মসুর ডাল আমদানি করে এবার রেকর্ড গড়েছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। গত ছয় মাসে প্রায় দুই লাখ টন মসুর ডাল আমদানি করেছেন তাঁরা। এটি ২০২১ সালের একই সময়ের তুলনায় দ্বিগুণ। এর পরও বাজারে মসুর ডালের দাম বেড়েছে।
স্বাভাবিকভাবেই আমদানি কম বা আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেশি হলে দেশের বাজারে অস্থিরতা হয়। এই সুযোগে দাম বাড়ান ব্যবসায়ীরা। কিন্তু বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে মসুর ডালের দাম ক্রমাগত কমছে।
এত মসুর ডাল আমদানির পরও বাজারে দাম বাড়ার কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না পাইকারি ব্যবসায়ীরাও।
দেশে ভোগ্য পণ্য বেচাকেনার সবচেয়ে বড় আড়ত চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে গত বৃহস্পতিবার মসুর ডাল বিক্রি হয়েছে মানভেদে কেজি ৯০ থেকে ১৩৮ টাকায়। এক সপ্তাহ আগের তুলনায় দাম বেড়েছে কেজিতে পাঁচ টাকা। খুচরায় দাম আরো বেশি।
খাতুনগঞ্জের আড়তদার সোলায়মান বাদশা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এক সপ্তাহ ধরেই মসুর ডালের দাম বাড়ছে। বাড়ার কোনো সঠিক কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। সরবরাহকারীরা আমাদের বলছেন, পাইকারি বাজার থেকে মসুর ডাল কিনছে সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন বাংলাদেশ (টিসিবি)। ফলে সরবরাহে সংকট তৈরি হচ্ছে, দাম বাড়ছে। কিন্তু এর ভিত্তি আমি খুঁজে পাচ্ছি না।’
খাতুনগঞ্জে এখন চার ধরনের মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে। দেশি মসুর ডালের চাহিদা ও দাম সবচেয়ে বেশি, কেজি ১৩৮ টাকা। অবশ্য মৌসুম শেষ হওয়ায় এখন বাজারে সরবরাহ কম। আর অস্ট্রেলিয়ার মসুর ডাল কেজি ৯০ টাকা, কানাডার মসুর ডাল কেজি ৮৮ টাকা এবং ভারতের মসুর ডাল কেজি ১৩৫ টাকা।
আর চট্টগ্রামের অভিজাত কাজীর দেউড়ি খুচরা বাজারে চিকন মানের খোলা মসুর ডাল কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৪৫ টাকা, আর প্যাকেটজাত ১৫০-১৫৫ টাকা। মোটা মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকায়। খোলা মসুর ডাল বড় শিল্প গ্রুপগুলো প্যাকেট করে ১০ টাকা বাড়তি দামে বিক্রি করছে।
বিদেশ থেকে মসুর ডাল গোটা আকারে আমদানি হয়। এরপর ক্রাশিং মেশিনে প্রক্রিয়াজাত করে সেটি বিক্রি করেন ডাল মিল ব্যবসায়ীরা। এই ক্রাশিং করতে তাঁদের খরচ হয় কেজিতে সর্বোচ্চ এক টাকা। গোটা ডাল থেকে খাওয়ার উপযোগী ডাল করতে ক্রাশিং কারখানায় ৫ শতাংশ প্রসেসিং লস হয়।
চট্টগ্রাম ডাল মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক পরিতোষ দে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মসুর ডাল বড় শিল্প গ্রুপগুলোই আমদানি করছে; আমাদের মতো ছোট আমদানিকারকরা সুযোগ পাননি। কিন্তু এখন যে দাম বাড়ার কথা বলা হচ্ছে, সেটি খুবই সামান্য। আমার মনে হয় যত দিন সরকারি টিসিবি মসুর ডাল বিক্রি করবে, তত দিন পর্যন্ত বাজারে মসুর ডালের দাম বাড়বে না।’
