স্টাফ রিপোর্টার : ২০২০ সালে বাসা-বাড়িতে গ্যাস সংযোগ প্রদান স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেয় সরকার। যে কারণে এলপিজি সিলিন্ডারের চাহিদা বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। এরই মধ্যে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে গ্যাস সংকট প্রকট। গ্যাসের লাইন থাকলেও সরবরাহ কম থাকা বা বন্ধ থাকার কারণে বেশিরভাগ ভোক্তাকেই বিকল্প হিসেবে এলপি গ্যাসের সিলিন্ডার কিনতে হয়। এর সুযোগ নিচ্ছে ব্যবসায়ীরা। সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে সিলিন্ডার প্রতি কয়েকশ টাকা বেশি নিচ্ছেন তারা।
দেশে এলপিজি সিলিন্ডারের মাধ্যমে গ্যাসের ব্যবহার শুরু হয় ১৯৯৯ সালে। বাণিজ্যিকভাবে প্রথম এলপি গ্যাস বাজারে আনে বসুন্ধরা গ্রুপ। বর্তমানে বসুন্ধরা, বেক্সিমকো, যমুনা, ক্লিনহিট, টোটাল, ওরিয়ন, ওমেরা, পেট্রোম্যাক্স, লাফার্স, জি-গ্যাস, ডেলটা, প্রমিটা, জেএমআই, টিএমএসএস ও নাভানাসহ ১৮টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সারা দেশে এলপিজি সিলিন্ডার বাজারজাত করছে। ১২ কেজি, ৩০ কেজি, ৪৫ কেজিসহ বিভিন্ন ওজনের সিলিন্ডার বিক্রি হয়। বাসাবাড়িতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ১২ কেজির সিলিন্ডার।
বিক্রেতারা বলছেন, আমরা ইচ্ছে করে দাম বেশি রাখছি না। কোম্পানির লোকদের কাছ থেকে আমাদের কেনা পড়ছে বেশি দামে। আমরা তো লস দিয়ে বিক্রি করতে পারি না।
গত ২ ফেব্রুয়ারি ১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারের দাম ২৬৬ টাকা বাড়িয়ে ১ হাজার ৪৯৮ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। একসঙ্গে আড়াইশ টাকার বেশি দাম বাড়ানোয় এমনিতেই ক্রেতাদের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। তারওপর এখন সরকার নির্ধারিত দামেও গ্যাস পাচ্ছেন না ক্রেতারা। ১৪৯৮ টাকার গ্যাস খুচরা পর্যায়ে বিক্রি করা হচ্ছে ১৮০০ টাকা। কোথাও কোথাও আরও বেশি। অর্থাৎ ৩শ টাকারও বেশি নেয়া হচ্ছে ১২ কেজির সিলিন্ডারে।
ক্রেতারা বলছেন,সরকারি দামে এলপিজি সিলিন্ডার কখনোই বিক্রি হয়নি। সবসময় বেশি দামেই কিনতে হয়েছে। আমাদের তো কোনো উপায় নেই, বাধ্য হয়ে কিনতে হচ্ছে। সরকারকে এটা অবশ্যই দেখা উচিত। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নির্ধারিত মূল্যে সিলিন্ডার তো পাওয়া যাচ্ছেই না, কোথাও কোথাও কমে গেছে গ্যাসের সরবরাহও। অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট খুচরা বিক্রেতা বলছেন তার কাছে গ্যাসই নেই।
গ্রাহকরা বলছেন, কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে ব্যবসায়ীরা অসৎ প্রক্রিয়ায় সিলিন্ডার গ্যাসের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন।
রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ধানমন্ডির বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম বলেন, কিছুদিন আগে যখন সিলিন্ডারের দাম ১ হাজার ২৩২ টাকা ছিল তখনও সেটি কিনতে হয়েছে ১৫শ টাকার বেশিতে। সর্বশেষ মূল্যবৃদ্ধির পর এখন তারা ১৮০০ টাকা নিচ্ছে। যা রীতিমতো ডাকাতি।
মো. শাহজাহান নামে মোহাম্মদপুরের এক বাসিন্দা বলেন, সরকারি দামে এলপিজি সিলিন্ডার কখনোই বিক্রি হয়নি। সবসময় নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামেই কিনতে হয়েছে। কিন্তু এবার সেটা ‘অতিরিক্ত বেশি’ দামে বিক্রি হচ্ছে। আমাদের তো কোনো উপায় নেই, বাধ্য হয়েই কিনতে হচ্ছে। সরকারকে এটা অবশ্যই দেখা উচিত।
এলপিজি সিলিন্ডারের মূল্য বেশি রাখাটা যে শুধু কোম্পানির দোষ, ব্যাপারটা তা নয়। গ্যাস বিক্রির সিস্টেমে কিছু ত্রুটি আছে। এটি অনেকদিন ধরেই বিইআরসিকে আমরা বলে আসছি। ত্রুটি ঠিক করা হলে নির্ধারিত মূল্যে সিলিন্ডার বিক্রি করা সম্ভব হবে।
