কঠিন সময় পার করছে মুদ্রণ-প্রকাশনা শিল্প। এলসি জটিলতায় সংকট চরম রূপ ধারণ করেছে। মুদ্রণ সংশ্লিষ্ট কাঁচামাল আমদানি করতে পারছেন না আমদানিকারকরা। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের খরচ। সরাসরি যার প্রভাব পড়েছে ভোক্তা পর্যায়ে। ফলে সংকট আরও দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। রাজধানীর নয়াবাজারের পাইকারি কাগজ ব্যবসায়ীরা জানান, বাজারে দীর্ঘদিন ধরে কাগজের সংকট চলছে। চাহিদা অনুযায়ী মিলারদের কাছে পণ্য পাচ্ছেন না তারা। এতে করে পণ্যের দামও বেড়েছে। নতুন করে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ায় কাগজের দাম আরও বৃদ্ধির শঙ্কা করছেন তারা।
বিজ্ঞাপন
তবে সংকটের কারণে এখনো নতুন দরের প্রোডাকশনের কাগজ বাজারে আসেনি বলেও জানান ব্যবসায়ীরা। আমদানিকারকরা বলছেন, ব্যাংকে এলসি খোলার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। প্রধান কাঁচামাল কাগজ তৈরির মণ্ড বা ভার্জিন পাল্প আমদানি চাহিদা অনুযায়ী আসছে না। এলসি জটিলতা না কমলে বাজারে কাগজের সংকট ঠিক হবে না। রাজধানীর নয়াবাজারে কাগজের বড় মার্কেট। সরজমিন ঘুরে দেখা যায়, সংকটের কারণে চাহিদা অনুযায়ী কাগজ বিক্রি করতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। চাহিদার চেয়ে কম পণ্য দিয়ে ক্রেতা ধরে রাখার চেষ্টা করছেন অনেকে। কাগজ তৈরির প্রধান কাঁচামাল মণ্ড বা ভার্জিন পাল্প। এটি বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়ে থাকে। তবে বর্তমান ডলার সংকটে প্রয়োজনীয় পাল্প আমদানি করা যাচ্ছে না। এতেই কাগজের সংকট তৈরি হয়েছে বলে উল্লেখ করেন রাজধানীর নয়াবাজারের পারটেক্স পেপারের ডিলার ও হাক্কানী এন্টারপ্রাইজের সাদ সালমান। তিনি বলেন, এখন কাগজই পাওয়া যাচ্ছে না।
বিশেষ করে ৫৫, ৬১, ৬৫, ৮০ ও ১০০ গ্রামের ডিডি আইটেমের কাগজগুলো বেশি সংকট। মণ্ড বা ভার্জিন পাল্প প্রয়োজন অনুযায়ী এলসি করা যাচ্ছে না। আমদানিকারকরা নতুন করে প্রোডাকশন করতে পারছে না। পাল্পের সংকটে মিলও বন্ধ রয়েছে। তাই আমরাও পণ্য পাচ্ছি না। আগে আমদানিকারকরা আমাদের একাধিকবার ফোন দিতো পণ্য নেয়ার জন্য। অথচ এখন তাদের কাছে পণ্য চেয়েও পাচ্ছি না। পণ্য না থাকায় আমাদের ফোনও ধরে না তারা। তিনি বলেন, সরকার আবার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। তার পুরো প্রভাব পড়বে কাগজে। কাগজের দামও বেড়ে যাবে। যতদিন এলসি পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হবে ততদিন পণ্যের সংকটও কাটবে না। দামও কমবে না। আগে আমরা ঢাকার বাইরে পণ্য দিতাম। অথচ এখন তাও পারছি না। বছরের শুরুতে কাগজের অনেক চাহিদা থাকে। শিক্ষার্থীরা নতুন স্কুল-কলেজে ওঠার কারণে এই চাহিদা বাড়ে। তবে চাহিদা থাকলেও এবার কাগজ সরবরাহ করতে পারছেন বলে জানান ব্যবসায়ীরা। বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং অ্যান্ড পেপারস মিলসের স্বত্বাধিকারী বলেন, দীর্ঘদিন ধরে একই অবস্থা চলছে। ইম্পোর্টারদের কাছে পণ্য পাই না। আবার শুনছি, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ার কারণে কাগজের দাম বাড়বে। তবে এখন তেমন প্রোডাকশন হচ্ছে না তাই নতুন দর জানা যাচ্ছে না।
