বিদ্যুৎ ও জ্বালানির বাড়তি দামের চাপে চ্যাপ্টা সাধারণ মানুষ। নাভিশ্বাস অবস্থা তাদের। নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী চাপের সঙ্গে এবার সব
কিছুতেই জ্বালানির আগুনে পুড়ছে আমজনতা। এক মাসের ব্যবধানে ১২ কেজির এলপিজিতে একলাফে প্রায় পৌনে ৩শ’ টাকা বাড়তি গুনতে হচ্ছে ক্রেতাদের। দফায় দফায় বেড়েছে গ্যাস এবং বিদ্যুতের দাম। এমন অবস্থায় উচ্চ দ্রব্যমূল্য দিনকে দিন বাড়ছে। এতে বিপাকে পড়ছেন সাধারণ মানুষ। আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। জুন থেকে ১৮ই জানুয়ারি পর্যন্ত গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে দু’দফা। প্রতি দফায়ই এর দাম বেড়েছে রেকর্ড পরিমাণে।
বিজ্ঞাপন
Ad
৫ই জুন গ্যাসের দাম বেড়েছে ২২ দশমিক ৭৮ শতাংশ, ১৮ই জানুয়ারি বেড়েছে ১৮০ শতাংশ। এর ৭ দিন আগে ১২ই জানুয়ারি বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছিল ৫ শতাংশ। ২১শে নভেম্বর পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয় ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। ৫ই আগস্ট জ্বালানি তেলের দাম ৪২ থেকে ৫২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল। ১লা আগস্ট সারের দাম বাড়ানো হয় সাড়ে ৩৭ শতাংশ। গত ৭ মাসে ৪ ধরনের সেবার দাম সাত দফায় বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ ৩০শে জানুয়ারি বাড়ানো হয় খুচরা ও পাইকারি বিদ্যুতের দাম। ওইদিন দেশে ১৯ দিনের ব্যবধানে দ্বিতীয়বারের মতো বাড়ানো হয় বিদ্যুতের দাম। নির্বাহী আদেশে গ্রাহক পর্যায়ে ও পাইকারিতে দাম বৃদ্ধি করা হয়। বিদ্যুতের বর্ধিত দাম পহেলা ফেব্রুয়ারি থেকেই কার্যকর হয়েছে। নতুন ঘোষণায় ফেব্রুয়ারি মাসে আবাসিক এবং শিল্প-কলকারখানায় বিদ্যুতের দাম বাড়ছে অন্তত পাঁচ শতাংশ। পাইকারিতে বিতরণ কোম্পানিগুলোর জন্য বিদ্যুতের দাম বাড়ছে অন্তত আট শতাংশ। এদিকে ২রা ফেব্রুয়ারি একলাফে ১২ কেজি এলপিজিতে ২৬৬ টাকা বাড়ানো হয়েছে। জানুয়ারিতে দাম কমার পর ফেব্রুয়ারিতে এসে দাম বাড়লো এলপিজির। জানুয়ারি মাসে ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম ছিল ১ হাজার ২৩২ টাকা। এখন তা বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৪৯৮ টাকা।
রাজধানীতে চায়ের দোকানি খোকন বেপারী। ১২ কেজি এলপিজি দিয়ে তিনি তার চায়ের দোকানটি কোনো রকম পরিচালনা করেন। গ্যাসের নতুন বাড়তি দামের ঘোষণা শুনে হতাশ তিনি। বললেন, এমনিতেই সবকিছুর দাম বেশি। চিনির দামও আকাশছোঁয়া। দুধের দাম বেশি। তার উপরে গ্যাসের দাম বাড়ানোর কারণে ক্রেতা থেকে আর কতো টাকা বাড়িয়ে নেয়া যায়। তিনি বলেন, মানুষ খুব কষ্টে আছেন। ঘরের চুলার আগুন থেকে শুরু করে সবকিছুতেই দাম বাড়ছে। মানুষের পকেট পুড়ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সব খাতে। শিল্পের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এর প্রভাবে বেড়েছে পণ্যের দাম। মানুষের জীবনযাত্রাকে ব্যয়বহুল করে তুলেছে। একইসঙ্গে গণপরিবহন ও পণ্য পরিবহন ভাড়া বেড়েছে লাগামহীনভাবে। গ্যাসের দাম বাড়ানোর কারণে গ্যাস দিয়ে উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম বাড়বে। ব্যাটারিচালিত গণপরিবহনের ভাড়াও বৃদ্ধি পাবে। জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎকে বলা হয় ‘অর্থনীতির লাইফ লাইন’, যা অর্থনীতির রক্ত সঞ্চালনের মতো। সব ধরনের পণ্য ও সেবা এবং মানুষের জীবনযাত্রায় এগুলোর প্রভাব রয়েছে। অর্থাৎ এসব পণ্য ও সেবা ছাড়া বৈশ্বিক বা মানুষের জীবনযাত্রা কল্পনাই করা যায় না। যে কারণে এসব পণ্যের দাম দেশে বা বিদেশে বাড়লে এর নেতিবাচক প্রভাব আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে দেশীয় আর্থিক ব্যবস্থাপনায়ও পড়ে। ১৮ই জানুয়ারি সরকারের নির্বাহী আদেশে আকস্মিকভাবে গ্যাসের দাম বাড়ানোর কারণে সব ধরনের পণ্য ও সেবার মূল্য বেড়ে যাবে। এর নেতিবাচক প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়বে রপ্তানি ও শিল্পখাতে। চড়া দামে গ্যাস কিনে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে তার খরচও বাড়বে। গ্যাসনির্ভর শিল্পের বয়লার পরিচালন খরচও বাড়বে। বিশেষ করে বস্ত্র, সিরামিক, প্লাস্টিক, লৌহ, প্রকৌশল, জাহাজ ভাঙা, ইস্পাত শিল্পে খরচ বেশি বাড়বে। এগুলোর দাম বাড়লে নির্মাণ, আবাসন, উন্নয়ন খরচসহ অনেক খাতেই খরচ বাড়বে।
নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম সাংবাদিকদের বলেছেন, গ্যাসের দাম যেভাবে বাড়ানো হয়েছে, তাতে উৎপাদন খরচ বেশ ভালোভাবেই বাড়বে। এর আগেও জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ফলে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এর সঙ্গে কাঁচামাল ও ডলারের দাম বৃদ্ধি তো আছেই। কিন্তু তারপরও নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ মিলছে না। দাম বাড়ানোর কারণে যে হারে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে তারচেয়ে বেশি বাড়ছে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে। এতে কারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে। উৎপাদন কম হচ্ছে। অথচ শ্রমিক ও অন্যান্য খাতে খরচ কমছে না।
সূত্র জানায়, ২১শে নভেম্বর পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। ১২ই জানুয়ারি ৫ শতাংশ বাড়ানো হলো খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এখন থেকে ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম প্রতি মাসেই সমন্বয় করা হবে। অর্থাৎ ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম আরও প্রায় ১৫ শতাংশ বাড়ানো হবে। এর আগে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাবেও নিত্যপণ্য ও পরিবহন ব্যয় বেড়েছে। যে কারণে আগস্টে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে উঠেছিল। জুলাইয়ে এ হার ছিল ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ।
সব মিলে ভোক্তার কাঁধে চাপ বাড়ছে। মন্দায় আয় বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না বলে ভোক্তাকে জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে আপস করতে হচ্ছে। এটি করলে খাবারে পুষ্টির মান কমবে। বিনোদন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভ্রমণ এসব খাতে ব্যয় কমাতে হবে। ফলে ওইসব খাতে আরও মন্দা ভর করবে। ইতিমধ্যেই পণ্যের বাড়তি দামে ভোক্তার নাভিশ্বাস উঠেছে। আয় না বাড়লেও ব্যয় বেড়েছে। এ পরিস্থিতিতে অনেকে সঞ্চয়ে হাত দিয়েছেন। নতুন সঞ্চয়ও করতে পারছেন না। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ব্যাংকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সার ও বিদ্যুতের দাম বাড়ায় কৃষিতে সংকট আরও বেশি। একদিকে বিদ্যুতের দাম বাড়ায় সেচের খরচ বাড়বে। বাড়তি দামেও গ্রামে বিদ্যুৎ মিলছে না। ফলে সেচ কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অথচ সেচের বড় মৌসুম চলছে এখন। এটা মার্চ পর্যন্ত চলবে। এই সময়ে গ্রামে লোডশেডিংও বেড়েছে।
কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলে সব কিছুতেই এর প্রভাব পড়বে। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। সাধারণ মানুষের কষ্ট আরও বাড়বে। এমনিতেই মানুষ কষ্টের মধ্যে আছেন। সামনে রমজানের বাজার পরিস্থিতি কোনদিকে যায় সেটাই এখন দেখার বিষয়।
সোর্স : মানবজমিন