ডলারের সংকট নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে জীবন রক্ষাকারী মেডিকেল ডিভাইসের বাজারে। আমদানিনির্ভর চিকিৎসা সরঞ্জামে ব্যাপক ঘাটতি দেখা দিয়েছে। চিকিৎসা ব্যবস্থার অত্যাবশ্যকীয় এসব পণ্যের জন্য হাহাকার করছে মানুষ। এসব পণ্যের ৯০ শতাংশই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। যাদের কাছে আগের কিছু জিনিস আমদানি করা ছিল তারা ৪ থেকে ৫ গুণ দামে বিক্রি করছেন এসব পণ্য। গত ৪ মাস ধরে এসব পণ্য আমদানির জন্য ব্যাংক থেকে এলসি বা ঋণপত্র খোলা বন্ধ রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট আমদানিকারকরা।
এদিকে, ইতিপূর্বে আমদানিকৃত মেডিকেল ডিভাইসগুলো ক্রমেই শেষ হয়ে যাচ্ছে বলে স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগের এক চিঠিতে বলা হয়েছে, মেডিকেল ডিভাইস আমদানির জন্য ব্যাংক থেকে এলসি বা ঋণপত্র খোলার সমস্যা চলমান থাকলে, দেশে অতি শিগগিরই মেডিকেল ডিভাইসে ব্যাপক ঘাটতি দেখা দিবে। দেশের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে এবং জনগণের জীবন হুমকির সম্মুখীন হবে। দেশীয় চাহিদার মাত্র ১০ শতাংশ মেডিকেল ডিভাইস দেশে উৎপাদিত হয় এবং অবশিষ্ট মেডিকেল ডিভাইসগুলো বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয় বলেও ওই চিঠিতে তুলে ধরা হয়।
এ খাতের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডলার সংকটের জটিলতায় তারা এলসি খুলতে পারছেন না। বিষয়টি তারা ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে এক-দেড় মাস আগেই জানিয়েছেন।
বিজ্ঞাপন
একই বিষয়ে এনবিআরওকে অবহিত করা হয়েছে কয়েক দফা চিঠি দিয়ে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কেও জানানো হয়েছে। কিন্তু ব্যবস্থা না দেখে হতাশ মেডিকেল ডিভাইসের আমদানিকারকরা। তারা জানান, তাদের এসব পণ্যের অধিকাংশ পণ্য আনা হয় চায়না থেকে। বাকি সামান্য কোরিয়া থেকে আসে। এলসির মাধ্যমেই এসব পণ্য আমদানি করতে হয় তাদের। স্থানীয়ভাবে সামান্য পণ্য উৎপাদিত হয়। যা চাহিদার তুলনায় খুবই সামান্য।
রাজধানীর মেডিকেল ডিভাইস ইনস্ট্রুমেন্ট-এর বড় বাজার বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বিএমএ) ভবন। কথা হয় ন্যাশনাল ইলেক্ট্রকেয়ারের জেনারেল ম্যানেজার রফিকুল ইসলাম নীরবের সঙ্গে। তিনি মানবজমিনকে বলেন, ডলার সংকটের কারণে কোনো এলসি খোলা যাচ্ছে না। যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে হয়তো একটি এলসি খুলতে পারবেন। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য। ফলে তাদের ব্যবসা চরম খারাপ অবস্থার মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। কর্মচারীদের বেতন, অফিস ভাড়া দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
দেশে ডলার সংকটে কারণে মেডিকেল ডিভাইস ইনস্ট্রুমেন্ট আমদানিতে কোনো প্রভাব পড়ছে কিনা জানতে চাইলে বাংলাদেশ মেডিকেল ডিভাইস ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যান্ড হসপিটাল ইকুইপমেন্ট ডিলার্স অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারস এসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি এবং বিএমএ ভবনের দোকান মালিক কল্যাণ সমিতির সভাপতি, মেডি ফেয়ারের কর্ণধার হাজী মো. রিয়াজুল ইসলম (দীপক) মানবজমিনকে বলেন, গত ৪ মাস ধরে কোনো এলসি খুলতে পারছি না। স্বাভাবিক সময়ে এই ৪ মাসে ৬ থেকে ৮টি এলসি খুলতেন তিনি। কিন্তু এখন ১০টি এলসি খুলতে গেলে ১টিও খোলা যায় না। যদিও একটি খুলতে দেয়, তাতে সামান্য ডলার থাকলে হয়তো খুলতে পারবেন। এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, ডলার না থাকায় মানুষের মৌলিক চাহিদার এসব পণ্যের সরবরাহে প্রচুর ব্যাঘাত ঘটছে। বাজারে ৩ টাকার পণ্য ১২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে মানুষের কাছে। ৪ থেকে ৫ গুণ বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। ফলে এখানে অরাজকতা বিরাজ করছে।
