ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতির সূচকে বিশ্বে এক ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। ১৮০টি দেশের মধ্যে ২০২২ সালে অধঃক্রম অনুযায়ী (খারাপ থেকে ভালো) বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম, যা আগের বছর ছিল ১৩তম।
এছাড়াও দুর্নীতির পরিস্থিতি উন্নয়নসংক্রান্ত স্কোরেও পিছিয়েছে বাংলাদেশ। ১০০ নম্বরের মধ্যে এবার বাংলাদেশ ২৫ নম্বর পেয়েছে, যা গত বছর ছিল ২৬। অর্থাৎ বাংলাদেশে দুর্নীতি বেড়েছে। তবে সূচকের ঊর্ধ্বক্রম অনুযায়ী (ভালো থেকে খারাপ) বাংলাদেশের অবস্থান অপরিবর্তিত।
এবারও বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৭তম। অপরিবর্তিত অবস্থানের কারণ হলো-সামনের সারিতে থাকা অনেক দেশ যৌথভাবে একই অবস্থানে রয়েছে। ফলে নিচের দিকে থাকা দেশগুলোর অবস্থানে পরিবর্তন আসেনি। সামগ্রিকভাবে টিআই-এর তিন সূচকেই বাংলাদেশে দুর্নীতি কমেনি। করোনাকালীন স্বাস্থ্য খাতসহ বিভিন্ন জরুরি সেবায় যে দুর্নীতি হয়েছে, এই সূচকে তার প্রতিফলন রয়েছে। বাংলাদেশের এই অবস্থান এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চতুর্থ এবং দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয়। এছাড়া বিশ্বে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ সোমালিয়া এবং সবচেয়ে কম ডেনমার্ক।
জামার্নভিত্তিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা টিআই-এর ‘দুর্নীতির ধারণা সূচক (করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স বা সিপিআই)-২০২২ সালের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য। মঙ্গলবার সারা বিশ্বে একযোগে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
এদিন বাংলাদেশে টিআই-এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান টিআইবি নিজস্ব কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
সেখানে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী ব্যবস্থাপক অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের প্রমুখ। দুর্নীতি প্রতিরোধে বেশকিছু সুপারিশ করেছে টিআই। এগুলো হলো-দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, দুদককে আরও স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া এবং অবাধ গণমাধ্যম ও সক্রিয় নাগরিক সমাজ বিকাশে উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা।
সংবাদ সম্মেলনে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দেশে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে তাদের সুরক্ষা দেওয়া হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা পুরস্কৃত হয়। এক্ষেত্রে সরকার চুনোপুঁটিদের বিরুদ্ধে কিছুটা ব্যবস্থা নিলেও রুই-কাতলারা পার পেয়ে যাচ্ছে। কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করলে নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমকর্মীদের নাজেহাল হতে হয়। ফলে দুর্নীতিবাজরা উৎসাহিত হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে আরও কয়েকটি কারণে দুর্নীতি কমানো যাচ্ছে না। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-রাজনীতিবিদদের প্রতিশ্রুতির ঘাটতি, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহির অভাব ও রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য অবস্থান সংকুচিত করে দেওয়া এবং গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের কথা বলার সুযোগ সীমিত করে দেওয়া। এছাড়া আর্থিক খাতে একের পর এক কেলেঙ্কারি ও জালিয়াতির ঘটনা ঘটলেও তাদের বিচারের আওতায় আনার দৃষ্টান্ত নেই। ড. জামান আরও বলেন, বাংলাদেশের স্কোর কমেছে। বৈশ্বিক গড় ৪৩-এর চেয়ে অনেক কম। এটি অত্যন্ত বিব্রতকর ও হতাশাব্যঞ্জক। ক্ষেত্রবিশেষে দুর্নীতির ঘটনা অস্বীকার কিংবা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।
