গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর পাচার হচ্ছে ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এসব টাকা পাচার হচ্ছে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও থাইল্যান্ডে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থপাচার মনিটরিং সংস্থা-বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বিআইএফইউর সা¤প্রতিক প্রতিবেদন এ তথ্য তুলে ধরে জানানো হয়, আমদানি-রফতানিসহ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কারসাজি আর হুন্ডির আড়ালে পাচারকারী সিন্ডিকেট এসব অর্থপাচার করছে। শুধু তাই নয়, সম্প্রতি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম খবর প্রকাশ করেছে, গত দেড় বছরে সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজধানী দুবাইয়ে বাংলাদেশিরা ৩৪৬ কোটি টাকার ফ্ল্যাট-বাড়ি কিনেছেন। দুবাইয়ের সরকারি নথিপত্র ও গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে ২০২০ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ২০২১ সালের জুন মাস পর্যন্ত বাংলাদেশিরা দুবাইয়ে ১২ কোটি ২৩ লাখ দিরহাম (৩৪৬ কোটি টাকা) বিনিয়োগ করে বাড়ি-ফ্ল্যাট কিনেছেন। এই বিপুল পরিমাণ টাকা পাচার হয়েছে কার্যত ডলার করেই। ফলে বাংলাদেশে গত কয়েক মাস থেকে ডলারের তীব্র সঙ্কট চলছে। ডলার সঙ্কটে ব্যাংকে আমদানির এলসি খোলা সীমিত হয়েছে, ব্যাংকে শিক্ষার্থীদের নতুন ফাইল খোলা বন্ধ করে দেয়াসহ নানা পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। কিন্তু ডলার সঙ্কটের সুরাহা হচ্ছে না। এই ডলার সঙ্কট তথা আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির অজুহাত দেখিয়ে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে। প্রতিটি পণ্যের হু হু করে দাম বাড়ছে। আর এই দাম বাড়ায় চরম মূল্য দিতে হচ্ছে খেটে খাওয়া মানুষ তথা পেশাজীবী, কর্মজীবীসহ সাধারণ মানুষকে। বাজারে সব পণ্যের দাম বেশি।
ডলার সঙ্কট ও গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিতে ক্রমবর্ধমান দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতিতে দেশের মধ্যবিত্ত সমাজ কার্যত নাজুক অবস্থায় পড়েছে। অনেকেই বলছেন মূল্যস্ফীতি না রোধ হলে এই শ্রেণির সংখ্যা কমে নি¤œবিত্তের সংখ্যা বেড়ে যাবে। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে মানবিক বিপর্যয় হতে পারে। খাদ্যপণ্যের এই উচ্চমূল্যের কারণে লাখ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়বে।
বাজারে সব পণ্যের দাম বেশি। ফলে সংসারে অর্থের যোগান দিতে মানুষকে জমানো পুঁজি ভেঙে খাদ্যপণ্য কিনতে হচ্ছে। যার কারণে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমে যাচ্ছে। সংসার চালাতে খাদ্যপণ্যের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষ সংসারের অন্যান্য খরচ তথা ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার টিউশনি পড়ানো, রিকশায় যাতায়াতের মতো গুরুত্বপূর্ণ খরচ সীমিত করে এনেছে। এ ছাড়াও দফায় দফায় গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়ায় শিল্পে উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। সেই উৎপাদন খরচ পণ্যে যোগ হয়ে ভোক্তাদের নিদারুণ দুর্দশায় ফেলে দিয়েছে। বিশেষ করে গত কয়েক দিনে দুই দফায় বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি, এক বছরে দুই দফায় গ্যাসের দাম বৃদ্ধি, জ্বালানির দাম বৃদ্ধিতে জ্বালানির আগুনে যেন মানুষ জ্বলছে। অথচ ডলারের অভাবে সরকার রেন্টাল, কুইক রেন্টাল থেকে যে ব্যক্তিমালিকানা কোম্পানি থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় করছে সে টাকা দিতে পারছে না। ফলে যে ব্যবসায়ীরা বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনা করছেন তারা বিদেশ থেকে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আনতে না পারায় তাদের জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনা দায় হয়ে গেছে।
