দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দেশের মানুষ যখন হিমশিম খাচ্ছে, তখন গ্যাস ও বিদ্যুতের অতিরিক্ত দাম নিয়ে সংসারের হিসাব সমন্বয় করতে তারা গলদঘর্ম হচ্ছেন। রাজধানীর অনেক এলাকায় ভোরে সূর্য ওঠার আগেই গ্যাস চলে যায়। এ চিত্র রাজধানীর বেশির ভাগএলাকায়। রমজান মাস আসতে এখনো প্রায় দেড় মাস বাকি। অথচ এখনো গৃহিনীদের সেহরির সময় রান্না করতে হয়। গত একবছরে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, বহু পরিবারে শুধু বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিল বাবদ খরচ ২০ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন নি¤œবিত্ত, মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। জিনিসপত্রের এরকম মূল্যবৃদ্ধি তাদের জীবনযাপন কঠিন করে তুলেছে বলে জানিয়েছেন রাজধানীর ও গ্রামের বাসিন্দারা।
জানুয়ারি মাসে এক দফা বাড়ানোর পর ফেব্রæয়ারির এক তারিখ থেকেই আরেক দফা বাড়ছে বিদ্যুতের দাম। ফলে শুধু আবাসিক বিদ্যুৎ বাবদ মাসিক খরচ ১০ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। এদিকে ভোক্তা পর্যায়ে সরবরাহকৃত ১২ কেজি তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) সিলিন্ডারের দাম এক লাফে ২৬৬ টাকা বাড়িয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। চলতি মাসের জন্য প্রতি সিলিন্ডার এলপিজির দাম ১ হাজার ৪৯৮ টাকা নির্ধারণ করেছে কমিশন, যা গত মাসে ছিল ১ হাজার ২৩২ টাকা। এ অনুযায়ী এলপিজির দাম বেড়েছে গত মাসের তুলনায় ২১ দশমিক ৫৯ শতাংশ। একই সঙ্গে গাড়িতে ব্যবহূত অটোগ্যাসের দাম লিটারপ্রতি ১২ টাকা ৩০ পয়সা বাড়ানো হয়েছে। ফেব্রæয়ারির জন্য প্রতি লিটার অটোগ্যাসের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৬৯ টাকা ৭১ পয়সা, যা গত মাসে ছিল ৫৭ টাকা ৪১ পয়সা। বিইআরসি গত বৃহস্পতিবার এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ফেব্রæয়ারির জন্য এলপিজি সিলিন্ডার ও গাড়িতে ব্যবহূত অটোগ্যাসের এ নতুন দাম ঘোষণা করে। বিজ্ঞপ্তিতে ঘোষিত নতুন মূল্যতালিকা গত সপ্তাহে সন্ধ্যা থেকে কার্যকর হওয়ার কথা জানানো হয়।
রাজধানীতে গ্যাস সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। আর এই কারণে নগরবাসী রান্নাবান্না নিয়ে পড়েছেন চরম বিপাকে। কিছু কিছু এলাকায় গত কয়েক মাস ধরেই এ সংকট চলছে। এসব এলাকার বাসিন্দারা দিনের বেলা রান্নাবান্না করেন সিলিন্ডারের গ্যাসে। আর রাতে লাইনের গ্যাসে। কোথাও কোথাও ভোর ৬টার আগেই গ্যাস চলে যায়। কোথাও দুপুরে আবার কোথাও রাতে আসে। নগরীর কোথাও গ্যাসের দেখা মিললেও দু’-তিন ঘণ্টার মধ্যে আবার চলে যাওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এদিকে বিদ্যুৎ-গ্যাসের বিল নিয়ে দিশেহারা মানুষ, দাম কোথায় গিয়ে ঠেকবে সেটি নিয়ে চিন্তা, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের ওপর আর্থিক চাপ অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
