খুলনায় অপহরণের পর গলায় রশি পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র নীরব মÐলকে হত্যা করে তার সহকর্মীরা। এ হত্যাকান্ডের ঘটনায় পুলিশ একই স্কুলের পাঁচ ছাত্রকে গ্রেফতার করে যারা ভারতীয় ক্রাইম পেট্রোল সিরিয়াল দেখে ৩০ লাখ টাকা মুক্তিপণের দাবিতে অপহরণের পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু নীরবকে অজ্ঞান করতে গিয়ে গত বৃহস্পতিবার ২ ফেব্রæয়ারি খুন করে ফেলে ওই স্কুল ছাত্ররা। এভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুল ছাত্রসহ কিশোর-যুবকরা ভারতীয় টিভি সিরিয়াল দেখে অভিনব কায়দায় খুন, ডাকাতি ও ছিনতাইসহ নানা অপরাধে জড়াচ্ছে। ভারতের বাংলা চ্যানেল জি বাংলা, স্টার জলসা, ইটিভি, হিন্দি চ্যানেল জিটিভি এবং স্টার প্লাস সর্বাধিক সিরিয়াল দেখে অনেকের সংসারও ভাঙছে।
রাজধানীর সবুজবাগের বাসিন্দা ব্যবসায়ী মনিরুল আলম। স্ত্রী, দু’ছেলে-মেয়ে নিয়ে ভালই চলছিলো তাদের সংসার। কিন্তু মনিরুল ব্যবসায়ী কাজে বাইরে থাকার সময় ভারতীয় টিভি সিরিয়াল জি বাংলা আর স্টার জলসা দেখেই সময় কাটান তার স্ত্রী। ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার দিকে নজর দেয়ার সময় নেই তার। এ নিয়ে প্রথম দিকে কথা কাটাকাটি এক পর্যায়ে ছাড়াছাড়িতে রূপ নেয়।
ব্যবসায়ী মনিরুল আলম ইনকিলাবকে বলেন, আমার স্ত্রীর কাছে ভারতীয় টিভি সিরিয়াল ছিল মারাত্মক নেশার মত। কোনভাবেই এ নেশা ছাড়ানো যাচ্ছিল না। সে এখন আলাদা থাকছে। এর বাইরে নিজের পরিবার নিয়ে কিছু বলতে চাই না বলে মন্তব্য করেন তিনি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজধানীর খিলগাঁওয়ের একজন বাসিন্দা ইনকিলাবকে বলেন, ভারতীয় চ্যানেলগুলোর প্রতি আসক্ত দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে ঘরে ঘরে মহিলারা যেন মাদকের মতো আসক্ত হয়ে পড়ছেন ভারতীয় চ্যানেলের প্রতি। এর কুপ্রভাব পড়তে শুরু করেছে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সমাজ সভ্যতার ওপর। ভারতের ফেনসিডিল আগ্রাসনে যুব সমাজ শেষ হবার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হবার পর এবার ঐ দেশের টিভি সিরিয়ালের আগ্রাসনে রীতিমতো মগজ ধোলাই হতে চলেছে এই জাতির। মুসলিম জন্ম পরিচয় আর নামে আমরা যতই মুসলমান হই না কেন-চলনে, বলনে, কথনে, মননে আমরা হবো ভারতীয় সংস্কৃতির ধারক এবং বাহক হয়ে যাচ্ছি। নিজস্ব স্বকীয়তা বলতে আমাদের কিছু থাকবে না।
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, যেহেতু বাংলাদেশের শিক্ষিত-অশিক্ষিত অনেক মানুষ এখন মন্ত্রমুগ্ধের মতো টিভি সেটের সামনে রিমোট হাতে বসে ভারতীয় হিন্দী, বাংলা সিরিয়াল দেখতে থাকেন, তাই একই বিষয় বারবার দেখতে দেখতে তাদের মনোজগতে বিষয়গুলো এমনভাবে গেঁথে যায় যে, তারা নিজেদের অজান্তেই অর্থাৎ নারীদের অবচেতন মনেই বিষয়গুলো নিজ দায়িত্বে জায়গা করে নেয়। এবং তারা এগুলোকে যাপিত জীবনে ব্যবহার করে (যদিও খুব একটা সচেতন জায়গা থেকে নয়)।
তারা বলছেন, ভারতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এতই প্রকট আকার ধারণ করেছে যে, কোন প্রতিষেধকই এখন আর কাজ করছে না। অভিজাত শ্রেণী থেকে শুরু করে একেবারেই উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত পরিবার, বয়স্ক থেকে শিশু পর্যন্ত সবাই এই মহাব্যাধিতে নিমজ্জিত। আমাদের বাচ্চারা এখন মায়ের ভাষা বাংলা শিখার আগেই হিন্দিতে কথা বলা রপ্ত করে ফেলছে। আর এটি হচ্ছে ভারতীয় চ্যানেলগুলোর কারণে। তাই যার যার অবস্থান থেকে দীঘর্মেয়াদী ক্ষতিকর মানসিকতার ভারতীয় নাটক পরিহার করে দেশীয় সংস্কৃতির লালন ও বিকাশে এগিয়ে আসা প্রয়োজন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, অবাধ আকাশ সাংস্কৃতির মাধ্যমে বাংলাদেশে ঢালাওভাবে ভারতীয় সাংস্কৃতি প্রবেশ করছে। ভারতীয় সিনেমা, নাটক ও কিছু সিরিয়াল আমাদের দেশের সাংস্কৃতির সাথে যায় না। মানুষ সাধারণ খারাপের দিকে আকৃষ্ট হয় বেশি। তাই ভারতীয় নাটক, সিনেমা ও সিরিয়ালের বিষয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে মনিটরিং করা উচিত। আমরা ভালটা গ্রহণ করবো এবং যেটা ভাল নয় সেটা নিয়ন্ত্রণ করবো। অন্যতায় এ ধরনের সিরিয়াল দেখে দেশের কিছু মানুষ বিপদগামী হবে। রাষ্ট্রকে এজন্য দ্রæত ভাবতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
গত ১১ জানুয়ারি পাবনার বড় বাজার এলাকায় কোচিং সেন্টারের শিক্ষক পরিচয় দিয়ে একটি বাসায় ঢুকে গৃহবধুর হাত-পা বেঁধে ৭২ হাজার টাকা ও ৪ ভরি স্বর্ণালংকার নিয়ে পালিয়ে যান মো. লিখন হাসান (২৪), মোহাম্মদ আব্দুল্লাহিল বাকী অনিক (২২) ও মো. আবুল বাশার (২১)। পরে তথ্য প্রযুক্তি ও সিটিটিভির ফুজে পর্যালোচনা করে তাদের গ্রেফতার করা হয়। এসময় তাদের কাছ থেকে নগদ ৩১ হাজার টাকা, ৪ ভরি স্বর্ণালঙ্কার ও আসামিদের ব্যবহৃত ৪টি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। এদের মধ্যে লিখন পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। অনিক পাবনার সরকারি অ্যাডওয়ার্ড কলেজের ইংরেজি দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী এবং বাশার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য ফোকাস কোচিং-এ অধ্যায়নরত।
তাদের জিজ্ঞাসাবাদের পর পাবনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) মাসুদ আলম সাংবাদিকদের জানান, তারা ভারতীয় টিভি শো ক্রাইম পেট্রোল থেকে অভিনব কায়দায় অপরাধ করার কৌশল শিখেছে। তারা অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও আইটি বিষয়ে অভিজ্ঞ। তারা আরও অনেক বাসায় একই কায়দায় ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল।
সোর্স : ইনকিলাব