বিদ্যুতের দাম নজিরবিহীন বৃদ্ধি : জানুয়ারি মাসে বিদ্যুতের খুচরা দাম দুইবার বাড়িয়ে দিয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। গত ৩০ জানুয়ারির প্রজ্ঞাপনে বিদ্যুতের পাইকারি দাম গড়ে ৮ শতাংশ এবং খুচরা দাম ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়। এর আগে গত ১২ জানুয়ারি ওই মাসের প্রথম দিন থেকে কার্যকর করে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছিল। তখনও খুচরা বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বেড়েছিল। এ দফায় মূল্যবৃদ্ধির বড় খড়গ পড়েছে হতদরিদ্র-প্রান্তিক মানুষের ওপর। এই লাইফ লাইন গ্রাহকদের জন্য বিদ্যুতের দাম বেড়েছে সবচেয়ে বেশি ৫ দশমিক ৪০ শতাংশ। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিতে কৃষিতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। চলতি বোরো মৌসুমের আগেই সার-বীজের দাম বেড়ে যাওয়ায় বোরো আবাদ নিয়ে এমনিতেই শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন কৃষকরা। এর মধ্যে কৃষির সেচে ব্যবহৃত বিদ্যুতের দাম দফায় দফায় বাড়ানো হয়। গত ১২ ডিসেম্বর ২১ পয়সা বাড়িয়ে ৪ টাকা ৩৭ পয়সা করা হয়েছিল। এবার আরো ২২ পয়সা বাড়িয়ে ৪ টাকা ৫৯ পয়সা করা হয়েছে। এই দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষি, শিল্প সব খাতে উৎপাদন খরচ বাড়বে। এর প্রভাবে পণ্যমূল্য আরো বেড়ে যাবে।
গ্যাসে উৎপাদন ব্যয় বাড়াবে : গত ১৮ জানুয়ারি বিদ্যুৎ ও শিল্প খাতের জন্য গ্যাসের দাম বাড়ানোয় বিদ্যুৎ ও শিল্প উৎপাদনে খরচ বাড়বে। গ্যাসের দাম নতুন করে বৃদ্ধির কারণে জ্বালানি গ্যাসের খরচ বাবদ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো এবং শিল্পকারখানাগুলোতে বছরে বাড়তি অন্তত ২৭ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা ব্যয় বেড়ে যাবে বলে বলা হচ্ছে। জ্বালানি খরচ বাড়ায় ছোট-বড় এবং মাঝারি আকারের শিল্পে উৎপাদিত পণ্য ও সেবার সার্বিক দাম বাড়বে। এর আগে ২০২২ সালের জুন মাসে দাম সিএনজি বাদে সব শ্রেণির গ্রাহকদের গ্যাসের দাম বাড়ানোর পর এ দফায় বিদ্যুৎ, শিল্পের নিজস্ব বিদ্যুৎ (ক্যাপটিভ), শিল্প এবং বাণিজ্যিক গ্রাহকদের জন্য দাম বাড়ানো হয়। সর্বশেষ প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৫ টাকা ২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৪ টাকা এবং ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ (শিল্প কারখানার নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র) খাতে গ্যাস প্রতি ঘনমিটারে দাম ১৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়াও বৃহৎ শিল্পে ১১ টাকা ৯৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা, মাঝারি শিল্পে ১১ টাকা ৭৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা এবং ক্ষুদ্র শিল্পে ১০ দশমিক ৭৮ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়েছে। আগে বড়, মাঝারি ও ছোট শিল্পের জন্য পৃথক মূল্যহার থাকলেও এবার তিন ধরনের শিল্পের জন্য গ্যাসের একই দর নির্ধারণ করা হয়। বাণিজ্যিক গ্যাস সংযোগে (হোটেল, রেস্টুরেন্ট, মার্কেট ও অন্যান্য) প্রতি ঘনমিটারের দাম ২৬ টাকা ৬৪ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়, যা সাধারণ মানুষের জীবনযাপনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। গ্যাসের দাম বৃদ্ধি প্রসঙ্গে ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, গ্যাস নিয়ে মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় জানা নেই। দেশে গ্যাসের সঙ্কটের সুরাহা না করে গ্যাসের দাম বিভিন্ন সময় বাড়ানো হচ্ছে।
