নাছির উদ্দিন শোয়েব: রাজধানীতে আবারও বেপরোয়া ছিনতাইকারী ও অজ্ঞান পার্টি। সম্প্রতি কয়েকটি ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জোর তৎপরতা শুরু হয়। গত বৃহস্পতিবার রাতে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিংয়ের সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) সাদেক হোসেন চৌধুরী আহত হয়েছেন। এরআগে অজ্ঞান পার্টির তৎপরতা রোধে অভিযানের কথা জানায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ভুক্তভোগিদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনা করে জানা যায়, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় প্রায় প্রতিদিনই ছিনতাই হচ্ছে। বিশেষ করে রাত একটু বাড়তে থাকলে এবং ভোরে ছিনতাই বেশি হয়।
বিভিন্ন সড়কের নির্জন এলাকা, ফুট ওভারব্রীজ, ফ্লাইওভারে চলাচলকারীরা টার্গেট বেশি। রাতে ফ্লাইওভার দিয়ে চলাচল করা মোটরসাইকেল ও সিএনজি অটো রিকশা থামিয়ে চালক এবং যাত্রীদের টাকা এবং মালামাল ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারীরা। এছাড়াও হাতিরঝিলের দুই পাশের সড়কে চলাচলকারীরা ছিনতাইকারীদের টার্গেটে থাকে। রাতে নির্জন স্থান দিয়ে সিএনজি অটো রিকশা ও পায়ে হেঁটে চলাফেরা করা ঝুঁকিপূর্ণ। ছিনতাইকারীরা সুযোগ বুঝে পথচারীদের কাছ থেকে অস্ত্র ঠেকিয়ে নগদ অর্থ, গহনাগাটি, মোবাইল ও অন্যান্য জিনিসপত্র অবলীলায় নিয়ে যায়। ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য এতটাই বেড়ে গেছে যে, পথে-ঘাটে কেউই নিরাপদ বোধ করছে না। এমনকি দিনেদুপুরে প্রকাশ্যে ফুটপাতে বা বাস স্ট্যান্ডেও মানুষকে অপহরণ করে গাড়িতে তুলে নিয়ে মানুষের কাছ থেকে টাকা লুট করে নেয়ার ঘটনা ঘটছে।
সম্প্রতি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মো. হারুন অর রশীদ বলেছেন, অজ্ঞানপার্টির চক্রদের হাত থেকে যাত্রীদের রক্ষায় গণপরিবহনে চালক ও হেলপারদের উচিত হকারদের উঠতে না দেয়া। মো. হারুন অর রশীদ বলেন, যাত্রীর বেশে গাড়িতে উঠে অন্য যাত্রীদের অজ্ঞান করে মালামাল লুট করছেন তারা। গাড়িতে চালক ও হেলপারদের উচিত হবে হকার উঠতে না দেয়া। আমরা অনেক অভিযোগ পেয়েছি তাদের বিরুদ্ধে, এরপর অভিযানে অজ্ঞানপার্টির সদস্যদের গ্রেফতারও করা হয়েছে এবং তারা স্বীকারও করেছেন এ কাজ তারা করেন। তারা বলেছেন, বাসে, ট্রেনে ও লঞ্চে এ ধরনের কাজ বেশি করে থাকে। অনেকের নামও আমরা পেয়েছি। গণপরিবহনে হকারদের নিরুৎসাহিত করতে তাই বাসচালক ও হেলপারদের আরও কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন পুলিশের এ কর্মকর্তা। পুলিশ বলছে, সাধারণত ঈদকে টার্গেট করে অজ্ঞান পার্টি সক্রিয় হলেও তাদের অনেকেই পেশাদার অপরাধী, যারা ১২ মাসই এসব অপকর্মে করে বেড়ান।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (লালবাগ জোন) উপ-পুলিশ কমিশনার মসিউর রহমান বলেছেন, এ ধরনের ওষুধ খাওয়ার পর দুই থেকে তিন মিনিটের মধ্যে অজ্ঞান হয়ে পড়েন ভুক্তভোগী, তখন তার সর্বস্ব লুটে নেয় তারা। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, বাসে ওঠেন তিনজন। দুজন বসেন টার্গেট যাত্রীর পাশে। তৃতীয়জন হকার সেজে বিক্রি করতে থাকেন নানা রকম ওষুধ। টার্গেট যাত্রীকে কৌশলে খাওয়ানো হয় সেই ওষুধ। অজ্ঞান হওয়ার পর ছিনিয়ে নেয়া হয় সর্বস্ব। চক্রটির পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। আর রাজধানীতে অজ্ঞান পার্টির সদস্য অন্তত ২০০ আছে বলে তাদের ধারণা।
