গত বছরের ডলার সংকট নতুন বছরেও অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, নতুন বছরে ডলার সংকট কাটতে শুরু করবে। কিন্তু কোনো সমাধান দেখা যাচ্ছে না। ক্রাইসিস এমন পর্যায়ে চলে এসেছে বিলাসীপণ্য দূরে থাক, প্রয়োজনীয় পণ্যের এলসিও খোলা যাচ্ছে না। শিল্পের কাঁচামাল থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় অনেক পণ্যের আমদানি আটকে আছে। ফলে ডলারের সংকটে শিল্প খাত এখন ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে। নতুন করে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি সংকটকে আরও উসকে দিয়েছে। প্রভাব পড়তে শুরু করেছে দেশের প্রধান শিল্প ও উৎপাদন খাতে। এতে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে। অন্যদিকে কাঁচামাল সংকটের কারণে কারখানা পুরোদমে পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না।
বিজ্ঞাপন
ফলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে বাধ্য হয়ে উৎপাদন কমিয়ে দেয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, উৎপাদন কমে গেলে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ঋণ বিনিয়োগকারী ব্যাংকগুলোও ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। অনেকে ব্যাংকের ঋণের কিস্তি সময়মতো পরিশোধ করতে পারবেন না। বেকার হতে পারেন হাজার হাজার শ্রমিক-কর্মচারী। এদিকে, ডলার-সংকট, টাকার অবমূল্যায়ন ও আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে ছোট ও মাঝারি শিল্পের কাঁচামাল আমদানির এলসি খোলা ব্যাপক হারে কমেছে। অনেক প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন সক্ষমতাও কমে গেছে।
উদ্যোক্তারা বলছেন, ডলারের অভাবে তারা ব্যাংকে এলসি খুলতে পারছেন না। আমদানি মূল্য মেটাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। জ্বালানি ও গ্যাসের দাম দফায় দফায় বাড়ানোর কারণে তারা চাপের মধ্যে পড়েছেন। পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়বে। তারা বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী আমদানির জন্য শতভাগ টাকা দেয়া হলেও ব্যাংকগুলো ডলার দিতে পারছে না। এমনকি দেশীয় চাহিদা পূরণে যেসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান পণ্য উৎপাদন করে তারাও এলসি খুলতে পারছে না। জানা গেছে, ডলার সংকটের কারণে গত বছরের মাঝামাঝি আমদানির ওপরে বেশকিছু কড়াকড়ি আরোপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেইসঙ্গে পর্যাপ্ত ডলার না থাকার কারণে অনেক বাণিজ্যিক ব্যাংকও আমদানিতে লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) বা ঋণপত্র খুলতে পারছে না। এরফলে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন আমদানিকারকরা। আমদানি নির্ভর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে খাদ্যদ্রব্য থেকে শুরু করে যন্ত্রপাতি- বেশির ভাগ পণ্যই আমদানি করা হয়। এসব শিল্পের কাঁচামাল আমদানি করতে গিয়েও জটিলতার মুখোমুখি হচ্ছেন কারখানা মালিকরা। সেইসঙ্গে গ্যাস ও জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে বেড়েছে কারখানায় উৎপাদন খরচ, পরিবহন ও অন্যান্য খরচ। এ কারণে সংকটে পড়েছেন দেশীয় অনেক উৎপাদক প্রতিষ্ঠান।
এরফলে দেশীয় বাজারে পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে। সেইসঙ্গে কাঁচামাল আমদানি নিয়ে জটিলতায় উৎপাদন অব্যাহত রাখাও তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ছে। বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, ডলার পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। সব সেক্টরই ডলার সংকটের কারণে এলসি খুলতে সমস্যায় পড়ছে। অনেকেই চাহিদার চেয়ে কম কাঁচামাল এলসির মাধ্যমে আনতে পারছেন। ফলে উৎপাদন আগের চেয়ে অনেক কমে যাচ্ছে। বিশেষ করে যারা আমদানির ওপর নির্ভর করে দেশে পণ্য সরবরাহ করেন তারা সবচেয়ে বেশি সংকটে রয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, দেশে ডলারের সংকট ও বৈশ্বিক বাণিজ্যিক অস্থিরতার কারণে ক্যাপিটাল মেশিনারি, শিল্পের কাঁচামাল, ইন্টারমিডিয়েট গুডস (শিল্পের কাঁচামাল) ও কনজ্যুমার গুডস তথা ভোগ্যপণ্য আমদানির ব্যাপক পতন হয়েছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ক্যাপিটাল মেশিনারির আমদানি দাঁড়ায় ১.২৭ বিলিয়ন ডলারে, যা ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ে হয়েছিল ৩.৬৭ বিলিয়ন ডলারের। একইসঙ্গে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে ভোগ্যপণ্য ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানি হয়েছে যথাক্রমে ৪.১২ ও ১.২০ বিলিয়ন ডলার। যা ২০২১-২২ অর্থবছরে ক্রমান্বয়ে ছিল ৪.৬৯ ও ১.৬৫ বিলিয়ন ডলার। এদিকে চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরের মধ্যে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি হয়েছে ২.৫৮ বিলিয়ন ডলার।
