দেশের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আশঙ্কাজনক হারে নিচে নামছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে অঞ্চল ভেদে পানির স্তর ইতোমধ্যে ৪ থেকে ১০ ফুট নিচে নেমে গেছে। যশোরে এ বছর মাঘ মাসের শুরুতেই ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ৮ থেকে ১০ ফুট নিচে নেমে গেছে। এ অঞ্চলে এমনিতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ২৬ ফুটের নিচে নামলে নলকূপে পানি ওঠে না। এবার সেই পানির স্তর এখনই ৩০ থেকে ৩৫ ফুট নিচে নেমে গেছে। খুলনা এলাকাতেও পানির স্তর ৫ থেকে ৬ ফুট নিচে নেমে গেছে। এ ছাড়া দেশের ভাটি অঞ্চল অর্থাৎ হাওর এলাকা সুনামগঞ্জেও পানির স্তর ৪ ফুটের মতো নিচে নেমে গেছে।
পানির স্তর অস্বাভাবিক মাত্রায় নিচে নেমে যাওয়ার একটি বড় কারণ ব্যাপক হারে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন। জাতিসংঘের এক সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের দিক দিয়ে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। দেশের খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে দেশের কৃষিব্যবস্থা এখন প্রধানত সেচনির্ভর। নদী-নালা ও খালে-বিলে পানি না থাকায় পাওয়ার পাম্পে নদী-নালার পানিতে সেচ এখন নেই বললেই চলে। নদী ও খাল-বিলের পাড়েও বসেছে গভীর নলকূপ। খাবার পানিও উঠছে গভীর নলকূপে অথবা সাবমার্সিবল পাম্পে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) তথ্যমতে, সারাদেশে বোরো মৌসুমে ডিজেল ও বিদ্যুৎচালিত ১৬ লাখ ৩৮ হাজার ৫৫৪টি সেচযন্ত্র ব্যবহার হয়। এসব সেচযন্ত্র দিয়ে পানি উত্তোলনের ফলে চাপ পড়ছে মাটির নিচের পানির স্তরে। এর ফলে সুপেয় পানির উৎস যেমন কমছে তেমনি বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে কৃষিখাত। বর্তমানে বোরো মৌসুম চলছে। বোরো আবাদ পুরোটাই সেচনির্ভর। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার ফলে কৃষকের সেচ খরচ অনেক বেড়ে গেছে। এ ছাড়া পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার ফলে পরিবেশ বিপর্যয় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি বাড়ছে।
পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার অন্যতম আরেকটি কারণ হচ্ছে অনাবৃষ্টি। টানা অনাবৃষ্টির ফলে ভূগর্ভস্থ পানির পর্যাপ্ত পুনরায় পূরণ অর্থাৎ রিচার্জ হয় না। আর ভূ-উপরিভাগের নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর-বাওড়সহ পানির উৎসগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় ভূগর্ভে পানি পর্যাপ্ত পরিমাণ যায় না। এতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর খুব দ্রুত নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। চলতি মৌসুমে এখন মাঘ মাস চলছে। শীতকালের এ সময়ে গ্রীষ্মের আবহাওয়া বিরাজ করছে। মাঘেই চৈত্রের খরতাপ অনুভূত হচ্ছে। এরই মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেছে। এ অবস্থায় এবার দেশজুড়ে আগেভাগেই খরা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, যা দেশে চৈত্র-বৈশাখে দৃশ্যমান হয়ে থাকে। বৃষ্টি না হওয়ায় নদী-নালা, খাল-বিল এখনই শুকিয়ে গেছে। এর ফলে অনেক এলাকায় চাষাবাদে ভূ-উপরিভাগের স্বাভাবিক পানি মিলছে না। এতে করে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ওপর নির্ভরতা ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে।