এছাড়াও অবস্থান ও পরিচয় নির্বিশেষে আইনের কঠোর প্রয়োগ হয় না। করোনার সংকটময় মুহূর্তে দেশের স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপকভাবে দুর্নীতির তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর শূন্য সহনশীলতার (জিরো টলারেন্স) ঘোষণা সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রকাশ। কিন্তু এর প্রয়োগে ঘাটতি আছে। বাস্তবে এটি ঘোষণাতেই আটকে আছে। বিশেষ করে এই ঘোষণা বাস্তবায়নে দায়িত্বপ্রাপ্তদের দুর্নীতির সঙ্গে যোগসাজশ রয়েছে। ফলে তারা সহায়তা করেছে। এছাড়াও দুর্নীতির সুবিধাভোগীরা অত্যন্ত প্রভাবশালী। তিনি বলেন, রাজনৈতিক শুদ্ধাচারের মাধ্যমে সুশাসন নিশ্চিত করা গেলে আমাদের অবস্থান আরও ভালো হতো।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, অর্থনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান যে পর্যায়ে, এর তুলনায় দেশ থেকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ বেশি টাকা পাচার হচ্ছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্টে এসব তথ্য উঠে এসেছে। আর অর্থ পাচারকারীদের সিংহভাগই প্রভাবশালী। তিনি বলেন, দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রতিবন্ধকতার মধ্যে আরও রয়েছে শীর্ষ দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দৃষ্টান্ত দেখা যাচ্ছে না। এছাড়াও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) স্বাধীনতায় ঘাটতি রয়েছে।
টিআই-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুর্নীতির পরিস্থিতি উন্নয়নসংক্রান্ত স্কোরে ১০০ নম্বরের মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর ২৫। এই স্কোর যত বেশি থাকবে, দুর্নীতি তত কম। এক্ষেত্রে গত ৪ বছর পর্যন্ত স্কোর ছিল ২৬। কিন্তু বিশ্বের সব দেশের গড় স্কোর ৪৩। এক্ষেত্রে বিশ্বের গড় স্কোরের চেয়ে ১৮ ধাপ পিছিয়ে বাংলাদেশ। অর্থাৎ দুর্নীতির ব্যাপকতা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় দক্ষিণ এশিয়ার ৮টি দেশের মধ্যে আফগানিস্তানের পরেই রয়েছে বাংলাদেশের অবস্থান। এছাড়াও এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ৩১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ চতুর্থ। এর আগে রয়েছে সিরিয়া, মিয়ানমার ও উত্তর কোরিয়া। বাংলাদেশের মতো একই স্কোর পেয়েছে গিনি ও ইরান।
সংবাদ সম্মেলনে ড. জামান আরও বলেন, বিশ্বের বেশকিছু দেশে নাগরিক স্বাধীনতা সংকুচিত হওয়ায় দুর্নীতি বাড়ছে। বাংলাদেশেও এই প্রবণতা দেখা যায়। আলোচ্য সময়ে ১৩০টি দেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে। মানুষ রাস্তায় নেমেছে। কিন্তু বাংলাদেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ নেই। টিআইবির এই নির্বাহী পরিচালক বলেন, আইন প্রয়োগে ঘাটতি রয়েছে। বিশেষ করে ব্যাংকিং ও অর্থনৈতিক খাতসহ বিভিন্ন খাতে ক্রমবর্ধমান অনৈতিক প্রভাব বিস্তার, অনিয়ম-দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলায় দায়ীদের বিচারের আওতায় আনা যায়নি।
প্রতিবেদন অনুসারে কম দুর্নীতিগ্রস্ত তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছে ডেনমার্ক। এরপর রয়েছে ফিনল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড। চতুর্থ অবস্থানে নরওয়ে। সমান স্কোরে পঞ্চম ও ষষ্ঠ যথাক্রমে সুইডেন ও সিঙ্গাপুর। সপ্তম সুইজারল্যান্ড। এরপর রয়েছে যথাক্রমে নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ, হংকং, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইস্তোনিয়া, আইসল্যান্ড, উরুগুয়ে, বেলজিয়াম, জাপান ও যুক্তরাজ্য। সর্বনিুে অবস্থান করছে সোমালিয়া। এর আগে রয়েছে দক্ষিণ সুদান ও সিরিয়া। চতুর্থ অবস্থানে ভেনিজুয়েলা, ইয়েমেন, বুরুন্ডি, ইকুইটেরিয়ল গিনিয়া, হাইতি, লিবিয়া, উত্তর কোরিয়া ও চাঁদ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে ভুটান। উপরের দিকে দেশটির অবস্থান ৬৮। এরপর মালদ্বীপের স্কোর ৪০। ভারত ৪০, শ্রীলংকা ৩৬, নেপাল ৩৪, পাকিস্তান ২৭, বাংলাদেশ ২৫ ও আফগানিস্তানের স্কোর ২৪।
সোর্স : যুগান্তর