যা আগের বছরে একই সময়ে ছিল ৩.৮৭ বিলিয়ন ডলার। সে হিসেবে চলতি অর্থবছরের এ সময়ে আমদানি কমেছে ৩৩.১৮ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন মতে, ব্যাক টু ব্যাক এলসির আওতায় রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল আমদানি করতে গত অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে ৬৬৯ কোটি ২০ লাখ ডলারের এলসি খোলা হয়। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে এলসি খোলা হয় ৪৪৯ কোটি ৫৫ লাখ ডলারের। এ সময়ে এলসি খোলা কমেছে ৩২.৮২ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে এসব খাতের কাঁচামাল আমদানি করা হয় ৫৪২ কোটি ৬৬ লাখ ডলারের। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি করা হয় ৫৩৩ কোটি ৭০ লাখ ডলারের পণ্য। এ সময়ে আমদানি কমেছে ১ দশমিক ৬৫ শতাংশ। তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, রপ্তানিমুখী ও বাণিজ্যিকভাবে কাপড় আমদানির এলসি খোলা কমেছে ২৫.৬৩ শতাংশ, আমদানি কমেছে ৫.৬৯ শতাংশ। প্রাইমারি টেক্সটাইলের প্রধান কাঁচামাল তুলা আমদানির এলসি খোলা কমেছে ৪১.৬৪ শতাংশ। সুতা আমদানির এলসি খোলা কমেছে ৫৮.৪৫ শতাংশ, আমদানি কমেছে ২৬.৮৫ শতাংশ। প্লাস্টিকের তৈরি সুতা আমদানির এলসি খোলা কমেছে ৬২.৭২ শতাংশ ও আমদানি কমেছে ২৬.৫১ শতাংশ। সিনথেটিক ফাইবার ও ইয়ার্ন আমদানির এলসি খোলা কমেছে ৪৮.১০ শতাংশ এবং আমদানি কমেছে ১৪.৪৭ শতাংশ। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস এসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) পরিচালক মাসুদ রানা বলেন, কিছু ব্যাংক শিল্পের চাহিদার বিপরীতে মাত্র ৩০-৫০ শতাংশ এলসি খুলছে। অর্থাৎ কারখানায় ১০০ টাকা কাঁচামাল লাগলে ৩০-৫০ টাকার এলসি খোলা হচ্ছে।
এতে মেশিনের সক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন করা যাচ্ছে না। সূত্র জানায়, বর্তমানে বাংলাদেশের প্রয়োজনীয় ওষুধের ৯৮ শতাংশ দেশেই উৎপাদন করা হচ্ছে। এই শিল্পের কাঁচামালের ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ ভাগ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। প্রতিবছর এই খাতে ১.৩ বিলিয়ন ডলারের কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। একটি ওষুধ প্রস্ততকারক প্রতিষ্ঠানের মতে, অনেক কোম্পানি সময়মতো কাঁচামাল আমদানি করতে পারছে না। এমনকি হান্ড্রেড পার্সেন্ট মার্জিন দেয়ার পরও এলসি খোলা যাচ্ছে না। বাংলাদেশে গাড়ির ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ থেকে শুরু করে কৃষি ও নির্মাণকাজের যন্ত্রপাতি, প্লাস্টিক পণ্যের ছাঁচ, নাট-বল্টু, বেয়ারিং ইত্যাদি অনেক এখন দেশেই তৈরি করা হয়। এই শিল্পও সংকটের মুখোমুখি। বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি আবদুর রাজ্জাকের মতে, ঋণপত্র খুলতে না পারার কারণে অনেকেই কারখানা বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছে। এর আগে গত আগস্টে ডিজেল, কেরোসিন, পেট্রোল ও অকটেনের দাম এক লাফে লিটারে ৩৪ থেকে ৪৬ টাকা বৃদ্ধি করে জ্বালানি বিভাগ।
এরপর গত ১২ই জানুয়ারি বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়। আর গত ১৮ই জানুয়ারি সার ও চা-শিল্প ছাড়া অন্য সব শিল্পের জন্য গ্যাসের প্রতি ইউনিটের দাম ৩০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। সেই রেশ না কাটতেই ৩০শে জানুয়ারি আবারও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয়া হয়। নিট পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, দফায় দফায় গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণে শিল্পকারখানার লোকসানের পরিমাণ বাড়বে। কেপিসি ইন্ডাস্ট্রিজের স্বত্বাধিকারী কাজী সাজেদুর রহমান বলেন, এমনিতেই ব্যবসার পরিস্থিতি খারাপ। ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে কাঁচামাল আমদানির ব্যয় বেড়ে গেছে। ইতিমধ্যেই ৩০ শতাংশ কর্মী ছাঁটাই করতে হয়েছে। এখন দু’দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ায় লোকসান আরও বাড়বে। শাহরিয়ার স্টিল কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মাসাদুল আলম বলেন, গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ফলে শিগগিরই হয়তো প্রতি টন রডের দাম এক লাখ টাকা ছাড়িয়ে যাবে। অযৌক্তিকভাবে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ালে ব্যবসায়ীদের ব্যবসা গুটিয়ে নেয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।
সোর্স : মানবজমিন