ফলে এক বেলা রান্না করে তিন বেলা খেতে হচ্ছে অনেক পরিবারকেই। অনেক গৃহিণী আবার গভীর রাতে রান্নার কাজ শেষ করে রাখেন। তীক্র গ্যাস সংকটে পাড়া-মহল্লার হোটেল থেকে অনেকে খাবার কিনে খাচ্ছেন। সরজমিন বিভিন্ন এলাকা ঘুরে গ্রাহকদের এ দুর্ভোগের চিত্র পাওয়া গেলেও কর্তৃপক্ষ বলছে এই মুহূর্তে গ্যাসের কোনো সংকট নেই। গ্যাস না থাকার কথা না।
গতকাল রোববার রাজধানীর লালমাটিয়া, মোহাম্মদপুর, বসিলা, শ্যামলী, দারুস সালাম, মিরপুরের-১ নম্বরের বিভিন্ন বøক, রাইনখোলা, গুদারাঘাট, জনতা হাউজিং, দক্ষিণ পীরের বাগ, শেওড়াপাড়ার ইকবাল রোড, মিরপুর-১৪, তালতলা, শুক্রাবাদ, ধানমÐির নর্থ সার্কুলার রোড, রামপুরা মহানগর প্রজেক্ট, মতিঝিলের আরামবাগ, পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার, খিলগাঁওয়ের গোড়ান, লালবাগ, আজিমপুর, কামরাঙ্গীরচর, গনকটুলী, যাত্রবাড়ী, কিছু কিছু এলাকায় গ্যাসের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া রাজধানীর উত্তরার উত্তরখান, দক্ষিণখানের ফায়দাবাদ, চৈতি, ওয়াপদা রোড, গোয়ালটেক এলাকায় শুধু রাতের বেলা গ্যাস পাওয়া যায় বলে অভিযোগ এলাকার বাসিন্দাদের। এ এলাকার মানুষের এখন দিনের বেলার রান্নার ভরসা সিলিন্ডার।
তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌ. মো. হারুনুর রশীদ মোল্লাহ ইনকিলাবকে বলেন, গ্যাসের অবস্থা সব জায়গায় একই রবম আছে। তবে চলতি মাসের শেষের দিকে পেট্রোবাংলা থেকে কিছু গ্যাস পাওয়া যাবে। তখন হয়তো কিছুটা স্বাভাবিক হবে।
রাজধানীর শ্যামলী এলাকার বাসিন্দার খাতিজা আক্তার ইনকিলাবকে বলেন, মাত্র এক সপ্তাহ আগেও ১২ কেজির যে এলপিজি গ্যাসের সিলিন্ডার তিনি ১৩০০ টাকা দিয়ে কিনেছেন, দুইদিন আগে সেটাই তাকে কিনতে হয়েছে ১৭০০ টাকা দরে। কোন কারণ বুঝতে পারছি না। সরকারের নির্ধারিত দাম আছে তেরশোর নিচে, তাও সেটা দিতাম। এখন দোকানদাররা বলছে, ১৭০০ টাকার নিচে সিলিন্ডার নেই। মোহাম্মদপুরের বসিলার গৃহিণী ও সরকারি চাকরিজীবী ফাতেমা বেগম বলেন, গ্যাস সংকটের কারণে পরিবারের সদস্যদেরও বাসার খাবার খেতে পারছেন না বেশ কয়েকদিন ধরে। অনেক সময় ভোর রাতেই খাবার রান্নাবান্না করতে হয়। গ্যাস বিল তো মাস শেষে ঠিকই দিতে হচ্ছে। হাজারীবাগ এলাকার বাসিন্দা গৃহিণী কনা বেগম বলেন, গ্যাস নিয়ে এখন আমাদের সঙ্গে তামাশা করা হচ্ছে। রাত জেগে রান্না করে রাখতে হয়। দিনের বেলায় কেরোসিন তেল দিয়ে স্টোভ জ্বালিয়ে কখনওবা সিলিন্ডারের চুলায় তা গরম করে খেতে হয়। সকাল ৭টার আগেই গ্যাস চলে যায়। পুরান ঢাকার নবারপুর এলাকার গৃহিণী রাশেদা বেগম বলেন, গ্যাসের সমস্যার কথা বলে লাভ নেই। সকালে কোনো রকম রান্নাবান্না করতে পারলেও দুপুরের পর থেকেই চুলা জ্বলে না। লালবাগের সুবল দাসের রোডের গৃহিণী কামনা রানী বলেন, গ্যাস সংকটের কারণে ভোররাতে উঠে রান্নাবান্না শেষ করতে হয়। গ্যাস ২টার পর আবার আস্তে আস্তে আসে। যা দিয়ে রান্না করা কষ্ট হয়।