এলপিজির নজিরবিহীন দাম বৃদ্ধি : ভোক্তা পর্যায়ে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম বৃদ্ধি করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। চলতি ফেব্রæয়ারি মাসের জন্য ১২ কেজির সিলিন্ডার গ্যাসের দাম ২৬৬ টাকা বাড়িয়ে ১৪৯৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। বাজারে রান্নার এই জ্বালানির সরবরাহ ঘাটতির মধ্যে এ দাম বাড়ানো হয়। এক মাসের ব্যবধানে গ্রাহক পর্যায়ে দুইবার বিদ্যুতের দাম ও একবার গ্যাসের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে যুক্ত হলো বাসাবাড়ি ও রেস্টুরেন্ট, দোকানে রান্নার গ্যাস এলপিজি এবং অন্যতম পরিবহন জ্বালানি অটোগ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি। বিদ্যুৎ-গ্যাসের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধির কারণে এ সেবাপণ্যগুলো কিনতে গ্রাহকের পকেট থেকে প্রতি মাসে সরাসরি বের হয়ে যাবে হাজার কোটি টাকা। একই সঙ্গে বিদ্যুৎ-গ্যাস-এলপিজির দাম বৃদ্ধির ফলে সংশ্লিষ্ট অন্য পণ্য ও সেবাগুলোর দামও বাড়বে।
সঞ্চয়পত্র ভাঙার হিড়িক : গ্যাস-বিদ্যুতের দাম ও পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাপন কঠিন হয়ে পড়ছে। মানুষ দিনের তিন বেলা খাবার থেকে এক বেলা কমিয়ে দুই বেলা খেয়েও সংসার চালাতে পারছে না। কেউ কেউ নানাভাবে ধার-দেনা, ঋণ, ছোট ছোট সম্পদ বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছে। আবার কেউ জমানো টাকা তুলে সংসারের খরচ নির্বাহ করছেন। অনেকেই সঞ্চয়পত্র ভেঙে খাচ্ছেন। ফলে আগের কেনা সঞ্চয়পত্র মেয়াদপূর্তির পর যে হারে ভাঙানো হচ্ছে, সেই হারে নতুন বিনিয়োগ বাড়ছে না। যার কারণে ছয় মাসে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ না বেড়ে কমেছে অর্থাৎ ঋণাত্মক (নেগেটিভ) প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
ডলারের সঙ্কট : আইএমএফের ঋণের প্রথম কিস্তি এলেও দেশের বাজারে ডলারের সঙ্কট কাটছে না। সঙ্কট আরো চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। এর প্রভাবে সৃষ্ট আর্থিক খাতের অস্থিরতা অন্য সব খাতেও ছড়িয়ে পড়ছে। ইতোমধ্যেই ডলার সঙ্কটের প্রভাব এবারের হজ পালনকারীদের ওপর পড়েছে। বিগত বছরের চেয়ে এবার হজযাত্রীদের কমপক্ষে দেড় লাখ টাকা করে বেশি খরচ হবে। এ ছাড়া ডলারে আমদানি মূল্য পরিশোধ করতে না পারায় চট্টগ্রাম বন্দরে আসা চিনি ও ভোজ্যতেল বোঝাই জাহাজ থেকে পণ্য খালাস করা যাচ্ছে না। ডলারের অভাবে ব্যাংক মূল্য পরিশোধ করতে পারেনি বলেই পণ্য খালাস করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন আমদানিকারকরা। এছাড়াও শিল্পের কাঁচামাল, জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ, চাল, সার, ছোলা, ভোজ্যতেলসহ জরুরি নিত্যপণ্য আমদানিতে এলসি (ঋণপত্র) খুলতে পারছে না ব্যাংকগুলো। সামনে পবিত্র রমজান মাস। অগ্রাধিকার খাতভুক্ত এসব পণ্য আমদানি বন্ধ হলে বা কমে গেলে দাম বৃদ্ধি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। শিল্পের উৎপাদনও বন্ধের উপক্রম হবে। এসব কিছুর প্রভাব পড়বে সাধারণ ভোক্তাদের ওপর। এমনিতেই আগে থেকেই নিত্যপণ্যের দাম বাড়তি থাকায় নাভিশ্বাস নিম্ন ও মধ্যবিত্তের পরিবারে।
পণ্যমূল্য বৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ প্রসঙ্গে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা ও তড়িৎ প্রকৌশলী অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, বারবার বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম বাড়ানো মানুষের ওপর এটি অন্যায্য চাপ। গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়েও পরিস্থিতি সামাল দেয়া যেত। সরকার গ্রাহকের কাঁধেই অতিরিক্ত খরচের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে নিস্তার পেতে চাইছে।
সোর্স : ইনকিলাব