রাজধানীর শনির আখড়ার বাসিন্দা মোহাম্মদ শাহেদ (৩৯)। গায়ে হঠাৎ প্রচণ্ড জ্বর। পেশিতে বেশ ব্যথা। প্রথমে সাধারণ জ্বর ভেবে ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ কিনে খাচ্ছিলেন। কিন্তু কিছুতেই জ্বর কমে না।
গত ১৯ জানুয়ারি শাহেদ ভর্তি হন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগে। সেখানে এক দিন থাকার পর পরীক্ষা শেষে জানা যায়, নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে শাহেদের শরীরে। অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেওয়া হয়।
শাহেদের বড় ভাই সেলিম মুন্সি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কিভাবে তার শরীরে নিপা ভাইরাস গেছে, বুঝতে পারছি না। শাহেদের জ্বর না কমায় ওকে হাসপাতালে নিয়ে আসি। পরীক্ষা করে ডাক্তার জানান নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ।’
ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিট সূত্রে জানা যায়, প্রায় এক সপ্তাহ আইসিইউতে থাকার পর শাহেদ এখন অনেকটাই সুস্থ। আজ বুধবার তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হতে পারে।
শাহেদের মতো এমন আরো কয়েকজন এ বছর শীত মৌসুমে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক শাখার তথ্য মতে, চলতি বছর এ পর্যন্ত মোট আটজন আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচজন মারা গেছে। তিনজন এখনো চিকিৎসাধীন।
দেশের ২৮ জেলায় নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের বিষয়ে চিকিৎসকদের বিশেষভাবে সতর্ক থাকার নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। একই সঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ডেডিকেটেড কভিড-১৯ হাসপাতালে ১০ শয্যার আইসোলেশন ওয়ার্ড ও ১০টি আইসিইউ প্রস্তুত রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন কালের কণ্ঠকে বলেন, চলতি বছরে এ পর্যন্ত দেশে কত জন নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে, সেটা এখনই সুনির্দিষ্টভাবে বলার সময় হয়নি। এখন অনুসন্ধান চলছে। শেষ হলে রোগী ও মৃতের সংখ্যা জানা যাবে।
গত ২০ জানুয়ারি সকালে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার সাত বছরের শিশু সোয়াদ খেজুরের কাঁচা রস পান করেছিল। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার জ্বর বাড়তে থাকে, সঙ্গে খিঁচুনি দেখা দেয়। বিকেলে তাকে ঈশ্বরদী থেকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। অবস্থার অবনতি হলে পরদিন সকালে তাকে আইসিইউতে নেওয়া হয়। পরীক্ষায় তার শরীরে নিপাহ ভাইরাস শনাক্ত হয়। আক্রান্ত হওয়ার তিন দিনের মধ্যে ২৩ জানুয়ারি শিশুটি মারা যায়।
শাহেদ সরাসরি খেজুরের কাঁচা রস পান না করলেও এমন কিছু থেকে তার শরীরে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে, যার মধ্যে ভাইরাসটি ছিল। কিংবা এই ভাইরাসের অন্যতম প্রধান বাহক বাদুড়ের কিয়দংশ খাওয়া কোনো ফলপাকড় বা খাবার তিনি খেয়েছিলেন।
সাধারণভাবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে বাদুড়ের খেয়ে যাওয়া খেজুর বা তালের কাঁচা রস থেকে। এ ছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে অন্য কেউ এলেও তার মধ্যে সংক্রমণ ঘটে।
চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের ধরন কিছুটা অন্যান্য ভাইরাসের মতো। তবে এতে মৃত্যুর হার অনেক বেশি। ভাইরাসটিতে আক্রান্ত ব্যক্তির শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। এ পর্যন্ত আক্রান্তদের দুই-তৃতীয়াংশের মৃত্যু হয়েছে। মূলত ফলমূল খাওয়া বাদুড় নিপাহ ভাইরাসের প্রধান বাহক। ওই বাদুড় অবশ্য নিজে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয় না। নিপাহ ভাইরাসজনিত রোগের কোনো টিকা ও সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। সতর্কতা ও সচেতনতা এ রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের একমাত্র উপায়।
মৃত্যুহার ৭১ শতাংশ : আইইডিসিআরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২০০১ সালে মেহেরপুরে প্রথম নিপাহ ভাইরাস শনাক্ত হয়। গত ২২ বছরে দেশে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে ৩২৬ জন। মৃত্যু হয়েছে ২৩১ জনের। চলতি বছরে এ পর্যন্ত আটজন আক্রান্ত হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে পাঁচজনের। আগের বছর ২০২২ সালে আক্রান্ত হয় তিনজন। মারা যায় দুজন। এর আগে ২০২১ সালে আক্রান্ত দুজন বেঁচে আছে। তবে আগের বছর ২০২০ সালে আক্রান্ত সাতজনের মধ্যে পাঁচজন মারা গেছে। ঝুঁকিপূর্ণ জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা। বিশেষ করে মেহেরপুর, রাজশাহী, নওগাঁ, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, ঠাকুরগাঁও, কুষ্টিয়া, টাঙ্গাইল, পাবনা, নাটোর, মানিকগঞ্জ, গাইবান্ধা, রংপুর, নীলফামারী, মাদারীপুর, লালমনিরহাট, দিনাজপুর ও জয়পুরহাটে এই ভাইরাস শনাক্ত হয়।
আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এস এম আলমগীর বলেন, বাংলাদেশে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যুহার ৭১ শতাংশ। ২৯ শতাংশ মানুষ মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরলেও তাদের বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা রয়েছে। এই ভাইরাস প্রথমে রোগীর মস্তিষ্কে সংক্রমণ ঘটায়। এতে এক পর্যায়ে পঙ্গু হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, আইইডিসিআরের উপদেষ্টা মোশতাক হোসেন বলেন, বাংলাদেশে যারা নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে, তাদের মধ্যে কমবেশি সবার খেজুরের কাঁচা রস খাওয়ার ইতিহাস আছে। কাঁচা রস পান করা যাবে না, এই বার্তাটি সবার কাছে পৌঁছাতে হবে।
চিকিৎসকদের সতর্ক থাকার নির্দেশনা : স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এক বিজ্ঞপ্তিতে চিকিৎসকদের বেশ কয়েকটি নির্দেশনা দিয়েছে। এর মধ্যে রোগী দেখার সময় অবশ্যই মাস্ক ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। রোগী দেখার আগে ও পরে সাবান দিয়ে হাত ভালো করে ধুতে হবে। জ্বরের উপসর্গ দেখা দিলে রোগীকে অবশ্যই আইসোলেশন ওয়ার্ডে রাখতে হবে।
সোর্স : কালের কন্ঠ