর হজ্ব করা অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত বছর সরকারিভাবে হজ্ব করার জন্য দু’টি প্যাকেজ ছিল। প্রথম প্যাকেজের খরচ ছিল ৫,৮৬,৩৪০/- টাকা এবং দ্বিতীয় প্যাকেজের খরচ ছিল ৫,২১,১৫০/- টাকা। গত বছরের সর্বনি¤œ প্যাকেজ থেকে এ বছর ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে ১,৬১,৮৬৫/- টাকা। করোনার কারণে ২০২১ সালে হজ¦ বন্ধ ছিল, একই কারণে ২০২২ সালে হজে¦র আকার ছিল সীমিত; বেশির ভাগ হাজীই ছিলেন সৌদি আরব ও তার ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী দেশসমূহের নাগরিক ও সেখানকার প্রবাসী। ২০১৯-২০ সালে হাজার হাজার বাংলাদেশী ২১ সালে হজ্বে যাবার জন্য টাকা জমা দিয়েছিলেন। তারা হজ্বে যেতে পারেননি এমনকি তাদের টাকাও সরকার ফেরত দেননি।
একটি মুসলিম দেশে মুসলমানদের হজ্ব পালনে সহযোগিতা করা সরকারের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, তুরস্ক, আমিরাত, ইরাক, ইরান এমনকি আমাদের প্রতিবেশী অমুসলিম ভারতে ভর্তুকী দিয়ে কম খরচে মুসলমানদের হজ্ব পালনে সহায়তা করা হয়। চলতি বছরে ভারতে জনপ্রতি হজ্বের খরচ আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা। আমাদের দেশে দু’সপ্তাহের ওমরার খরচ ১ লাখ ৩০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা। এ অবস্থায় কোন অজুহাতেই হজ্বের খরচ ৭/৮ লাখ টাকা মেনে নেয়া যায় না। সরকারের উচিত অবিলম্বে হজ্বের ব্যয় হ্রাস করা। ভারতসহ অন্যান্য দেশগুলো ওয়াকফ স্টেটসমূহের অর্জিত আয় হাজীদের ভর্তুকী দানের কাজে ব্যবহার করেন। আমাদের সরকারের সদিচ্ছা থাকলে তারাও আমাদের হাজার হাজার ওয়াকফ স্টেটের আয় এ কাজে ব্যবহার করে হজ্বের ব্যয় কমিয়ে আনতে পারেন।
হজ্ব ইসলামের অন্যতম প্রধান বুনিয়াদী এবাদত। আর্থিক সঙ্গতি ও সচ্ছলতাসম্পন্ন প্রত্যেক মুমিনের জন্য জীবনে একবার হজ¦ করা ফরজ। সত্যনিষ্ঠ ঈমানদার একজন মুমিন ব্যক্তির এই হজ¦ তাকে ইসলাম ও তার নবীদের জীবনের ত্যাগ-তিতিক্ষা, জেহাদ ও বিপ্লবী দিকগুলোর সাথে প্রত্যক্ষভাবে পরিচয় করিয়ে দেয়, তার ঈমানকে শাণিত করে এবং সাথে সাথে তার জীবনের অতীত পাপ ও পঙ্কিলতাকে ধুয়ে মুছে তাকে নিষ্পাপ করে দেয় এবং ভবিষ্যতে সংগ্রামী জিন্দেগী বুলন্দ করার জন্য তাকে রূহানী ও দৈহিক শক্তিতে বলীয়ান করে তোলে। আধ্যাত্মিক তাৎপর্য ছাড়াও হজ্বের বৈষয়িক তাৎপর্যও রয়েছে। একজন হাজী সমাজে সম্মানীত ব্যক্তি হিসেবে আলাদা মর্যাদা পান।
উপরোক্ত অবস্থায় বাংলাদেশসহ সারাবিশে^র সঙ্গতিসম্পন্ন মুসলমানদের অনেকেই হজ¦ করতে যান এবং স্বাভাবিকভাবেই হজ¦ ব্যবস্থাপনার ভার সরকারের উপর বর্তায়। এই ব্যবস্থাপনা ভাল হলে সরকার কৃতিত্ব পান আর খারাপ হলে তার কপালে গালমন্দ জোটে। এক সময় সরকারিভাবে হজে¦ যাওয়ার জন্য এতবেশি চাপ ছিল যে, তা মোকাবিলার জন্য সরকারকে ব্যালট পদ্ধতি প্রবর্তন করতে হয়। এখন ব্যালটিং সিস্টেম থাকলেও বেশির ভাগ লোকই বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হজ¦ করেন, সরকারি কোটা অধিকাংশই খালি থাকে। এর অর্থ এই নয় যে, সরকারের উপর হজ¦ যাত্রীদের আস্থা নেই। মটিভেশনের অভাব এবং বেসরকারি এজেন্সিগুলোর প্যাকেজ সুবিধার টোপ এবং এগ্রেসিভ সেলসম্যানের ভূমিকা এর জন্য প্রধানত দায়ী।