বিশিষ্ট পানি বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. এম আশরাফ আলী ইনকিলাবকে বলেন, স্বাভাবিক নিয়মে ভূগর্ভস্থ পানির যে স্তরটুকু খালি হয়, তা পরবর্তী সময়ে প্রাকৃতিকভাবেই পূরণ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু অতিরিক্ত পানি উত্তোলন ও স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাতের ফলে ভূগর্ভের পানির স্তর পূর্ণ হচ্ছে না। ভূগর্ভের পানি দিন দিন শুধু কমছেই, বাড়ছে না। আগে থেকেই অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে অতি মাত্রায় নলকূপ বসিয়ে ইচ্ছামতো পানি তুলে ফেলায় অবস্থা এমন হয়েছে যে, এখন আর পানি আমাদের নাগালে পাওয়া যাচ্ছে না। এতে দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি বাড়ছে। বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার ঝুঁকি সৃষ্টি হচ্ছে। এ ছাড়া দেশের বরেন্দ্র অঞ্চল ধীরে ধীরে মরুকরণের দিকে যাচ্ছে আর দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততা বাড়ছে। এতে পরিবেশের এক বিরাট ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হচ্ছে। অতিমাত্রায় লবণাক্ত পানি মৎস্য সম্পদ ও উপকূলবর্তী কৃষি সম্পদেরও মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে চলেছে। বৃহত্তর যশোর, কুষ্টিয়া, খুলনা, ফরিদপুর ও রাজশাহী জেলার জলবায়ু ক্রমাগত মরুময়তার দিকে ধাবিত হচ্ছে।
পরিবেশবিদদের মতে, ভারতের ফারাক্কা বাঁধের ফলে বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতির ওপর বিরাট নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ফারাক্কা বাঁধের ফলে এ দেশের নদ- নদীতে স্বাভাবিক পানি প্রবাহ বন্ধ হয়েছে। পর্যাপ্ত পানি বাংলাদেশের নদ-নদীতে প্রবাহিত না হওয়ায় নদীগুলো শুকনো মৌসুমে শুকিয়ে চৌচির হয়ে পড়ছে এবং তারই প্রভাবে মরুকরণ ত্বরান্বিত হচ্ছে। এ ছাড়া পানি প্রবাহ না থাকায় পলি জমে নদীতল ভরাট হয়ে যাচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানির চাপ সহ্য করতে পারছে না নদী। ফলে প্রায়ই দেখা দিচ্ছে বন্যা। তেমনি শীত মৌসুমে পানির প্রবাহ বন্ধ করে দেয়ায় বাংলাদেশ মারাত্মক পানিশূন্যতার সম্মুখীন হচ্ছে। শুকনো মৌসুমে হ্রাসকৃত পানি প্রবাহের ফলে বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকার কৃষিক্ষেত্র মারাত্মক সঙ্কটের সম্মুখীন হচ্ছে। ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ মারাত্মকভাবে পরিবেশগত বিপর্যয়ের শিকারে পরিণত হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তন, ফারাক্কার বিরূপ প্রভাব ও ব্যাপক হারে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করায় বরেন্দ্র অঞ্চলে অবিশ্বাস্য হারে নিচে নামছে পানির স্তর। রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১২৪টি উপজেলা নিয়ে বরেন্দ্র অঞ্চল। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর রেকর্ড পরিমাণে ১৫০ ফুটের বেশি নিচে নেমে যাওয়ায় এরই মধ্যে অকেজো হয়ে পড়েছে বেশির ভাগ হস্তচালিত নলকূপ। গভীর নলকূপগুলোতে ঠিকমতো পানি উঠছে না।
বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছে গবেষণা সংস্থা ডাসকো ফাউন্ডেশন। ডাসকোর কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম জানান, একযুগ আগেও এসব অঞ্চলে ৬০ থেকে ৭০ ফুট গভীরে পানি পাওয়া যেত। বর্তমানে কোথাও কোথাও ১৫০ ফুট বা তারও নিচেও পানি পাওয়া যাচ্ছে না।
দেশের গড় বৃষ্টিপাত ২ হাজার ৫০০ মিলিমিটার হলেও এ বরেন্দ্র অঞ্চলে গড় বৃষ্টিপাত মাত্র ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ মিলিমিটার। বৃষ্টিপাতে ভূগর্ভস্থ পানির গড় পুনর্ভরণের হার দেশে ২৫ শতাংশ হলেও এ অঞ্চলে মাত্র ৮ শতাংশ। এ কারণেও বরেন্দ্র অঞ্চলের উঁচু এলাকাগুলোতে পানির সঙ্কট ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে।
