দেশে ১৯ দিনের ব্যবধানে দ্বিতীয়বারের মতো আবারো বাড়ানো হলো বিদ্যুতের দাম। নির্বাহী আদেশে গ্রাহক পর্যায়ে ও পাইকারিতে দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। ইতিমধ্যে এ বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপনও জারি করা হয়েছে। বিদ্যুতের এই বর্ধিত দাম পহেলা ফেব্রুয়ারি থেকেই কার্যকর হবে। এর আগে জানুয়ারি মাসের ১২ তারিখে খুচরা বিদ্যুতের দাম পাঁচ শতাংশ বাড়িয়েছিল সরকার। নতুন ঘোষণায় ফেব্রুয়ারি মাসেও আবাসিক এবং শিল্প-কলকারখানায় বিদ্যুতের দাম বাড়ছে অন্তত পাঁচ শতাংশ। আর পাইকারিতে বিতরণ কোম্পানিগুলোর জন্য বিদ্যুতের দাম বাড়ছে অন্তত আট শতাংশ। চলতি মাসেই গত ১২ই জানুয়ারি নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। ১৯ দিনের মাথায় আবারো দাম বাড়ানোর বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, এটা নতুন করে বাড়ানো নয়, আগের জারিকৃত প্রজ্ঞাপনটি সংশোধন করে নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। সরকার এর আগেই আভাস দিয়েছিল যে, এখন থেকে প্রতি মাসেই বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য সমন্বয় হতে পারে।
পাশাপাশি বিশ্ববাজারের সঙ্গে মিল রেখে জ্বালানি তেলের দামও সমন্বয়ের প্রক্রিয়া চলছে।
সাধারণত গণশুনানির পর বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন বিদ্যুতের নতুন মূল্য নির্ধারণ করে থাকে। কিন্তু পহেলা ডিসেম্বর থেকে সেই আইনে সংশোধন এনেছে। এরপর বিদ্যুতের দামের পর শিল্প, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং বাণিজ্যিক খাতে গ্যাসের দামও বাড়ানো হয়েছে। গ্যাসের পর এবার সরকারের নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো। ৩০শে জানুয়ারি এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। সরকারের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ভর্তুকি সমন্বয়ের জন্য বিদ্যুতের এই দাম বাড়ানো হয়েছে। এর আগে নভেম্বর মাসেও বিদ্যুতের পাইকারি পর্যায়ে দাম বাড়ানো হয়েছিল, যা ডিসেম্বর মাস থেকে কার্যকর হয়েছে। এরপরে খুচরা পর্যায়েও দাম বাড়ানোর জন্য আবেদন করেছিল বিতরণ কোম্পানিগুলো। সেই আবেদনের ওপরে ৮ই জানুয়ারি শুনানি করেছিল বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন-বিইআরসি। কিন্তু বিইআরসি সিদ্ধান্ত জানানোর আগেই সরকারের নির্বাহী আদেশে জানুয়ারিতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছিল। জারিকৃত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, সরকার বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইন, ২০০৩ (২০০৩ সনের ১৩ নং আইন) এর ধারা অনুযায়ী ভর্তুকি সমন্বয়ের লক্ষ্যে জনস্বার্থে ১২ই জানুয়ারি, ২০২৩ তারিখে জারিকৃত প্রজ্ঞাপন সংশোধন করে নতুন দাম নির্ধারণ করেছে। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, এবার লাইফ লাইন গ্রাহকদের বিদ্যুতের দাম বেড়েছে সবচেয়ে বেশি, ৫ দশমিক ৪০ ভাগ। এ ছাড়াও অন্য গ্রাহকদের গড়ে বেড়েছে ৫ ভাগ হারে।
আর পাইকারিতে বিভিন্ন ভোল্টেজ লেভেলে ৬ দশমিক ৫৭ থেকে ৭ দশমিক ৩৬ ভাগ দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, আবাসিক গ্রাহকদের মধ্যে শূন্য থেকে ৫০ ইউনিট ব্যবহারকারী লাইফলাইন গ্রাহকদের বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি ৩ টাকা ৯৪ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৪ টাকা ১৪ পয়সা, শূন্য থেকে ৭৫ ইউনিট ব্যবহারকারীর বিদ্যুতের দাম ৪ টাকা ৪০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৪ টাকা ৬২ পয়সা এবং ৭৬ থেকে ২০০ ইউনিট ব্যবহারকারীদের ৬ টাকা ১ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা ৩১ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ২০১ থেকে ৩০০ ইউনিট ব্যবহারকারীদের ৬ টাকা ৩০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা ৬২ পয়সা, ৩০১ থেকে ৪০০ ইউনিটের জন্য ৬ টাকা ৬৬ পয়সা থেকে বেড়ে ৬ টাকা ৯৯ পয়সা, ৪০১ থেকে ৬০০ ইউনিটের জন্য ১০ টাকা ৪৫ পয়সা থেকে বেড়ে ১০ টাকা ৯৬ পয়সা এবং ৬০০ ইউনিটের ওপরে বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী আবাসিক গ্রাহকদের বিদ্যুৎ বিল ১২ টাকা ০৩ পয়সা থেকে বেড়ে ১২ টাকা ৬৩ পয়সা করা হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে পাইকারি দামের বিষয়ে বলা হয়, সরকার বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইন, ২০০৩ অনুযায়ী ভর্তুকি সমন্বয়ের লক্ষ্যে জনস্বার্থে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বাবিউবো) কর্তৃক বিভিন্ন বিতরণ সংস্থা বা কোম্পানিকে সরবরাহকৃত বিদ্যুতের পাইকারি (বাল্ক) মূল্যহার পুনঃনির্ধারণ করা হয়েছে।
