পেট্রোবাংলার দূরদর্শী পরিকল্পনার অভাবে দেশে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ার পরিবর্তে দিন দিন কমছে। অনুসন্ধান ও উত্তোলনে জোর না দেওয়ায় গত তিন বছরের হিসাবে দেশীয় গ্যাসের সরবরাহ প্রতিদিন ৫০ কোটি ঘনফুট কমেছে। গত জুলাই থেকে আমদানি করা তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) সরবরাহও কমেছে দিনে ৫০ কোটি ঘনফুট। শিল্পকারখানা ও বাসাবাড়িতে সংকট তীব্র হলেও গত জুন মাসে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয় ২৩ শতাংশ। সাত মাসের ব্যবধানে ১৮ জানুয়ারি আবারও গ্যাসের মূল্য বাড়ল রেকর্ড ৮২ শতাংশ। মূলত পেট্রোবাংলার দূরদর্শী পরিকল্পনার অভাবেই গ্যাস উৎপাদন কমছে, বাড়ছে আমদানি। ভোক্তা পর্যায়ে ঘন ঘন বাড়ছে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম। এর প্রভাবে দ্রব্যমূল্যের কশাঘাতে জর্জরিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ।
সূত্র জানায়, গ্যাসের ঘাটতি মোকাবিলায় এলএনজি আমদানি বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে পেট্রোবাংলা। কিন্তু এলএনজি প্রক্রিয়াকরণ অবকাঠামো নির্মাণের উদ্যোগ ঝুলে আছে দীর্ঘদিন ধরে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাত বছর পর সমুদ্রে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানে বহুমাত্রিক জরিপ (মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভে) কাজ শুরু হচ্ছে চলতি বছর। দীর্ঘদিন আটকে থাকা সাগরের ব্লক ইজারায় আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান কার্যক্রমে এখন একটু গতি এসেছে। এসব কার্যক্রমের সুফল পেতে অপেক্ষা করতে হবে আরও পাঁচ-সাত বছর।
এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের শিক্ষক অধ্যাপক ম তামিম বলেন, ‘দেশে গ্যাসের ঘাটতি বাড়বে, তা পেট্রোবাংলার হিসাবেই বলা হয়েছে। এজন্য এলএনজির আমদানি বাড়বে, এটাও তাদের তথ্য। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সংস্থাটি বাস্তবসম্মত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। গ্যাসক্ষেত্রগুলো ব্যবস্থাপনায় কার্যকর উদ্যোগ ছিল না। স্থলভাগে অনুসন্ধান নেই। সাগরেও কাজ হচ্ছে না। সহসা এই সংকট কাটবে বলে মনে হয় না। কারণ, এখন একটা উদ্যোগ নিলেও তার সুফল পেতে কয়েক বছর লাগবে।’
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, ‘জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করছে। ২০২৫ সালের মধ্যে পেট্রোবাংলা মোট ৪৬টি অনুসন্ধান, উন্নয়ন ও ওয়ার্কওভার কূপ খননের পরিকল্পনা নিয়েছে। স্থল ও সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। পাশাপাশি কাতার, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ব্রুনাইসহ গ্যাস ও তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর সঙ্গে দীর্ঘ ও স্বল্পমেয়াদি চুক্তির প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। স্থলভাগে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে।’