পুলিশ আরও জানায়, দুই থেকে তিন ধরনের ঘুমের ওষুধ গুঁড়া করে এরসঙ্গে চ্যাবনপ্রাশ মিশিয়ে তৈরি করা হয় বিশেষ টোটকা। যা খেলে মানুষের নেশা ও তীব্র ঘুম আসে। একপর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন সেবনকারী। মিজান নামে এক ব্যক্তি একসময় তরকারি বিক্রি করতেন। বর্তমানে অজ্ঞান কিংবা মলম পার্টির একজন সক্রিয় হিসেবে এখন তিনি বিশেষ হালুয়া তৈরি করেন। এ বিদ্যা তিনি রপ্ত করেছেন কয়েক বছরের চেষ্টায়। তার তৈরি করা হালুয়া খেয়ে এখন পর্যন্ত অজ্ঞান হয়েছেন প্রায় ৭০০ মানুষ। একা নন, তার দলে আছে আরও চারজন। এ কাজে সবার দায়িত্ব আলাদা আলাদা বলে জানান মিজান। মিজান পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন, পাঁচজনের দলটি অজ্ঞান করার ওষুধ নিয়ে বাসে ওঠেন। একজন হকার সেজে যাত্রীদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। বলা হয়, পেটব্যথা, মাথাব্যথা, গ্যাস্ট্রিক ও যৌন সমস্যার সমাধান মিলবে তাদের তৈরি করা দাওয়াই খেলে। টার্গেট ব্যক্তিকে প্রলুব্ধ করতে নিজেরাই কেউ কেউ কিনে খান। এভাবেই তারা কাজটি করে আসছেন। বাসে, ট্রেনে বা লঞ্চে মানুষকে অজ্ঞান করে সবকিছু লুটে নেয়ার পাশাপাশি প্রায়ই বিষক্রিয়ায় মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে থাকে বলে জানায় পুলিশ।
ডিএমপির অপরাধ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে ছিনতাইয়ের ঘটনায় ঢাকা মহানগরীতে মামলা হয় ১৪৫টি, ২০২০ সালে ১৭৬টি, ২০১৯ সালে ১৫৫টি, ২০১৮ সালে ২১৬টি, ২০১৭ সালে ১০৩টি, ২০১৬ সালে ১৩২টি, ২০১৫ সালে ২০৫টি ও ২০১৪ সালে ২৬৫টি মামলা দায়ের হয়। রাজধানীর ৫০টি থানায় ছিনতাইয়ের ঘটনায় যে মামলা হয় বাস্তব ঘটনা তার চেয়ে অনেক বেশি ঘটে থাকে। সূত্রমতে রাজধানীতে বেশি ছিনতাই হচ্ছে এমন এলাকাগুলোর মধ্যে অন্যতম মোহাম্মদপুর থানা এলাকা। নদীর পার্শ্ববর্তী এলাকা হওয়ায় বেশি ছিনতাই হচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় ছিনতাইকারীরা বিভিন্ন অস্ত্রের মুখে মোবাইল নিয়ে নদীর ওপারে চলে যায়। এসব ঘটনায় এখন পর্যন্ত যে কয়টি মামলা হয়েছে তার প্রায় সব আসামীকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো। কিন্ত তারা জামিনে বের হয়ে ফের একই অপরাধে জড়াচ্ছে। কাওরানবাজার এলাকায়ও ছিনতাই বেশি হয় বলে জানিয়েছে পুলিশের একাধিক সূত্র। এছাড়াও বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে এখন এ ধরনের ছিনতাইকারী গ্রুপ সক্রিয়। বিশেষ করে পান্থপথ, আড়ং ক্রসিং, আসাদ এভিনিউ, শ্যামলী, ধানমন্ডি-১৫, কলাবাগান, আগারগাঁও, ফার্মগেট, মিরপুর-১০, মিরপুর-২, কাজিপাড়া, শ্যাওড়াপাড়া, পল্টন, মতিঝিল, মৌচাক, মগবাজার, কাকরাইল, যাত্রাবাড়ী, দয়াগঞ্জ, ওয়ারী, ফকিরাপুল, রামপুরা, বাড্ডা, উত্তরা জসিমউদ্দীন রোড, আব্দুল্লাহপুর এলাকায় এরা বেশি সক্রিয়।
ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে পার্বত্য মন্ত্রীর এপিএস আহত: ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিংয়ের সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) সাদেক হোসেন চৌধুরী আহত হয়েছেন। রাজধানীর বেইলি রোডের পার্বত্য মন্ত্রীর বাসভবন থেকে দাপ্তরিক কাজ শেষে ফার্মগেট নিজ বাসায় ফেরার পথে ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন তিনি। গত বৃহস্পতিবার রাত ১১টায় এ ঘটনা ঘটে। গতকাল শুক্রবার পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এপিএসকে বহনকারী গাড়িটি কারওয়ান বাজার সার্ক ফোয়ারা অতিক্রম করার সময় এক ছিনতাইকারী এপিএসের হাতে থাকা মোবাইল ফোন ধরে টান দেয়। এপিএস এ সময় ছিনতাইকারীকে বাধা দিলে ছিনতাইকারী তার হাতে ছুরির আঘাত করে পালিয়ে যায়। আহত সাদেক হোসেন বর্তমানে স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এরআগে গত ২২ জানুয়ারি রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর ধলপুরে ‘ছিনতাইকারীর’ ছুরিকাঘাতে অজ্ঞাতনামা এক যুবক নিহত হয়েছেন। তার বয়স আনুমানিক ৩০ বছর। ভোর সাড়ে ৩টার দিকে ধলপুর বউবাজার এলাকায় এ হত্যাকা- ঘটে। ছুরিকাঘাতে মুমূর্ষু অবস্থায় পথচারীরা উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ওই যুবককে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া অটোরিকশাচালক মো. রুবেল হোসেন জানান, ভোর সাড়ে ৩টার দিকে ধলপুর বউবাজার এলাকার রাস্তায় তাকে পড়ে থাকতে দেখেন। তখন তিনি তাকে রিকশায় উঠাতে গিয়ে দেখেন, তার শরীর দিয়ে রক্ত ঝরছে। পরে তাকে মুগদা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে তাকে ঢাকা মেডিকেল নিয়ে যান। কিন্তু বাঁচানো সম্ভব হয়নি।
সোর্স : দৈনিক সংগ্রাম