আলু নিয়ে এ বছরও সংকটে কৃষক। অস্থিতিশীল বাজার ব্যবস্থাপনায় প্রতিনিয়ত দর ওঠানামা করছে। জানুয়ারি শেষ হতে চললেও ক্ষেতে এখনও অনেকে আলু রেখে দিয়েছেন দামের আশায়। কৃষি বিভাগ বলেছে, ঘন কুয়াশা ও শীতের তীব্রতায় গাছে মোড়ক লেগে আলুতে পচনের আশঙ্কা রয়েছে। এভাবে আলুক্ষেতে রেখে চাষিরা ঝুঁকি নিচ্ছেন। বিকল্প ফসলে যাওয়ায় প্রতিবছর গড়ে ৫ হাজার হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ কমছে।
উত্তরাঞ্চলের বৃহৎ জয়পুরহাট ও বগুড়ার বিভিন্ন আলুর হাট ঘুরে এবং ক্ষেত দেখে এসব তথ্য মিলেছে। গত বৃহস্পতিবার মহাস্থানহাটে সাদা মিউনিক আলু (হলান্ড) ১২ থেকে ১৪ টাকা কেজি বিক্রি হয়, যা কৃষক পর্যায়ে ১০ টাকা। কৃষকদের দাবি, নতুন আলুর এ দরে খরচও ওঠে না। আর পাইকাররা বলছেন, শিগগির আবহাওয়া ভালো না হলে দর আরও খারাপ হতে পারে।
মহাস্থানহাটে আলু বিক্রি করতে আসা কৃষক ওবায়েদ মিয়া জানান, আজ দাম পেলেও কালই পড়ে যাচ্ছে। তিন দিনের ব্যবধানে মণে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা কমেছে। হাটে প্রকারভেদে লাল আলু (রোমানা-পাকড়ি) ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ২৫০ টাকা, সাদা মিউনিক ৫৮০ থেকে ৬০০, কার্ডিনাল ৮০০ থেকে ৮৫০ ও অজিন্টা-২ আলু ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে। হাটে ৪২ কেজিতে ১ মণ ধরা হয়। পাইকাররা বলছেন, আলুর বর্তমান পড়তি দাম বেশিদিন থাকবে না। বেশি দামের আশায় অনেকে ক্ষেত থেকে আলু তোলেননি। তাঁরা বড় ধরনের ঝুঁকি নিচ্ছেন। দ্রুত আবহাওয়া পরিস্থিতির উন্নতি না হলে এবং পুরোদমে আলু বাজারে উঠলে দাম আরও পড়ে যেতে পারে।
কৃষি কর্মকর্তারা জানান, জানুয়ারির মধ্যেই আলু তোলা শেষ হবে। বগুড়ার শিবগঞ্জ, সোনাতলা, ধুনট ও শেরপুর উপজেলায় ক্ষেতে এখনও গাছ সতেজ রয়েছে। জয়পুরহাট সদর, পাঁচবিবি, ক্ষেতলাল, কালাই ও আক্কেলপুর উপজেলার অবস্থাও একই। কৃষি বিভাগ আলুর আবাদে বাম্পার ফলন দাবি করলেও কৃষকদের ভাষ্য, দাম ভালো না পাওয়ায় আগ্রহ হারাচ্ছেন চাষিরা। আলুর বদলে গম, ভুট্টা, সরিষাসহ বিকল্প ফসল আবাদ করছেন।
বগুড়া, জয়পুরহাট, সিরাজগঞ্জ ও পাবনা নিয়ে গঠিত বগুড়া কৃষি অঞ্চলে খবর নিয়ে জানা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৯৭ হাজার ৮১০ হেক্টর জমিতে ২২ লাখ ৪৩ হাজার ৯৮৬ টন আলুর উৎপাদন হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ লাখ ২ হাজার ৭৫৫ হেক্টর জমি থেকে ২২ লাখ ১১ হাজার ৮৫৫ টন পাওয়া যায়। অর্থাৎ ৩২ হাজার টন কম আলু উৎপাদন হয়েছে। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে শুধু বগুড়ায় ৫৮ হাজার ৫২৫ হেক্টর জমিতে আলু চাষ নির্ধারণ করা হয়। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে বগুড়া কৃষি অঞ্চলের আওতাভুক্ত চার জেলায় ১ লাখ ২ হাজার ৩৫৫ হেক্টর জমিতে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে বগুড়ায় ৫৮ হাজার ৫২৫, জয়পুরহাটে ৪০ হাজার ৩১৫, সিরাজগঞ্জে ২ হাজার ৯৫৫ ও পাবনায় ৫৬০ হেক্টর জমি।