আগেই বলেছি হজ্ব ইসলামের অন্যতম মৌলিক ইবাদত। শুধু আর্থিক সঙ্গতি নয়, হজ্বের সবগুলো দায়িত্ব পালন করার জন্য প্রত্যেক হজ্বযাত্রীর শারীরিক যোগ্যতা থাকাও অপরিহার্য। বাংলাদেশের হজ্বযাত্রীদের মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে একটি প্রবণতা লক্ষণীয় এবং সেটা হচ্ছে বয়সের ভারে ন্যুব্জ না হলে অনেকেই হজ্বে যেতে চান না। ভাবখানা এই, যা পাপ করার আগেই করে নিই, হজ্ব করে সংসার ছেড়ে কবরের জন্য অপেক্ষা করাই হচ্ছে প্রধান কাজ। এ ধরনের লোক হজ্ব করতে গিয়ে বিপদে পড়ে যান।
শারীরিক দুর্বলতার কারণে তারা ভিড় মোকাবিলা করতে পারেন না। তাওয়াফ, সা’য়ী, মীনায় কংকর নিক্ষেপ এমনকি আরাফাত এবং মুযদালিফায় অবস্থানও তাদের জন্য কষ্টকর হয়ে পড়ে।
তাদের সাথী হয়ে যারা যান স্বাভাবিক কারণেই তাদের দেখা শোনার সময় বেশি দিতে হয় বলে তারাও তাদের হজ্বের রুকনগুলো পূর্ণাঙ্গভাবে পালন করতে পারেন না। এ প্রেক্ষিতে আমাদের সরকার এবং আলেম সমাজের উচিত ‘বৃদ্ধ’ বয়সে নয় বরং জোয়ান বয়সে হজ্বকে উৎসাহিত করা। অনেকে আবার হজ্ব করতে যান, কিন্তু নামাযও পড়তে জানেন না, হজ্বের নিয়ম-কানুন তো দূরের কথা। আমাদের গ্রামের সহজ সরল মানুষ অনেক কিছু সম্পর্কেই অবহিত নন। অনেক হজ্বযাত্রী লোটাবাটি সাথে নিয়ে যান, যার কোন প্রয়োজন নেই। অনেকে টয়লেট ব্যবহার করতে জানেন না, ফলে উড়োজাহাজে, মক্কা, মদীনা, মীনা, আরাফাতে তাদের বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। রেডিও-টেলিভিশন ও অন্যান্য গণমাধ্যম এবং শিক্ষা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সম্পর্কে তাদের সচেতন করা আমাদের দায়িত্ব। ধর্ম মন্ত্রণালয় এই উদ্যোগটি গ্রহণ করতে পারেন।
হজ্ব নিঃসন্দেহে একটি সশ্রম ইবাদাত এবং এর অনুশীলনগুলো অনুসরণের জন্য প্রত্যেক হাজীর শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতির প্রয়োজন অত্যাধিক। এ প্রেক্ষিতে তাদের সফর এবং অবস্থান যথাসম্ভব আরামদায়ক হওয়া বাঞ্ছনীয়। শুধু বাংলাদেশ সরকার কিংবা বেসরকারি হজ্ব এজেন্সিগুলো এর পূর্ণাঙ্গ নিশ্চয়তা দিতে পারেন না। কেননা, এর সাথে সৌদি সরকারের সংশ্লিষ্টতাও রয়েছে। অবশ্য সৌদি সরকার হজে¦র ন্যায় বিশাল একটি অনুষ্ঠানকে সফল করার জন্য যে দক্ষতা ও যোগ্যতার পরিচয় দিচ্ছেন তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। হজ্বের আগে ও পরে এবং হজ্বের সময় মক্কা, মদীনা, আরাফাত, মুযদালিফা ও মীনাতে প্রায় এক মাস ধরে পঞ্চাশ লক্ষাধিক লোকের আবাসনসহ অন্যান্য মৌলিক চাহিদা পূরণ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিতকরণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে সৌদি সরকারের সাফল্য প্রশ্নাতীত।
