নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি, মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির কারণে সাধারণ নিন্মবিত্ত-মধ্যবিত্ত মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত। তারওপর বিদ্যুৎ গ্যাসের উপুর্যপুরি দামবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবন আরও দুর্বিসহ করে তুলছে।এর মধ্যে মাত্র ২০ দিনের ব্যবধানে গরিবের ঘাড়ে সব চাইতে বেশি বিদ্যুতের দাম চাপানো হয়েছে। সরকার সামাজিক সুরক্ষার অংশ হিসেবে ৫০ ইউনিট পর্যন্ত ব্যবহারকারীকে লাইফলাইন বা প্রান্তিক ব্যবহারকারী হিসেবে বিবেচনা করে। সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নে এই বিদ্যুতের দামে খুব বেশি কাটছাঁট করা না হলেও এবার দুই ধাপে সেখানে প্রায় ১১ ভাগ দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার সকালে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে সরকার পাইকারি এবং খুচরা সব ধরনের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এদিকে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা লুট করার জন্য বিদ্যুত, পানি ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। সরকার দেশের মানুষকে বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস দিতে পারছে না; এ জন্য দেশের মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে বলে দাবি করেছে বিএনপি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা লুট করার জন্য বিদ্যুত, পানি ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। সরকার দেশের মানুষকে বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস দিতে পারছে না; এ জন্য দেশের মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণ হচ্ছে তারা আজকে আমদানি করতে পারছে না। দ্রব্যমূলক প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে, আওয়ামী লীগের সিন্ডিকেটের লোকেরাই এই কাজগুলো করছে। তারা বিদেশে টাকা পাচার করে এদেশে দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি করেছে। অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিয়েছে।
অপরদিকে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদের নেতারা বলেছেন, মাত্র ২০ দিনের ব্যবধানে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ফের বাড়ায় ক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানিয়েছে। সরকারের ভুল নীতি, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, অপচয় ইত্যাদি কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ দিন দিন বেড়েই চলেছে। কিন্তু এসব সত্য গোপন করে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির অজুহাতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ খাতে ভুল নীতি ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত ও বিচারের দাবি করেন।
মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, আবাসিক গ্রাহকদের মধ্যে শূন্য থেকে ৫০ ইউনিট ব্যবহারকারী লাইফলাইন গ্রাহকদের বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি ৩ টাকা ৭৫ পয়সা থেকে ১৯ দিনের ব্যবধানে দুই দফা বাড়িয়ে বাড়িয়ে ৪ টাকা ১৪ পয়সা করা হয়েছে। এতে গরিবের এই বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির শতকরা হার দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৪ ভাগ। দেশে এক কোটি ৬৩ লাখ এমন গ্রাহক রয়েছেন। অন্যদিকে শূন্য থেকে ৭৫ ইউনিট ব্যবহারকারীর বিদ্যুতের দাম ৪ টাকা ৪০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৪ টাকা ৬২ পয়সা, ৭৬ থেকে ২০০ ইউনিট ব্যবহারকারীদের ৬ টাকা ১ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা ৩১ পয়সা, ২০১ থেকে ৩০০ ইউনিট ব্যবহারকারীদের ৬ টাকা ৩০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা ৬২ পয়সা, ৩০১ থেকে ৪০০ ইউনিটের জন্য ৬ টাকা ৬৬ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা ৯৯ পয়সা, ৪০১ থেকে ৬০০ ইউনিটের জন্য ১০ টাকা ৪৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১০ টাকা ৯৬ পয়সা এবং ৬০০ ইউনিটের ওপরে বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী আবাসিক গ্রাহকদের বিদ্যুৎ বিল ১২ টাকা ০৩ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১২ টাকা ৬৩ পয়সা করা হয়েছে। অন্য গ্রাহক শ্রেণির ওপর বৃদ্ধির হার ৫ ভাগের মধ্যে রয়েছে। এর আগে গত নভেম্বরে পাইকারি পর্যায়ে ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বাড়ায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। এটি ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয়। এরপর ডিসেম্বর থেকেই খুচরা দাম বাড়াতে বিইআরসির কাছে আবেদন করে ছয়টি বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা। ৮ জানুয়ারি এসব আবেদন নিয়ে শুনানি করে বিইআরসি। ১৫ জানুয়ারির মধ্যে শুনানি-পরবর্তী মতামত জানাতে বলা হয়। এরপর নতুন দাম ঘোষণা করার কথা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির। তার আগেই সরকারের নির্বাহী আদেশে দাম বাড়ানো হলো। আজ থেকে এ দাম কার্যকর হবে।
পাইকারি বিদ্যুতের দাম: নির্বাহী আদেশে জারি করা প্রজ্ঞাপনে পাইকারিতে বিভিন্ন ভোল্টেজ লেভেলে ৬ দশমিক ৫৭ থেকে ৭ দশমিক ৩৬ ভাগ দাম বাড়ানো হয়েছে। সব শেষ বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) ২১ নভেম্বর ১৯ ভাগ পাইকারি বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করে। ২৩০ কেভির দাম: ২৩০ কেভি ভোল্টেজ লেভেলে ৭ দশমিক ৬০৪০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এখন প্রতি ইউনিটে সেই দাম ৫০ পয়সা বাড়িয়ে ৮ দশমিক ১০৪০ টাকা করা হয়েছে। এতে দাম বেড়েছে ৬ দশমিক ৫৭ ভাগ। ১৩২ কেভির দাম: ১৩২ কেভিতেও দাম বেড়েছে প্রতি ইউনিটে ৫০ পয়সা। আগে ১৩২ কেভির গ্রাহকের প্রতি ইউনিটের দাম ছিল ৭ দশমিক ৬৩৩৫ টাকা। এখন যা বেড়ে হয়েছে ৮ দশমিক ১৩৩৫ টাকা। শতকরা বৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ৫৫ ভাগ। ৩৩ কেভির দাম: ৩৩ কেভির বিদ্যুতের দাম আগে ছিল ৬ দশমিক ৭৮৯৫ টাকা। এখন যা বেড়ে হলো ৭ দশমিক ২৮৯৫ টাকা। এ ধাপেও ৫০ পয়সা দাম বাড়ানো হয়েছে। এখানে শতকরা বৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৩৬ ভাগ।
পিডিবির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরবরাহকৃত গ্যাসের দাম ঘনমিটারপ্রতি ৫ টাকা দুই পয়সা। আগামী মাসে তা বেড়ে দাড়াঁবে ১৪ টাকা। প্রতি ঘনমিটারে দাম বাড়ছে ৯ টাকা। এই দাম বাড়ার কারণে মাসে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে বর্তমানের চাইতে ৮০০ কোটি টাকার বেশি। পিডিবির হিসাবে, আগামী ফেব্রæয়ারি মাস থেকে আগামী বছরের ২০২৪ সাল জুন পর্যন্ত ১৭ মাসে মোট উৎপাদন ব্যয় প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা বাড়বে। পিডিবির ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে গ্যাসে মোট বিদ্যুতের ৫১ দশমিক ৫ শতাংশ উৎপাদন হয়। আগামী মাসের শুরুতে নতুন দাম কার্যকরের পর গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের গড় ব্যয় দাঁড়াবে ১০ টাকা ৯২ পয়সা।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম ও সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেনের সই করা বিবৃতিতে বলা হয়, বিশেষজ্ঞরা এটা প্রমাণ করেছেন, দুর্নীতি, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা রোধ করে বিদ্যুৎ খাতে ৩০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব। অথচ তা না করে জনগণের কাঁধে এই বোঝা চাপানো হচ্ছে। কৃষি, ক্ষুদ্র শিল্পসহ বিভিন্ন খাতে বিদ্যুতের দাম বাড়লে, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধিসহ সবক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাই বিদ্যুতের দাম বাড়ানো কোনোভাবেই যৌক্তিক না।
সোর্স : ইনকিলাব