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে দেশে বছরে মসুর ডালের চাহিদা ছয় লাখ টন। এর মধ্যে দুই লাখ ২০ হাজার টন দেশেই উৎপাদিত হয়। বাকি প্রায় চার লাখ টন আমদানি করা হয়। বছরজুড়ে মাসে মসুর ডালের চাহিদা ৪০ হাজার টন। আর রমজানের এক মাসে চাহিদা বেড়ে দাঁড়ায় এক লাখ টনে। এখন দেখা যাক, রমজানের চাহিদার মসুর ডাল দেশে আমদানি হয়েছে কি না, পাইপলাইনে বা আসার পথে আছে কী পরিমাণ।
কাস্টমস ও বন্দরের আমদানির তথ্য বলছে, ২০২২ সালের জুলাই-ডিসেম্বরে মসুর ডাল আমদানি হয়েছে এক লাখ ৯৯ হাজার টন। ২০২১ সালের একই সময়ে আমদানি হয়েছিল এক লাখ ৯ হাজার টন। আমদানি বেড়েছে ৮২ শতাংশ। আর ২০২২ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর তিন মাসেই ঋণপত্র খোলা হয়েছে প্রায় ৩৭ হাজার টনের। সেই মসুর ডাল এখনো দেশে পৌঁছেনি। এখন পর্যন্ত মসুর ডাল আমদানি হয়েছে রেকর্ড পরিমাণ।
চট্টগ্রাম বন্দরের হিসাবে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে ৩৩ হাজার ১৪০ টন মসুর ডালবোঝাই জাহাজ গত ২৬ জানুয়ারি পৌঁছেছে। পরে জাহাজটি মসুর ডাল নামিয়ে বন্দর ছেড়েছে। এই ৩৩ হাজার টন মসুর ডাল যোগ হলে ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত আমদানি দুই লাখ ৩৪ হাজার টন ছাড়াবে। আর রমজানের আগে আরো জাহাজ আসার পথে আছে।
সেই তথ্য জানতে চাইলে মসুর ডালের দুই বড় আমদানিকারক সিটি গ্রুপ ও নাবিল গ্রুপের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা উদ্ধৃত হয়ে কথা বলতে চাননি।
দেশে মসুর ডালের মূল্যবৃদ্ধির কারণে মনে হতে পারে, আন্তর্জাতিক বাজারে এর দাম বেশি। কিন্তু বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন বলছে, মসুর ডালের দাম ক্রমাগত কমছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে মসুর ডালের আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কেনা দর ছিল টনপ্রতি ৫২১ মার্কিন ডলার। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে দাম কমে ৫১২ ডলারে নেমেছে। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে মসুর ডালের আন্তর্জাতিক দর ছিল ৫৭০ ডলার।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে কি মসুর ডালের আমদানিতে শুল্কহার বেশি। উত্তর হচ্ছে ‘না’। বর্তমানে মসুর ডাল আমদানিতে কোনো শুল্ককর নেই। একই সঙ্গে ঋণপত্র খুলতে বড় কোনো বাধার মুখে পড়েননি আমদানিকারকরা। তাহলে দাম বাড়ার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই।
সিটি গ্রুপের শীর্ষ এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এখন যে দাম বাড়ছে, সেটিকে বাড়ানো বলে না। আর এটা খুবই সাময়িক। দাম বাড়ার কোনো সুযোগ নেই। ঋণপত্র সংকটের মধ্যে আমাদের মতো বড় শিল্প গ্রুপগুলো অনেক চ্যালেঞ্জ নিয়ে মসুর ডাল আমদানি করেছে বলেই বাজারে মসুর ডাল আগেভাগেই পৌঁছে সরবরাহ সংকট তৈরি হয়নি। এখন দাম বাড়তি বড় বিষয় নয়; রমজানের আগে সঠিক সময়ে বাজারে সরবরাহ দেওয়াই মূল চ্যালেঞ্জ।’
জানতে চাইলে কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ চট্টগ্রামের প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন কালের কণ্ঠকে বলেন, ব্যবসায়ীদের দরকার একটি অজুহাত। আগে দাম বাড়িয়ে বিক্রি করেন, পরে যেনতেনভাবে একটি যুক্তি উপস্থাপন করেন। এখন তদারকি সংস্থার উচিত সেই ব্যবসায়ীরা যাতে অনৈতিক সুযোগ নিতে না পারেন।
সোর্স : কালের কন্ঠ