ধর্ম প্রতিমন্ত্রী হজ্ব ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনার কথা বলেছেন। তিনি আরো বলেছেন যে, মন্ত্রিসভা কমিটি কর্তৃক হজ্বনীতি অনুমোদনের পর এই পরিবর্তন আনা হবে। সরকারি এবং বেসরকারি হজ্ব ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এমন কতকগুলো বিষয় আছে যেগুলো মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকের জন্য অপেক্ষা না করেও সুরাহা করে নেয়া জরুরি বলে আমি মনে করি। হজ্বে যাবার প্রস্তুতিমূলক কাজ হিসেবে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স এবং হেলথ সার্টিফিকেট সংগ্রহ করা অপরিহার্য। হজ্ব অফিস কিংবা এজেন্সি রিপোর্টের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট হজ্ব যাত্রীর আবেদন অনুযায়ী অধিকাংশ থানা থেকে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা পুলিশ ক্লিয়ারেন্স দিয়ে দিচ্ছেন। এটি একটি ভালো লক্ষণ। কিন্তু হেলথ সার্টিফিকেট নিতে গিয়ে অধিকাংশ হজ্ব যাত্রীদের হয়রানির শিকার হতে হয়। অনেক হজ¦ এজেন্সি তাদের ক্লায়েন্টদের হাতে একটা পত্র ধরিয়ে দিয়েই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেন। অসহায় ব্যক্তিরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে দিনের পর দিন ধর্না দিয়েও টিকা-ইনজেকশন নিতে কিংবা সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হন। অনুমোদিত হাসপাতাল কিংবা স্বাস্থ্য কেন্দ্রের স্বল্পতাই এর জন্য প্রধানত দায়ী। সরকার পর্যাপ্ত সময় হাতে রেখে প্রয়োজন বোধে বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে এই দায়িত্ব বণ্টন করে দিলে এ ক্ষেত্রে হয়রানির পরিমাণ হ্রাস পেতে পারে।
হজ¦ মওসুমে হাজীদের পরিবহন সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে। বিমানের উড়োজাহাজগুলো নষ্ট হবারও এটি একটি মওসুম। ফলে ফ্লাইট বিলম্ব যাবার সময় যেমন হাজীদের অসুস্থ করে দেয় তেমনি আনার সময়ও অনেক ক্ষেত্রে তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। বিগত মওসুমসমূহে এমন ফ্লাইট ছিল না যে, ফ্লাইট বিলম্ব করেনি। ফিরতি ফ্লাইটে অধিকাংশ যাত্রীকেই ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত প্রতীক্ষার প্রহর গুণতে হয়েছে। ফ্লাইটের ভাগ্য সম্পর্কে হজ্ব মিশন কিংবা বিমানের কর্মকর্তারা কোনো তথ্য দিতে পারেনি। তাদের অনেকেই যাত্রীদের সাথে দুর্ব্যবহার করেছেন। খোলা আকাশের নিচে সাগরের ঠা-া বাতাসের আঘাতে জর্জরিত মহিলা ও শিশু এবং বৃদ্ধ হজ্বযাত্রীরা বাংলাদেশ হজ¦ ক্যাম্পে যে দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন তা ভাষায় বর্ণনাতীত। তাদের বসার জায়গা ছিল না, খাবার ছিল না। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত শীতে মুহ্যমান অনেকে ময়লা ফ্লোরে শুয়ে পড়তেও বাধ্য হয়েছেন। মেডিকেল মিশনের কোনো সদস্যকে সেখানে পাওয়া যায়নি। পাশর্^বর্তী পাকিস্তান ও ভারতীয় মিশন তাদের সাহায্য করছে। হজ্ব মিশন ও বিমানের কর্তারা হাজীদের সাথে দুর্ব্যবহার করেছেন। পরিবর্তিত হজ¦ ব্যবস্থাপনায় এ বিষয়গুলো প্রাধান্য পাওয়া জরুরি বলে আমি মনে করি।
