ফেসবুক, টিকটক, ইনস্টাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নারীর হয়রানি বেড়েছে। ভুক্তভোগী ৮৫ শতাংশ নারী এসব বিষয়ে নীরব থাকেন। ৯০ শতাংশের বেশি নারী মামলা করতে চান না।
পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন, ডিবি সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ, বেসরকারি সংস্থা অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ এবং বিভিন্ন সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনের তথ্য অনুযায়ী, এই বিভাগ প্রতিষ্ঠার পর গত দুই বছরে ২২ হাজার ৭৩২ জন নারী সাইবার স্পেসে হয়রানির বিষয়ে যোগাযোগ করেছেন। এর মধ্যে সাত হাজার ৫২৪ জন সব তথ্য জানাতে চাননি। সব ধরনের তথ্য দিয়ে সহায়তা করায় পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ১৪ হাজার ৫৫৭ জনের অভিযোগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। এখন ৬৫১ জনের অভিযোগ নিয়ে কাজ চলছে।
সাইবার অপরাধের কারণে সব বয়সী নারীর নিরাপত্তা কমে যাওয়ায় ২০২০ সালের নভেম্বর মাস থেকে পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন কাজ শুরু করে। তখন থেকে ফেসবুক পেজ, হটলাইন নম্বর ও ই-মেইলে অভিযোগ আসতে শুরু করে। শুরু থেকে ২০২২ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত পুলিশ সাইবার সাপোর্টের ফেসবুক পেজে মোট ২৯ হাজার ৭৮০টি মেসেজ, হটলাইন নম্বরে ৫৬ হাজার ২৬০টি ফোনকল এবং ই-মেইলে ৬৩৫টি অভিযোগ এসেছে।
পুলিশ সাইবার সাপোর্ট বলছে, হয়রানির শিকার নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৪৩ শতাংশকে ফেক আইডির মাধ্যমে ব্ল্যাকমেইল (অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলে ভয়ভীতি দেখানো) করা হয়। সংখ্যায় তাঁরা ৯ হাজার ৭১৪ জন। এ ছাড়া অন্য কৌশলে তিন হাজার ৭৬২ জন নারীকে ব্ল্যাকমেইল করা হয়। আইডি হ্যাকিংয়ের শিকার হয়েছেন দুই হাজার ৭৮২ জন নারী এবং আপত্তিকর কন্টেন্ট শেয়ারের মাধ্যমে দুই হাজার দুজন নারীকে হয়রানি করা হয়।
রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা সাদিয়া (ছদ্মনাম) ফেসবুকে ফেক আইডি থেকে হয়রানির শিকার হন। আইডি থেকে তাঁর ছবি এডিট করে বিভিন্ন পেজে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। মেসেঞ্জার চ্যাটেও অনবরত ছবি দিয়ে ব্ল্যাকমেইল চলতে থাকে। তবে এ বিষয়ে পুলিশে অভিযোগ করেননি তিনি।
কালের কণ্ঠকে সাদিয়া বলেন, ‘কী কারণে আমাকে এভাবে হয়রানি করা হয়েছে, ওই অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি কখনো জানায়নি। প্রায় দুই মাস ধরে হয়রানির শিকার হই। একপর্যায়ে নিজের আইডি ডি-অ্যাক্টিভেট করে দিই।’
পুলিশে অভিযোগ না করার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তখন মানসিকভাবে আমি অনেক ভেঙে পড়েছিলাম। বাইরে বের হলে মনে হতো, আমাকে কেউ অনুসরণ করছে। পুলিশে অভিযোগ দিলে কোনো প্রতিকার হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় ছিল। প্রচণ্ড ভয় হতো সব সময়। আমার মনে হয়েছিল, যত দ্রুত সম্ভব এটি বন্ধ করতে হবে।’ পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, ‘ইন্টারনেটে হয়রানির শিকার ৯০ শতাংশের বেশি নারী মামলা করতে চান না। পররর্তী সময়ে আমরা তাঁদের সাধারণ ডায়েরি (জিডি) বা মামলা করার জন্য বোঝানোর চেষ্টা করি। ভুক্তভোগীরা মূলত পরিবারকে বিষয়টি জানাতে চান না। পরিবার তাঁদের এ ব্যাপারে সমর্থন দেবে না বলে ধরে নেন তাঁরা। একই সঙ্গে ইন্টারনেটে নিরাপত্তা নিয়ে কোনো পরিষ্কার ধারণা না থাকায় সহজেই ফাঁদে পড়ছেন কিশোরী থেকে সব বয়সী নারী।’
পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ (উত্তর) জানায়, ২০২২ সালে সাইবার অপরাধ বিষয়ক মোট ১৭১টি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০.৪৬ শতাংশ পর্নোগ্রাফি এবং অনলাইনে হয়রানির অভিযোগে মামলা করা হয়েছে। ২৯.২৩ শতাংশ মামলা করা হয়েছে অনলাইনে প্রতারণার অভিযোগে। ২০২১ সালে মামলার সংখ্যা ছিল ২০৬টি, যা এ বছর কমেছে।