সিলিন্ডার গ্যাসের ব্যবসায়ী ধানমন্ডির ফিরোজা ডিস্ট্রিবিউশনের প্রোপ্রাইটর ফিরোজ হোসেইনের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা ইচ্ছে করে দাম বেশি রাখছি না। কোম্পানির লোকদের কাছ থেকে আমাদের কেনা পড়ছে বেশি দামে। আমরা তো লস দিয়ে বিক্রি করতে পারি না।
আরেক ব্যবসায়ী ঝিগাতলার বিসমিল্লাহ ট্রেডার্সের ম্যানেজার মুরাদ সরকার বলেন, কোম্পানি রেটই তো বেশি। আমাদের যদি বেশি কেনা পড়ে, তাহলে সরকারি দামে বিক্রি করার তো কোনো সুযোগ নেই। আবার দাম বাড়ার পর সাপ্লাই কিছুটা কমে গেছে। অনেক এলাকায় সিলিন্ডার পাওয়াও যাচ্ছে না।
এলপিজি সিলিন্ডারের দাম সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি কেন- এমন প্রশ্ন করা হয় বসুন্ধরা এলপিজি সিলিন্ডারের ডিলার শিহাব হোসেনকে। জবাবে তিনি বলেন, কোম্পানি থেকেই বেশি রেট-এ আসে, তাই দাম বেশি।
বসুন্ধরা এলপি গ্যাসের হেড অব সেলস প্রকৌশলী জাকারিয়া জালালের বলেন, এলপিজি সিলিন্ডারের মূল্য বেশি রাখাটা যে শুধু কোম্পানির দোষ, ব্যাপারটা তা নয়। আমাদের এ গ্যাস বিক্রির সিস্টেমে কিছু ত্রুটি আছে। সেটা নিরসনে অনেকদিন ধরেই বিইআরসিকে আমরা বলে আসছি। ত্রুটি ঠিক করা হলে নির্ধারিত মূল্যেই সিলিন্ডার বিক্রি করা সম্ভব হবে। আমরা এখনো কোনো লিখিত অভিযোগ পাইনি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে অবশ্যই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এলসি খোলায় সমস্যা আরেকটি কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা প্রতি মাসে এলসি খুলে এলপিজি আমদানি করি। বর্তমান পরিস্থিতিতে ধারাবাহিকভাবে এলসি খোলা যাচ্ছে না। যদি মাসে দুটি এলসি খোলা হয়ে থাকে, তাহলে একটার সঙ্গে আরেকটা এলসি খোলার যে ধারাবাহিকতা সেখানে গ্যাপ তৈরি হচ্ছে। সে গ্যাপের সুযোগ নিচ্ছে ডিলার ও দোকানিরা। যখন ডিলাররা দেখে যে এ মাসে প্রোডাক্ট কম আসছে কোম্পানি থেকে, তখন তারা টার্গেট পূরণের জন্য বেশি দামে সিলিন্ডার বিক্রি করে। আপনি তাদের কাছে সঠিক মূল্যের হিসাব পাবেন না। আবার দোকানি যখন দেখছে সাপ্লাই কম, তারাও তখন মজুত করে দাম বাড়িয়ে ফেলে। সুতরাং সমস্যাটা সামগ্রিকভাবে তৈরি হয়। কোম্পানি যে দামে সেল করতে চায়, মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে গ্রাহক পর্যায়ে গিয়ে তার দাম বেড়ে যায়। আমরা সবসময় চেষ্টা করি নির্ধারিত মূল্যেই গ্যাস বিক্রি করতে।
প্রশাসন কঠোর হলে বা তদারকি বাড়ালে অন্তত ‘অতিরিক্ত বেশি’ মূল্যে বিক্রি হওয়াটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে- বলেন জাকারিয়া জালাল।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের প্রশাসন ও আইন বিষয়ক সদস্য সচিব খলিলুর রহমান খান বলেন, এলপিজি সিলিন্ডারের দাম বেশি রাখা হলে গ্রাহকরা অভিযোগ দিতে পারবেন। তবে আমরা এখনো এ বিষয়ে কোনো লিখিত অভিযোগ পাইনি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে অবশ্যই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। গ্রাহকরা সচেতন হলে মূল্যবৃদ্ধির এ প্রবণতা কমে যাবে। ভোক্তা অধিকারও এ বিষয়ে কাজ করছে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার পরিদপ্তরের অভিযোগ বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টর মাসুম আরেফিন বলেন, আমরা মৌখিক বেশ কয়েকটি অভিযোগ পেয়েছি কিন্তু কোনো লিখিত অভিযোগ পাইনি। তবে আমরা নিজেদের উদ্যোগে বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করছি এবং অভিযুক্তদের জরিমানা করছি। নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে যদি কোথাও অতিরিক্ত মূল্য রাখা হয়, গ্রাহকরা যদি অভিযোগ করেন, আমরা ব্যবস্থা নেব।
সোর্স : দৈনিক সংগ্রাম