আমি আগেই বলেছি, আমাদের দেশের মোট হজ্ব যাত্রীদের প্রায় ৯২ শতাংশ বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হজ¦ করেন। তাদের ওপর হাজীদের মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরশীলতা এবং সরকারি নিয়ন্ত্রণের অভাব অধিকাংশ বেসরকারি এজেন্সিকে হজ্বের ন্যায় একটি ভালো কাজে সেবকের পরিবর্তে শোষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ করিয়েছে। তারা বেহেশতের সুযোগ-সুবিধার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আল্লাহর মেহমানদের দোজখের যন্ত্রণায় নিক্ষেপ করেন। আমি পাইকারীভাবে সবগুলো বেসরকারি হজ্ব এজেন্সিকে দোষারোপ করতে চাই না। তাদের মধ্যে ভালো এজেন্সি অবশ্যই আছে। তবে তার সংখ্যা অত্যন্ত কম। সেবার মনোবৃত্তি এবং এবাদতে অংশীদারিত্বের মানসিকতার পরিবর্তে কম সার্ভিস দিয়ে হাজীদের কাছ থেকে কিভাবে বেশি পয়সা নেয়া যায়, এই চিন্তা তাদের অনেককে আড়ষ্ট করে রাখে। এ বছর সরকারও এর সাথে যোগ দিয়েছে। নিম্নমানের বাড়িভাড়া, নি¤œমানের খাবার পরিবেশন প্রভৃতি তাদের বৈশিষ্ট্য।
যে কক্ষে সর্বোচ্চ ৫ জন লোকের আবাসন হতে পারে সে কক্ষে মেঝের ওপর ফোম বিছিয়ে তারা ১০ থেকে ১৪ জন হাজীর থাকার ব্যবস্থা করেন। ফলে পায়খানা, পেশাব, গোসল, ওজু ও হাত মুখ ধোয়া, কাপড় কাছা প্রভৃতির বেলায় সমস্যা দেখা দেয়। আল্লাহর মেহমান হিসেবে এতে অনেকেই আপত্তি করেন না। সয়ে যান, কিন্তু যারা করেন তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করা হয়। পানির কষ্ট তো আছেই। যে মানের আবাসন ও খাবারের জন্য হাজীদের কাছ থেকে তারা পয়সা নেন তার অর্ধেক মানও তারা সংরক্ষণ করেন না। নিম্নমানের বাড়ি ভাড়া, নিম্নমানের খাবার সরবরাহ করে তারা মুনাফার পরিমাণ বাড়ান। আবার মীনা, আরাফাত-মুযদালিফায় অবস্থানের পাঁচদিন তাদের অনেকেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী খাবার সরবরাহ করেন না, পয়সা বাঁচান। হজ্বের পর দেশে প্রত্যাবর্তনের প্রাক্কালে ৪৬ ঘণ্টা আগে তাদের হোটেল থেকে নিয়ে এসে এয়ারপোর্টে বসিয়ে রাখা হয় এগুলো নিছক তাদের পয়সা রোজগারের কৌশল। মক্কা-মদীনায় বাংলাদেশের ডজনখানেক বেসরকারি হজ্ব এজেন্সি সমসংখ্যক ভারতীয়, পাকিস্তানী, আফগান ও ইন্দোনেশীয় এজেন্সি প্রদত্ত আবাসিক ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা তুলনামূলক অবস্থায় পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে যে, বাংলাদেশী এজেন্সিগুলো কর্তৃক প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধাই সবচেয়ে বেশি নিম্নমানের। এমনকি বাংলাদেশ সরকারের ব্যবস্থাপনায় প্রদত্ত বাড়িঘরের তুলনায়ও। তবে সরকারি ব্যবস্থাপনায় আগত ভারতীয় পাকিস্তানী হাজীরা বাংলাদেশের সরকারি ব্যবস্থাপনায় হজ্ব পালনকারীদের তুলনায় উন্নত সেবা পেতে দেখা গেছে। বাংলাদেশ সরকারের ন্যায় তারাও খাবার পরিবেশন ও কুরবানির জন্য রিয়াল ফেরত পেয়েছেন। তবে তা ফ্ল্যাটে রেইটে নয়, দূরত্বের অনুপাতে। আমাদের ধর্ম মন্ত্রণালয় বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।