ডিবি-সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ তারেক বিন রশিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, অনলাইনে পর্নোগ্রাফি নিয়ে বেশি ভিকটিম আসে। এর মধ্যে পুরুষও আছে। পুরুষরা প্রতারণাসহ অ্যাকাউন্ট হ্যাকিংয়ের শিকার হচ্ছে।
অ্যাকশনএইডের পক্ষ থেকে ২০২২ সালের নভেম্বরে ইন্টারনেটে হয়রানি শিকার নারীদের নিয়ে ছয়টি জেলায় সমীক্ষা চালানো হয়। এসব জেলা হচ্ছে সাতক্ষীরা, সুনামগঞ্জ, পটুয়াখালী, বান্দরবান, কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট। অনলাইন জরিপের মাধ্যমে পরিচালিত এ সমীক্ষায় ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সী মোট ৩৫৯ জন নারী অংশ নেন।
সমীক্ষার ফলাফল থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ইন্টারনেটে হয়রানির শিকার ৮৫ শতাংশেরও বেশি নারী কোনো অভিযোগ না করে নীরব থাকেন। মাত্র ১৪.৯১ শতাংশ নারী অনলাইন হয়রানির বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা দেন।
অভিযোগকারীদের মধ্যে ৪৪.১২ শতাংশ সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে, ২০.৫৯ শতাংশ পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনের ফেসবুক পেজের মাধ্যমে, ১১.৭৬ শতাংশ জাতীয় জরুরি পরিষেবার (৯৯৯) মাধ্যমে, ১১.৭৬ শতাংশ নিকটস্থ থানায়, ৫.৮৮ শতাংশ সাইবার ক্রাইমের ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন, সিটিটিসি ও ডিএমপির মাধ্যমে অভিযোগ দায়ের করেছেন।
৬৩.৫১ শতাংশ নারী উত্তরদাতা বলেছেন, তাঁরা অনলাইন সহিংসতার শিকার হয়েছেন, অর্থাৎ প্রতি ১০০ জনের মধ্যে প্রায় ৬৪ জন নারীকে অনলাইন হয়রানি ও সহিংসতার সম্মুখীন হতে হয়েছে।
অ্যাকশনএইড জানায়, সামাজিকভাবে হেয় হওয়া এবং দোষ এসে পড়ার আশঙ্কা ও গোপনীয়তা হারানোর ভয়ে ৭৫.৭৭ শতাংশ নারী অনলাইনের মাধ্যমে বেনামে অভিযোগ করতে চান।
সাইবার অপরাধের বিরূপ প্রভাব : অ্যাকশনএইড জানায়, অনলাইন হয়রানি ও সহিংসতার কারণে নারীর জীবনে সবচেয়ে গুরুতর প্রভাব হলো মানসিক আঘাত, হতাশা ও উদ্বেগ, যা ৬৫.০৭ শতাংশ। ২৫.৩৩ শতাংশ ট্রমা বা মানসিক আঘাতের শিকার। ফেসবুকে আপত্তিকর ছবি ছড়িয়ে দেওয়ায় ২০২২ সালে স্কুল-কলেজের চার শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে বলে জানায় আঁচল ফাউন্ডেশন। তবে বাস্তবে এই সংখ্যা আরো বেশি, যা বেশির ভাগই অপ্রকাশিত থেকে যায়।
চাঁদপুরে গত ২৪ জানুয়ারি মোবাইল ফোনে ধারণ করা ছবি ও ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়ায় আঁখি (ছদ্মনাম) নামের এক স্কুলছাত্রী বিষপানে আত্মহত্যা করে। আঁখির পরিবার সূত্রে জানা যায়, প্রতিবেশী যুবক ছবি ও ভিডিও ধারণ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। তার পরিবারের এক সদস্য বলেন, ‘এ ঘটনায় আমাদের অজান্তে সে বিষ পান করে। পরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।’
অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতা নতুন কিছু নয়। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র—প্রতিটি ক্ষেত্রে নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এর নতুন এক মাধ্যম হলো অনলাইন। প্রযুক্তির যুগে এসে অনলাইনে নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে ১৮ বছরের নিচের কন্যাশিশুরা হয়রানির শিকার বেশি হচ্ছে। এটি রোধে ব্যাপক সচেতনতা বাড়াতে হবে এবং সরকারি ও বেসরকারি সব পর্যায়ে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তাহলে ইন্টারনেটে হয়রানি অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব।
সোর্স : কালের কন্ঠ