যশোর ব্যুরো জানায়, যশোরে এ বছর মাঘ মাসের শুরুতেই কোথাও কোথাও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ৩০ থেকে ৩৫ ফুট নিচে নেমে গেছে। সাধারণত ফাল্গুন মাস থেকেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। অথচ সামনে খরা পরিস্থিতি আসার আগে এ অবস্থা দেখা দেয়ায় বড় ধরনের সঙ্কটের আশঙ্কা জোরালো হয়ে দেখা দিয়েছে। পর্যাপ্ত বৃষ্টির অভাব ও অপরিকল্পিতভাবে গভীর-অগভীর নলকূপ স্থাপনের কারণে পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে। এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জাহিদ পারভেজ জানান, জেলার কোথাও কোথাও ভূগর্ভস্থ পানি ৩০ থেকে ৩৫ ফুটের নিচে নেমে গেছে। পানির স্তর স্বাভাবিক ২৬ ফুটের নিচে নামলে নলকূপে পানি পাওয়া যায় না। বিশেষ করে যশোর সদর, বাঘারপাড়া, ঝিকরগাছা ও শার্শা এলাকায় এ অবস্থা দেখা দিয়েছে।
খুলনা ব্যুরো জানায়, প্রাকৃতিক পানির উৎস পুকুর, নদী, খাল-বিল সব শুকিয়ে গেছে। মাঠঘাট ফেটে চৌচির হয়ে পড়েছে। এ বছর পানির অভাবে হালচাষ ও চারা রোপণ করতে পারছেন না কৃষক। এ অবস্থায় বোরো আবাদে সেচ দিতে হচ্ছে শুরু থেকেই। এর ফলে পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যাচ্ছে। খুলনায় বিভিন্ন স্থানে পানির স্তর ৫ থেকে ৬ ফুট নিচে নেমে গেছে।
সুনামগঞ্জ জেলা সংবাদদাতা জানান, জেলার বিভিন্ন হাওর এরই মধ্যে শুকিয়ে গেছে। এতে বোরো আবাদ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন চাষিরা। প্রাকৃতিক সেচ দিতে না পেরে সেলোমেশিনে ভূগর্ভস্থ সেচের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। এতে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে সুনামগঞ্জে পানির স্তর ৪ ফুট নিচে নেমে গেছে।
পানি সম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত ইনকিলাবকে বলেন, বৈশ্বিক জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তনের ফলে গ্রীষ্মের তাপমাত্রা যেমনি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে তেমনি ঠা-াও অনুভূত হচ্ছে ব্যাপক। বেড়ে গেছে নানা রোগের সংক্রমণও। ঋতুচক্রে দেখা দিয়েছে বিশাল হেরফের। আগের মতো এখন আর প্রাকৃতিক নিয়ম মেনে যথাসময়ে ঋতুর আবির্ভাব ঘটছে না। এ কারণে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত ছাড়া অন্য সব ঋতুর অস্তিত্ব অনুভূত হচ্ছে না। বিলম্বিত হচ্ছে শীত, বর্ষার আগমন অথবা অসময়ে ভারী বর্ষণ কিংবা ঠা-া অনুভূত হচ্ছে। যেকোনো এলাকা মরুকরণের প্রাথমিক আলামতই হচ্ছে এসব। আর এ আলামতটি পরিলক্ষিত হচ্ছে সমগ্র বাংলাদেশেই। দেশের বরেন্দ্র অঞ্চল নামে খ্যাত নওগাঁ, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আবহাওয়ায় মরুময়তার লক্ষণ অন্য সব এলাকার তুলনায় বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। গত শীত মৌসুমে তাপমাত্রা প্রায় হিমাঙ্কের কাছাকাছি চলে গিয়েছে, আর গত গ্রীষ্মে ৪০-৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বিরাজ করেছে। মরুকরণের জন্য বৈরী আবহাওয়ার সঙ্গে ৩৮-৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাই যথেষ্ট। জলবায়ু পরিবর্তনের এই সামগ্রিক বিষয়ে দৃষ্টি দিলে নিঃসন্দেহে বলা যায়, এটি আমাদের বরেন্দ্র অঞ্চলের জন্য মহাবিপদ সঙ্কেত। এ বিপর্যয় ঠেকাতে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। নদ-নদী, খাল-বিল অর্থাৎ পানির প্রাকৃতিক উৎস সংরক্ষণ করতে হবে। কঠোর আইন প্রয়োগ করে বৃক্ষ নিধন বন্ধ করতে হবে এবং প্রচুর বৃক্ষরোপণ করতে হবে।
সোর্স : ইনকিলাব