এই সংকট চললে আমাদের ব্যবসায় ক্ষতি হবে। একতা ট্রেডার্সের আব্দুল আজম বলেন, যেখানে ১৫০ টন পণ্য দরকার সেখানে ৬০ টন উৎপাদন করা হচ্ছে। পাল্প সংকটে এর বেশি করতে পারছে না। মুদ্রণ শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই শিল্পের প্রধান কাঁচামাল কাগজ। কাঁচামাল না হলে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান চালানোর কোনো সুযোগ নেই। কাগজ পাওয়ার পর কালি, প্লেট, গ্লু আমদানি করতে হয়। তবে ডলার সংকটে এসব কাঁচামাল আমদানিও করা যাচ্ছে না। এতে এই শিল্পে বড় ধাক্কা লাগার উপক্রম তৈরি হয়েছে। শিল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ার শঙ্কাও করেছেন তারা। তাদের মতে, এখন অনেক প্রতিষ্ঠান খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। আগে যেখানে ১৮ ঘণ্টা চলতো এখন সেটা ৬-৭ ঘণ্টা চালাতে হচ্ছে। করোনার মধ্যে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রাখতে হয়েছিল। এখন সেই পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে। লেখা ও ছাপার কাগজে শুল্কহার না কমালে এই সমস্যা দীর্ঘায়িত হবে।
বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহুরুল ইসলাম বলেন, বিশ্ববাজারে কাগজের বাজারের অবস্থা ভালো। কিন্তু এলসি করতে না পারায় বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা এ সুবিধা পাচ্ছে না। একই অবস্থা মুদ্রণ সংশ্লিষ্ট কাঁচামালের ক্ষেত্রে। গত নভেম্বর থেকে মুদ্রণ শিল্পে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে। গত তিন মাসে কাগজের দাম দিগুণের বেশি বেড়েছে।
বাংলাদেশ পেপার মার্চেন্টস্ এসোসিয়েশনের মনিরুল ইসলাম মামুন বলেন, কিছুদিন আগে কাগজের দাম সামান্য কমেছিল। কিন্তু এখন তা আবার বাড়ছে। কাগজ প্রোডাকশনের জন্য গ্যাস-বিদ্যুৎ খুবই দরকারি। কিন্তু এসবের দাম বাড়ানো হয়েছে। এখন সব মিলে কাগজের দাম বাড়তি। রাইটিং ও প্রিন্টিং পেপারের দাম বেশি বেড়েছে। ব্যাংক থেকে পাল্প খুব কম এলসি দেয়। যা চাহিদার চেয়ে অনেক কম।
বাংলাদেশ পেপার ইম্পোটার্স এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আলমগীর হক মানবজমিনকে বলেন, এখন কিছু ব্যাংকে ছোট এলসি হচ্ছে। মাত্র ১০-২০ হাজার ডলারের এলসি হচ্ছে। ভেঙে ভেঙে ছোট এলসি নিয়ে ইম্পোর্টারদের খুশি করার চেষ্টা করছে ব্যাংক। তবে এটা চাহিদার চেয়ে ৩০ শতাংশও না। আর দাম অনেক বেড়ে গেছে। আগে যেই পণ্যের টন ৭০-৮০ হাজার টাকা ছিল সেটা এখন হয়ে গেছে দেড় লাখ টাকা।
এলসি সংকটের সুযোগ নিয়ে পেপার মিলাররা কাগজের দাম বাড়িয়েছে উল্লেখ করে আলমগীর হক বলেন, এখন কাগজের দাম এত বাড়ার কথা না। কারণ বিদেশে পণ্যের দাম অনেক কমেছে। ১২০০ ডলারের পণ্যের দর এখন ৭০০ ডলার হয়েছে। এতে রাইটিং আর প্রিন্টিংয়ের কাগজগুলো যেগুলো আমরা বিদেশ থেকে আমদানি করি সেগুলো ৮০ হাজার টাকা টন করে রাখা যেতো। কিন্তু এলসি হচ্ছে না এই সুবিধা অনেক পেপার মিলাররা ভোগ করছে। অথচ বিদেশে পাল্পের দাম অনেক কম। কাগজের দামও অনেক কম। বিদেশে কাগজের দাম টনে প্রায় ৫০০-৭০০ ডলার কমে গেছে। কিন্তু এলসি না হওয়ার কারণে এই সুযোগ পেপার মিলসরা নিচ্ছে। তারা দাম কমাচ্ছে না। আমদানিকারকরা পর্যাপ্ত পণ্য আমদানি করতে পারলে মিলাররা দামগুলো কমিয়ে ফেলতো। গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়তি কিন্তু তাই বলে এত বেশি বাড়ে নাই যার জন্য কাগজের দাম দেড় লাখ টাকা টন হবে। মুদ্রণ শিল্পের কাঁচামালের সংকটের প্রভাব পড়েছে সংবাদপত্র প্রকাশনাতেও।
ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেন, এলসি বন্ধ থাকায় মুদ্রণ সংশ্লিষ্ট সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে। পত্রিকা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে গেছে। সমাধান হিসেবে আমরা সরকারের কাছে ট্যাক্স কমানোর আবেদন করেছিলাম। এখনো কাগজে ২৫-৩০ শতাংশ ট্যাক্স দিতে হচ্ছে। কালিতেও ট্যাক্স আছে। ট্যাক্স না কমালে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
সোর্স : মানবজমিন