হজ্বকে নির্বিঘ্ন ও আরামদায়ক করার বিষয়টি শুধু বাংলাদেশ সরকারের উপর নির্ভর করে না। সৌদি সরকারের ভূমিকাও এখানে মুখ্য। সৌদি সরকার ও বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিরা যদি যৌথভাবে হাজীদের আবাসিক স্থানগুলো পরিদর্শন করেন এবং তছবিয়ার শর্তাবলী মেনে চলা হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করেন তাহলে অবস্থার অনেক উন্নতি হতে পারে। আমি যতদূর বুঝতে পারি, হাজীদের সুযোগ-সুবিধা দেখা আমাদের হজ্ব মিশনের প্রধান কাজ। কিন্তু এখানে অর্থাৎ মিশনে যারা অন্তর্ভুক্ত হন, ডাক্তারসহ অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারী তারা যখন নিজেরা হাজী হয়ে যান তখন হাজীদের দেখার আর কেউ থাকে না। তাদের হাজী হওয়া বন্ধ করতে না পারলে অবস্থার উন্নতি হতে পারে না। কাজেই মিশনে এমন লোক অন্তর্ভুক্ত করা দরকার যারা ইতঃপূর্বে হজ্ব করেছেন।
বেসরকারি এজেন্সিগুলোর সাথে মোয়াল্লেমদের অনেকেই আঁতাত করে হাজীদের সুযোগ-সুবধিা থেকে বঞ্চিত করেন, জেদ্দা এয়ারপোর্টে পৌঁছার পরই তা শুরু হয়। মোট হজ্ব চার্জ হিসেবেপরিবহনের জন্য একটা অংক নির্দিষ্ট করা থাকে। এয়ারপোর্ট থেকে মক্কা-মদীনায় আনা-নেয়া ছাড়া জেয়ারতের স্থানসমূহে এবং মীনা আরাফাতের আনা-নেয়া প্রভৃতি এই পরিবহন সুবিধার অন্তর্ভুক্ত। এখন ট্রেন সার্ভিস চালু হওয়ায় তো সুবিধা বৃদ্ধি পাবার কথা ছিল। এয়ারপোর্টে পৌঁছার পর পাসপোর্টগুলো মোয়াল্লেমরা রেখে দেন। নিয়মানুযায়ী কোনো স্থান সফর না করলে ঐ স্থানের টিকিট বাবদ যে অর্থ তা ফেরত দিতে হয়। পাসপোর্টের সাথে যেহেতু তারা টিকিটগুলো রেখে দেন সেহেতু তাদের ইচ্ছেমতো তারা সেগুলো ব্যবহার করেন। সফর না হলেও সফর বাবদ অর্থ তারা ফেরত দেন না। আবার গাড়িতে উঠা-নামার ব্যাপারে কোনো শৃঙ্খলা না থাকায় মহিলা ও বয়স্ক হাজীদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। অনেক হাজী হারিয়ে যান। পথে পথে ঘুরেন কোনো সহৃদয় ব্যক্তি খুঁজে পেলে তারা তাদের তাঁবুতে নিয়ে যান অথবা মিশন অফিসে পৌঁছান। প্রত্যেক মোয়াল্লেমের অধীনে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন স্বেচ্ছাসেবী থাকা প্রয়োজন এবং এ বিষয়টি সৌদি সরকারের নজরে আনা দরকার।
সৌদি সরকার আরাফাত ও মীনায় হাজীদের সুবিধার্থে তাঁবুর ব্যবস্থা করে বিরাট প্রশংসনীয় কাজ করেছেন। পানি সরবরাহের অবস্থাও অত্যন্ত ভালো। কিন্তু সেখানে পেশাবখানা ও অজুখানার সংখ্যা কম হওয়ায় হাজীদের অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। এ সংখ্যা বৃদ্ধি করা দরকার এবং ইতোমধ্যে নষ্ট হয়ে যাওয়া টয়লেটসমূহের দরজা ও পানির ট্যাপগুলো মেরামতের কাজ নিশ্চিত করাও প্রয়োজন। সৌদি সরকারের সাথে পরামর্শ করে বাংলাদেশ সরকার এই বিষয়গুলো সুরাহা করার ব্যাপারে সহায়তা করতে পারেন এবং আমার বিশ্বাস এভাবে হজ্বকে আকর্ষণীয় এবং হাজীদের স্বাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধি করা যেতে পারে। আবার হজ্ব সংক্রান্ত ব্যয় মধ্য ও নিম্নবিত্ত হাজীদের নাগালের মধ্যে রাখার বিষয়টির উপরও হজে¦র স্বাচ্ছন্দ্য অনেকাংশে নির্ভরশীল বলে আমি মনে করি।
সোর্স : দৈনিক সংগ্রাম