চলতি বছরের ৪ঠা জানুয়ারি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের ঔষধ প্রশাসন-১ শাখার স্মারক নম্বর-৪৫.০০.০০০০.১৮২.৯৯.০০৩.২১.৩-এর আলোকে মেডিকেল ডিভাইস আমদানির নিমিত্ত এলসি (ঋণপত্র) খোলার অনুমতি প্রদানের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবকে চিঠি দেয়া হয়। এর একটি অনুলিপি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক বৈদেশিক মুদ্রা নীতি বিভাগকেও দেয়া হয়। চিঠিতে বলা হয়, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের স্মারক নং-ভিজিডিএ/ মেডিকেল ডিভাইস-১৩৮/১৪/২২৬২১, তারিখ ২১-১২-২০১২ উপযুক্ত বিষয় ও সূত্রোক্ত স্মারকের পরিপ্রেক্ষিতে জানানো যাচ্ছে যে, বাংলাদেশ মেডিকেল ডিভাইস ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যান্ড হসপিটাল ইকুইপমেন্ট ডিলার্স অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারস এসোসিয়েশন গত ১৯-১২-২০২২ তারিখের আবেদনে জানিয়েছে যে আমদানিকারকগণ গত ১-১১-২০২২ তারিখ থেকে জীবন রক্ষাকারী মেডিকেল ডিভাইস আমদানির জন্য ব্যাংক হতে এলসি (ঋণপত্র) খুলতে পারছেন না। ইতিপূর্বে তাদের আমদানিকৃত মেডিকেল ডিভাইসগুলো ক্রমেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। মেডিকেল ডিভাইস আমদানির জন্য ব্যাংক হতে এলসি বা ঋণপত্র খোলার সমস্যা চলমান থাকলে, দেশে অতি শিগগিরই মেডিকেল ডিভাইসে ব্যাপক ঘাটতি দেখা দিবে। দেশের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে এবং জনগণের জীবন হুমকির সম্মুখীন হবে। দেশীয় চাহিদার মাত্র ১০ শতাংশ মেডিকেল ডিভাইস দেশে উৎপাদিত হয় এবং অবশিষ্ট মেডিকেল ডিভাইসগুলো বিদেশ হতে আমদানি করতে হয়। এ ছাড়া এলসি বা ঋণপত্র খোলার মাধ্যমে মেডিকেল আমদানি করতে প্রায় ৩ থেকে ৪ মাস সময়ের প্রয়োজন হয়। তাই চিকিৎসা ব্যবস্থার অত্যাবশ্যকীয় পণ্য মেডিকেল ডিভাইস আমদানির জন্য ব্যাংক হতে এলসি বা ঋণপত্র খোলার অনুমতি প্রদানের অনুরোধ জানানো হয়েছে। এমতাবস্থায়, দেশে ওষুধের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ বজায় রাখার স্বার্থে মেডিকেল ডিভাইস আমদানির জন্য আমদানিকারকগণ কর্তৃক এলসি খোলার জটিলতা নিরসনের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয় ওই চিঠিতে।
এ খাতের ব্যবসায়ীরা জানান, দেশে ব্যবহৃত চিকিৎসা সরঞ্জামের সিংহ ভাগই আমদানি করতে হয়। গত ১০ বছরে বাংলাদেশে চিকিৎসা সরঞ্জামের বাজার বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। কিন্তু সে অনুপাতে দেশীয় উদ্যোক্তা বিকাশের হার বাড়েনি। দেশে বছরে ৭ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকার মেডিকেল ডিভাইসের চাহিদা রয়েছে, যা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রায় ২০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে আমদানি হচ্ছে ৫ থেকে ৬ হাজার কোটি টাকা। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত আইটেমগুলোর মধ্যে, বেশির ভাগই ব্যবহারযোগ্য/নিষ্পত্তিযোগ্য। ভোগ্যপণ্য ছাড়াও, বাংলাদেশ অর্থোপেডিক পণ্য, অস্ত্রোপচারের জীবাণুনাশক, হাসপাতালের আসবাবপত্র, হোম কেয়ার ডিভাইস, ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম এবং অন্য ছোট যন্ত্র উৎপাদন করে, যদিও তা স্বল্প পরিসরে। দেশের হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত কিছু আমদানি করা উচ্চ প্রযুক্তির ডিভাইসের মধ্যে রয়েছে কার্ডিয়াক স্টেন্ট, কার্ডিয়াক পেসমেকার, কৃত্রিম হার্ট ভাল্ব, ডিজিটাল রক্তচাপ মনিটর এবং ডিভাইস, শ্রবণ সহায়ক ডিভাইস, রক্তের ব্যাগ, প্রস্রাবের ব্যাগ, ডায়ালাইজার টিউব, মেডিকেল ভেন্টিলেটর, ডিজিটাল থার্মোমিটার এবং এক্স-রে এবং আল্ট্রাসাউন্ড মেশিন।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা ইউএসএইড-এর প্রকাশিত সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে চিকিৎসা সরঞ্জামের বাজার বছরে প্রায় ৩৫০ মিলিয়ন ডলারের। যার ৮৫ শতাংশই আমদানিনির্ভর। ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশে চিকিৎসা সরঞ্জাম উৎপাদন শিল্পের যাত্রা শুরু হলেও এ পর্যন্ত এই খাতের শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা মাত্র ৮টি। বাংলাদেশে এই পণ্যের বিশাল বাজার থাকলেও মাত্র ১৫ শতাংশের জোগান আসে এসব দেশীয় প্রতিষ্ঠান থেকে। উদ্যোক্তারা বলছেন, সরকারে নীতি সহায়তা পেলে দেশের চাহিদার বড় একটি অংশের জোগান তাদের পক্ষে দেয়া সম্ভব। দেশে শুধুমাত্র ইনজেকশন সরঞ্জাম ও কিছু নিরাপত্তামূলক যন্ত্রপাতি উৎপাদন হয়। বাকি সব ধরনের সাধারণ ও উচ্চপ্রযুক্তির (হাই-টেক) মেডিকেল সরঞ্জাম আমদানি করা হয়।
সোর্স : মানবজমিন