সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি চুলা জ্বলে না। আবার যখন ঘুমাতে যাই তখনো দেখি চুলায় গ্যাস নেই। মধ্যরাতে এসে ভোররাতে চলে যায় গ্যাস। এজন্য রান্নাবান্নায় বিদ্যুতের চুলাই ভরসা। বলছিলেন রুমা বেগম। তিনি থাকেন রাজধানীর তেজকুনি পাড়ায়। রুমা বলেন, গত শনিবার ছুটির দিন ভেবে একটু বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে ছিলাম। ঘুম থেকে উঠে গ্যাসের দেখা পাবো না সেটা তো নিশ্চিত। কিন্তু বিদ্যুৎ থাকবে না সেটা তো ভাবিনি। একসঙ্গে গ্যাস আর বিদ্যুৎ না থাকায় অসহায় লাগছিল।
কাউকে বাড়িতে দাওয়াত করতেও ভয় লাগে। তখন চুলা জ্বলবে কিনা এই চিন্তায়। বছরের পর বছর ধরে তেজকুনি পাড়ার রাহাত মঞ্জিল এলাকায় গ্যাসের এই অবস্থা। কাঁঠালবাগান এলাকায় বসবাস করেন বৃষ্টি। শীতের মধ্যে অনেক সময় গরম তরকারি দিয়ে ভাত খেতে পারেন না বলে জানালেন। বৃষ্টি বলেন, দিনের বেলায় আমার চুলা জ্বলে না। গ্যাস আসে রাত ১০টায়। ভাত আর একটা তরকারির আয়োজন করে রান্না করতে করতে রাত ১২টা বাজে। এক রান্নাই আমরা পরের দিন রাত পর্যন্ত খাই। ইচ্ছে করলেও এখন আর যা খুশি রান্না করে খেতে পারি না। যেহেতু শীতের দিন তাই ভাত তরকারি ঠাণ্ডা হয়ে থাকে আর সেটাই খেতে হচ্ছে। কারণ আমার গরম করার বিকল্প কোনো ব্যবস্থা নেই। শুধু রোমা বা বৃষ্টিই নন, ঢাকার অনেক এলাকার গৃহিণীরা এখন এমন অবস্থার মধ্যে আছেন। গ্যাসের চাপ না থাকায় অনেক এলাকায় দিনের বেলায় চুলা জ্বলে না। চুলায় সামান্য গ্যাস থাকলেও তা নিয়ে রান্নাবান্না করতে বেগ পেতে হয়। শীতের সময়ে এই সমস্যা আরও বেড়েছে। গ্রাহকরা বলছেন, চুলা না জ্বললেও মাস শেষে তিতাসের বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে নিয়মিত। চুলা নিয়মিত না জ্বলায় কেউ কেউ এলপি গ্যাস কিনে রান্নাবান্না করেন। কেউবা আবার ইলেকট্রিক চুলায় রান্না করেন। এতে বাড়তি খরচের বোঝা এসে পড়ছে। বাংলা মোটর এলাকায় থাকেন মানসুরা। তিনি বলেন, গ্যাসের কথা আর কি বলবো, আগে বিভিন্ন এলাকায় গ্যাস সংকটের কথা শুনে ভাবতাম আগুন ছাড়া মানুষ কীভাবে চলে। গত এক বছর ধরে বাংলা মোটর এলাকায় যে গ্যাস সংকটের মধ্যে আছি এই কষ্ট বলে বোঝাতে পারবো না। বেশি রাতে তরকারি রান্না করে আবার ফজরের সময় উঠে ভাত রান্না করে ফেলি। যদি ফজরে উঠতে না পারি তাহলে ভাত রান্না করতে পারি না। নাস্তা বানানোর কথা তো চিন্তাই করা যায় না। গ্যাসের কারণে নাস্তার ধরনও পরিবর্তন হয়ে গেছে। সকালে হয় পাউরটি না হয় ওটমিল, না হয় মুড়ি, বিস্কুট এসব খেতে হচ্ছে। ঢাকার নারিন্দায় থাকেন কাজল আনোয়ার। তিনি বলেন, পুরান ঢাকায় গ্যাসের সংকট আরও তীব্র। এখানে শীত বা গরম না সারা বছর গ্যাসের সমস্যা। গত তিন মাস ধরে অবস্থা আরও খারাপ। গভীর রাত ছাড়া দিনে কোনো গ্যাস নেই। কাজল আনোয়ার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মাসে মাসে গ্যাসের বিল দিচ্ছি অথচ দিনে কোনো চুলা জ্বলে না। রাতে জেগে থেকেও অনেক সময় গ্যাস পাই না। রাত দুইটা তিনটার দিকে অল্প অল্প আসে। এভাবে কি মানুষ রান্না করতে পারে। তাই বাধ্য হয়ে সিলিন্ডারের চুলা কিনেছি। সিলিন্ডারের চুলা ব্যবহারে সংসারে বাড়তি খরচ যোগ হয়েছে। এটাও তো আমাদের জন্য বাড়তি চাপ। যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া এসব এলাকায় গ্যাস সংকট আরও তীব্র। যাত্রাবাড়ীর ঝরনা বলেন, গ্যাসের চুলায় আগুন আছে কিনা এটা দেখতে গিয়ে প্রতিদিন একটি করে ম্যাচ শেষ হচ্ছে। তারপরও চুলা জ্বলছে না। বেশি রাতে গ্যাস আসলেও আগুনের তাপ থাকে না। অল্প অল্প জ্বলে। এত অল্প জ্বালে তো পানি ফুটে না। পানি ফোটানোটা সবচেয়ে কষ্ট হয়ে গেছে। দেখা যায় এখন পানিও হিসেব করে খেতে হয়। অনেক সময় ফোটানো পানি শেষ হয়ে গেলে পানি পর্যন্ত কিনে খেতে হচ্ছে। চুলায় আগুন না থাকার কারণে জীবন-যাপন আরও কঠিন হয়ে যাচ্ছে। সংসারে বাড়তি ব্যয়ও যোগ হয়েছে। শনির আখড়ায় থাকেন লিপি। তিনি বলেন, শনির আখড়ায় গ্যাসের সংকট এতটাই তীব্র অনেক সময় এই এলাকায় তিন-চার দিন পর পর এখানে গ্যাস আসে। গত এক সপ্তাহ ধরে অবস্থা আরও খারাপ। রাত জেগে থাকতে হয় গ্যাসের অপেক্ষায়। তারপরও আমার চুলা জ্বলে না। এই শীতে একটু চা খেতে পারি নাই সকাল-বিকাল কোনো বেলায়। একজন মেহমান আসলেও এক কাপ চা বানিয়ে দিতে পারি না। অসহায় অবস্থায় দিন কাটছে। আমি ভাড়া বাসায় থাকি। রান্নাঘর এত ছোট যে সিলিন্ডারের চুলা কিনে রাখার কোনো জায়গা নেই। এলাকা ছেড়ে দিবো যে সেটাও তো পারছি না। পশ্চিম আগারগাঁও এলাকার বাসিন্দা আল আমিন। তিনি বলেন, গ্যাস সংকটের কারণে রান্নার রুটিন বদলে দেয়া হয়েছে। এখন সকাল-বিকাল আর দুপুরে রান্না হয় না। সারা দিনের রান্না করতে হয় সকালে এবং রাতে। কারণ দিনের বেলা গ্যাস মিলে না। চুলা জ্বলে না।
সোর্স : মানবজমিন