পাইকারি বিদ্যুতের দাম: পাইকারি বিদ্যুতের দামও নির্বাহী আদেশে বাড়িয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এর আগে গতবছরের ২১শে নভেম্বর পাইকারি বিদ্যুতের দাম ২০ শতাংশ বাড়ায় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন-বিইআরসি। সে সময় বিদ্যুতের পাইকারি দাম ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ বাড়ানো হয়। ইউনিট প্রতি ৫ টাকা ১৭ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা ২০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। যা বিল মাস ডিসেম্বর থেকে কার্যকর করা হয়। দুই মাসের ব্যবধানে আবারো বাড়ানো হয়েছে পাইকারি বিদ্যুতের দাম। যা বিল মাস ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর হবে। তবে এবার এই দাম শুধু পিডিবি যাদের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করে তাদের ক্ষেত্রে কার্যকর হবে। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) যেসব কোম্পানির কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করে তাদের পাইকারি দাম এখন থেকে আলাদা হবে বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। পাইকারি বিদ্যুতের দামের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, পাইকারিতে বিভিন্ন ভোল্টেজ লেভেলে ৬ দশমিক ৫৭ থেকে ৭ দশমিক ৩৬ ভাগ দাম বাড়ানো হয়েছে। ২৩০ কেভি ভোল্টেজ আগের দফায় এই লেভেলের দাম ৭ দশমিক ৬০৪০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এখন প্রতি ইউনিটে সেই দাম ৫০ পয়সা বাড়িয়ে ৮ দশমিক ১০৪০ টাকা করা হয়েছে।
এতে দাম বেড়েছে ৬ দশমিক ৫৭ ভাগ। ১৩২ কেভির দাম- ১৩২ কেভিতেও দাম বেড়েছে প্রতি ইউনিটে ৫০ পয়সা। আগে ১৩২ কেভির গ্রাহকের প্রতি ইউনিটের দাম ছিল ৭ দশমিক ৬৩৩৫ টাকা। এখন যা বেড়ে হয়েছে ৮ দশমিক ১৩৩৫ টাকা। শতকরা বৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ৫৫ ভাগ। ৩৩ কেভির দাম- ৩৩ কেভির বিদ্যুতের দাম আগে ছিল ৬ দশমিক ৭৮৯৫ টাকা। এখন যা বেড়ে হলো ৭ দশমিক ২৮৯৫ টাকা। এই ধাপেও ৫০ পয়সা দাম বাড়ানো হয়েছে। এখানে শতকরা বৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৩৬ ভাগ। এদিকে, চলতি মাসে দুইবার বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির ইতিহাসে নজির সৃষ্টি করেছে। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় নতুন করে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির যে প্রজ্ঞাপন জারি করে তা নজিরবিহীন এবং দুঃখজনক বলে মনে করে নাগরিক সমাজ। পাশাপাশি লাইফ লাইনের ক্রমাগত ধাপে ধাপে মূল্যবৃদ্ধির যে সিদ্ধান্ত বা প্রক্রিয়া তা ভিক্ষুকের ঝুলির দিকে নজর দিচ্ছে বলে মনে করে বাংলাদেশ সাধারণ নাগরিক সমাজের নেতৃবৃন্দ। বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে সংগঠনের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন আহমেদ ও সদস্য সচিব একেএম খোশেদ আলম খান বলেন, আবাসিক গ্রাহকদের মধ্যে শূন্য থেকে ৫০ ইউনিট ব্যবহারকারী লাইফ লাইন গ্রাহকদের বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি ৩ টাকা ৭৫ পয়সা থেকে বেড়ে ৩ টাকা ৯৪ পয়সা করেছিল ১২ তারিখে আর গতকাল প্রজ্ঞাপনে দাম বাড়িয়ে করেছে ৪ টাকা ১৪ পয়সা। জীবনযাত্রা যেখানে অসহনীয় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে সেখানে বারবার জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি নাগরিক জীবনে চরম অশান্তি বয়ে আনবে বলে তারা মনে করেন।
সোর্স : মানবজমিন