সাগরের অনুসন্ধান: বঙ্গোপসাগরে বিভিন্ন সময় একাধিক বিদেশি কোম্পানি অনুসন্ধান করলেও এখনও কোনো সফলতা আসেনি। সমুদ্রের একমাত্র গ্যাসক্ষেত্র সাঙ্গু বন্ধ হয়ে গেছে প্রায় এক দশক আগে। এখন মাত্র দুটি ব্লকে ভারতীয় দুটি কোম্পানি যৌথভাবে কাজ করছে। তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানে বাংলাদেশের সাগর এলাকাকে অগভীর ও গভীর মোট ২৬টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে অগভীর অংশে ব্লক ১১টি। আর গভীর সমুদ্রে ব্লক ১৫টি। সাগরের ২৪টি ব্লক এখন উন্মুক্ত। অর্থাৎ এখানে কোনো অনুসন্ধান কাজ হচ্ছে না। এসব ব্লকে ইজারার জন্য মডেল পিএসসি (উৎপাদন-অংশীদারিত্ব চুক্তি) সংশোধন করে পেট্রোবাংলা। বিদেশি কোম্পানির জন্য বাড়ানো হয় গ্যাসের দাম। কিন্তু গত দুই বছর ধরে দরপত্র আহ্বান করা হয়নি। সম্প্রতি মডেল পিএসসি আবার সংশোধন করা হয়েছে। গ্যাসের দাম বাড়িয়ে প্রতি ইউনিট ১০ ডলার করা হয়েছে। আগামী দুই-এক মাসে দরপত্র ডাকা হতে পারে বলে জানিয়েছে পেট্রোবাংলা।
সংশ্নিষ্টরা বলছেন, এখন পিএসসিতে ঠিকই গ্যাসের দাম বাড়ানো হলো। এই উদ্যোগ আরও কয়েক বছর আগে নিলে এখন সুফল মিলত। তাঁরা জানান, যুক্তরাষ্ট্রের কনোকো ফিলিপস গভীর সমুদ্রের ১০ ও ১১ নম্বর ব্লকে দ্বিমাত্রিক জরিপে বড় ধরনের গ্যাস মজুতের সম্ভাবনার কথা জানিয়েছিল। এর পর আরও বিনিয়োগের আগে তারা চুক্তি সংশোধন করে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব দেয়। কিন্তু তাতে পেট্রোবাংলা রাজি না হওয়ায় কনোকো ব্লক দুটি ছেড়ে চলে যায়।
গত সাত বছর ধরে দেশের সমুদ্রসীমায় একটি পূর্ণাঙ্গ বহুমাত্রিক জরিপ শুরু করতে পারেনি পেট্রোবাংলা। এই কাজ করার জন্য ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়। নানা বাধা পেরিয়ে ২০২০ সালের মার্চে টিজিএস ও স্কামবার্জার কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে চূড়ান্ত চুক্তি করে পেট্রোবাংলা। এর পর দুই বছর পর আগামী ফেব্রুয়ারি থেকে কাজ শুরুর কথা জানিয়েছে কনসোর্টিয়ামটি। কেনা হয়নি পৃথক জরিপ জাহাজও। পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার ও ভারত বঙ্গোপসাগর থেকে বিপুল পরিমাণে গ্যাস আবিস্কার করলেও বাংলাদেশ এখনও জানতেই পারেনি তার সমুদ্রের তলে কী সম্পদ লুকিয়ে আছে।
স্থলভাগেও অনুসন্ধান ঢিমেতালে: গত ৫০ বছরে মাত্র ৬৮টি অনুসন্ধান কূপ খনন করেছে পেট্রোবাংলা। একই সময়ে শুধু ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যেই ১৬০টি অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয়েছে। গত ১২ বছরে ২০টি অনুসন্ধান কূপ খনন করে চারটি নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিস্কৃত হয়েছে। এর মধ্যে বলার মতো মজুত রয়েছে শুধু ভোলা নর্থ গ্যাসক্ষেত্রে। সম্প্রতি কয়েকটি উন্নয়ন ও ওয়ার্কওভার কূপ থেকে গ্যাস প্রাপ্তির খবর দিয়েছে পেট্রোবাংলা। তবে এগুলো থেকে গ্যাস প্রাপ্তির হার খুবই কম।
এলএনজিতেও পিছিয়ে: ২০১৮ সালে দেশে এলএনজি আমদানি শুরু হয়। বর্তমানে দেশের চাহিদার ২২ শতাংশ মেটানো হচ্ছে আমদানি করা গ্যাসে। পেট্রোবাংলার পরিকল্পনায় দেখা যায়, ২০২৫ সালে চাহিদার ৬০ শতাংশ এলএনজি আমদানি করে পূরণ করতে হবে। ২০২৫ সালে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা বেড়ে হবে ৪৪০ কোটি ঘনফুট। নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিস্কৃত না হলে নিজস্ব উৎপাদন কমে হবে ১৮০ কোটি ঘনফুট। ঘাটতি দাঁড়াবে ২৬০ কোটি ঘনফুট। এজন্য সরকার আমদানির জন্য দেশে আরও এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু এই উদ্যোগও যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এলএনজি প্রক্রিয়াকরণের অবকাঠামো প্রস্তুত না থাকলে বাড়তি চাহিদা পূরণে গ্যাস আমদানিও করা যাবে না।