মাঠ পর্যায়ে কৃষকের ভাষ্য, কৃষি বিভাগের এ তথ্য অনুমাননির্ভর। প্রকৃতপক্ষে আলুর আবাদ অনেক কম। দাম না পাওয়ায় প্রতিবছর গড়ে পাঁচ হাজার হেক্টর করে আলুর আবাদ কমছে। স্বাভাবিক কারণে ফলনও কম হবে।
বগুড়ার বিভিন্ন এলাকার কৃষকরা জানান, ছয় মাসের বেশি দেশে ভুট্টা, গম, সরিষার মতো দানাদার শস্যের দাম রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। আলুর চেয়ে তুলনামূলক পরিশ্রম ও খরচ কম হওয়ায় মুনাফার আশায় চাষিরা এসব ফসল আবাদে ঝুঁকছেন। শেরপুর উপজেলার মীর্জাপুরের কৃষক আরিফুল, আমির আলী, সবুজ মিয়ার ভাষ্য, সয়াবিন তেলের লাগামহীন দামের কারণে চাহিদা বেড়েছে সরিষার। দামও ভালো পাওয়ায় আলু বাদ দিয়ে অনেকে জমিতে স্বল্পকালীন এসব শস্য আবাদ করছেন। এর মধ্যে গোখাদ্য হিসেবে খৈল ব্যবহারের সুবিধা থাকায় সরিষার আবাদ বেশি হচ্ছে।
কৃষকের তথ্য অনুসারে, এবার সাদা মিউনিক জাতের আলু চাষে বিঘায় বীজ কেনা, হাল চাষ, আইল কাটা, জমি বাধাই, বীজ রোপণ, সার ও কীটনাশক প্রয়োগ, সেচ ও আলু তোলা বাবদ গড়ে খরচ ৩০ হাজার ৫০০ টাকা। সঙ্গে বস্তা ও পরিবহন খরচ যোগ হবে। জমি লিজ নিলে আরও ১০ হাজার টাকা বাড়তি লাগবে। ভালো ফলনে বিঘায় ১০০ মণ সাদা মিউনিক আলু পাওয়া সম্ভব। শেরপুরের সাধুবাড়ির আলু চাষি আইয়ুব আলী বলেন, ‘সাদা আলু হাটে নিলে দাম পাব ৪০০ টাকা মণ। খরচের টাকা ওঠাই কষ্টকর। ভাগ্যের সঙ্গে বাজি ধরে আবাদ করি। দাম ভালো হলো লাভ, না হলে লোকসান।’
বীজ কম বিক্রির তথ্য জানিয়ে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) বগুড়ার উপপরিচালক জাকির হোসেন প্রতিবছর আলুর জমি কমে যাচ্ছে স্বীকার করেন। কারণ হিসেবে তিনি বাজারে আলুর অস্থিতিশীল দর সামনে আনেন। আলু চাষে কৃষকের ঝুঁকি বাড়ছে। অন্যান্য দানাদার শস্যের কদর বেড়ে যাওয়ায় কৃষক বিকল্প হিসেবে সেসবে আগ্রহী হচ্ছেন বলে মনে করেন এ কর্মকর্তা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বগুড়ার উপপরিচালক মোতলেবুর রহমান জানান, বগুড়া অঞ্চলে আলুর বিপরীতে অন্যান্য ফসল চাষের জমি বাড়ছে। গম, ভুট্টা ও সরিষা চাষে লাভ বেশি।
বেড়েছে হিমাগার খরচ: বগুড়া ও জয়পুরহাট মিলে বৃহত্তর বগুড়া জেলা কোল্ডস্টোরেজ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন। হিমাগারের মালিকরা জানান, বগুড়ায় ৩৬ ও জয়পুরহাটে ২০টি হিমাগার। বগুড়ার হিমাগারে ৩ লাখ ১৭ হাজার ও জয়পুরহাটে ১ লাখ ৮৫ হাজার টন আলু সংরক্ষণ করা যায়। এসব হিমাগারে এখন বস্তায় ৫০ কেজির বেশি আলু রাখা যায় না। ভাড়াও বাড়িয়ে কেজিপ্রতি ৫ টাকা করা হয়েছে।
বৃহত্তর বগুড়া জেলা কোল্ডস্টোরেজ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহসভাপতি আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘অ্যাসোসিয়েশন রেট ৫ টাকা করেছে। আগে বছরে কোল্ড স্টোরেজের বিদ্যুৎ বিল ছিল ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা। এখন তা ৮০ থেকে ৯০ লাখে ঠেকেছে। ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ব্যবসা করি। প্রতিবছর আলুর দাম নিম্নমুখী হওয়ায় হিমাগার মালিক, আলু চাষি ও ব্যবসায়ীরা হতাশায় দিন পার করছেন।’
সোর্স : সমকাল