মিরপুরের ডি-বøক ভাড়াটিয়া হাসেম আলী। তার বাসায় গত একবছর ধরেই দিনের বেলা গ্যাস থাকে না। শুধু রাতের বেলা গ্যাস আসে। মাঝে মধ্যে গতকাল শুক্রবার দিন দিনের বেলা গ্যাস আসলেও তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। দিনের বেলা তিনি বাইরের খাবার কিনে আনেন। তাছাড়া গ্যাস না থাকলে বিকল্প হিসেবে সিলিন্ডারের ব্যবস্থা রাখছেন। একই এলাবা বাসিন্দার শেখ কাশেম আলী বলেন, বাসায় দিনে গ্যাস থাকে না। এ সমস্যা তো দীর্ঘ দিনের। কবে ঠিক হবে জানি না। আমি ক্ষুদ্র ব্যবসা করি, এখন সংসার চালানোই কঠিন হয়ে পড়েছে। একদিকে বাইরে থেকে খাবার কেনা, তারপরে সিলিন্ডারও কিনেছি এখন। গ্যাস না পাইলেও বিল দিতে হয় প্রতি মাসে। বাড়িওয়ালা গ্যাসের সমস্যা সমাধানে কোনো ধরনের যোগাযোগ করছেন বলে জানি না। উত্তরার দক্ষিণখানের বাসিন্দা রানা ইনকিলাবকে বলেন, দক্ষিণখান এবং উত্তরখানের অনেক স্থানেই দিনে গ্যাস থাকে না, রাতে আসে। তবে ভোরে সূর্য ওঠার আগেই তা চলে যায়। এখন এলাকার লোকজনের একমাত্র ভরসা সিলিন্ডার। গতকাল তো আবার সিলিন্ডার গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। একদিকে মানুষ গ্যাস না পেলেও বিল দিয়ে যাচ্ছে। আবার সিলিন্ডারও কিনতে হচ্ছে বেশি টাকা দিয়ে।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সচিব ব্যারিস্টার মো. খলিলুর রহমান খান বলেন, আমাদের কাছে গ্যাসের সংকটের কোন তথ্য নেই। বরং দেশে যথেষ্ট পরিমাণে এলপিজি মজুত আছে। যদিও এলপিজি ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডলার সংকটের কারণে আরও অনেক খাতের মতো ঋণপত্র খোলা নিয়ে জটিলতায় পড়েছেন এলপিজি অপারেটরগুলো। বিশেষ করে ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো বেশি সংকটে পড়েছে। এই কারণে সরবরাহে কিছুটা ঘাটতি দেখা গিয়েছে। এই কারণে আগেভাগেই দাম বাড়াতে শুরু করেছেন ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশে গত বছর রেকর্ড পরিমাণে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর খাদ্যদ্রব্য, পরিবহন থেকে শুরু করে সব জিনিসপত্রের দাম একদফা বেড়েছে। অভিযোগের বিষয়ে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন) প্রকৌশলী কামরুজ্জামান ইনকিলাবকে বলেন, গ্যাসের বিষয় আমরা অনেক কিছু করতে যাচ্ছি। হয়তে এ মাসে কিছু নতুন খবর পাবেন।
সোর্স : ইনকিলাব