কাতার ও ওমান থেকে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে এলএনজি আনছে সরকার। কাতার চুক্তি সম্প্রসারণের আগ্রহ দেখালেও বাংলাদেশ তাতে এখনও সাড়া দেয়নি। বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানি এলএনজি সরবরাহের বিষয়ে আগ্রহ দেখালেও সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। পিছিয়ে আছে এলএনজির অবকাঠামো নির্মাণও। বর্তমানে মহেশখালীতে দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল আছে। এখান থেকে দিনে গ্যাস সরবরাহ ক্ষমতা সর্বোচ্চ ৯০ কোটি ঘনফুট। আগামীতে এলএনজির আমদানি যদি বাড়ে তা প্রক্রিয়াকরণের পর্যাপ্ত অবকাঠামো নেই দেশে। পায়রা বন্দরের আশপাশে একটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা আছে। কিন্তু এটি বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। কক্সবাজারের মাতারবাড়ী এলাকায় ল্যান্ডবেজড এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ চার-পাঁচ বছর ধরে আলাপ-আলোচনার মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। দুই দফা দরপত্র ডেকেও এই প্রকল্প এগিয়ে নেওয়া যায়নি। স্থান নির্ধারণের কাজ এখনও চূড়ান্ত হয়নি। সর্বশেষ ২৩ জানুয়ারি এ নিয়ে জ্বালানি বিভাগে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ভারতের একটি কোম্পানির এলএনজি সরবরাহের প্রস্তাবও আলোচনার মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে তিন-চার বছর ধরে।
উৎপাদন কমছে অবহেলায়: দেশে এখন গ্যাস উৎপাদন করছে দুটি বিদেশি ও তিনটি দেশীয় কোম্পানি। এর মধ্যে শুধু সিলেট গ্যাস ফিল্ডেই (এসজিএফএল) দৈনিক উৎপাদন ১৫ কোটি ঘনফুট থেকে কমে সাড়ে ৮ কোটি ঘনফুটে নেমেছে। অন্যান্য দেশীয় কোম্পানির অবস্থাও একই রকম। এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম তামিম বলেন, দেশে গ্যাস অনুসন্ধানে যেমন উদ্যোগ নেই, তেমনি কূপ সংস্কার ও ব্যবস্থাপনাতেও রয়েছে অবহেলা। পেট্রোবাংলা জানত কূপগুলোর উৎপাদন কমবে। কিন্তু এ বিষয়ে সংস্থাটির অবহেলা চোখে পড়ার মতো। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারেও রয়েছে তাদের অনীহা। তিনি বলেন, নাইকোর সঙ্গে বিরোধ মেটার কয়েক বছর পার হয়েছে। কিন্তু এখনও ছাতক থেকে গ্যাস উত্তোলনের কোনো উদ্যোগ নেই। এখান থেকে দিনে ১৫ কোটি ঘনফুট গাস মিলতে পারে বলে তিনি জানান।
খরচের ভার জনগণের ঘাড়ে: অতিরিক্ত দামে আমদানি করায় গ্যাসের দাম ঘন ঘন বাড়াচ্ছে সরকার। দেশে উৎপাদন বাড়ানো গেলে দাম বাড়ত না। ভর্তুকির চাপ সামলাতে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম গ্রাহক পর্যায়ে বাড়ানো হচ্ছে বারবার।
এ বিষয়ে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, কমিশন বাণিজ্যের জন্য অনুসন্ধানে জোর না দিয়ে এলএনজি আমদানির দিকে ঝোঁক বেশি সরকারের।
সোর্স : সমকাল