দুনিয়ায় শান্তি ও আখেরাতে মুক্তির জন্য আল্লাহর ওপর আংশিক নয়; বরং পরিপূর্ণভাবে ঈমান এনে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় ইতিবাচক পরিবর্তনের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালাতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমীর অধ্যাপক মুজিবুর রহমান।
তিনি আজ রাজধানীতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরী উত্তর আয়োজিত এক ভার্চুয়াল কর্মী সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন। কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের আমীর মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিনের সভাপতিত্বে এবং কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের সেক্রেটারি ড. মুহাম্মদ রেজাউল করিমের সঞ্চালনায় পবিত্র কালামে হাকীম থেকে দারসুল কুরআন পেশ করেন সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম। সম্মেলনে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। আরো বক্তব্য রাখেন ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম মা’ছুম, সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি এ এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদ, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের নায়েবে আমীর আব্দুর রহমান মুসা। উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের নায়েবে আমীর ইঞ্চিনিয়ার গোলাম মোস্তফা, কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের সহকারি সেক্রেটারি মাহফুজুর রহমান, নাজিম উদ্দীন মোল্লা ও ডা. ফখরুদ্দীন মানিক প্রমূখ।
অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, কালেমার আহবান দৃশ্যত সংক্ষিপ্ত মনে হলেও এর আবেদন অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত। জীবনের সকল কাজই সম্পাদন করতে হবে আল্লাহকে হাজির-নাজির জেনে তার কাছে জবাবদিহীর অনুভূতি নিয়ে। আমাদের প্রত্যেকের জীবনকে আল্লাহর রঙে রঙিন করত হবে। পবিত্র কালামে হাকীমে এক হাজারের বেশি আদেশ এবং এক হাজারের বেশি নিষেধ সংক্রান্ত আয়াত রয়েছে। দুনিয়ায় শান্তি ও আখেরাতে মুক্তির জন্য এসব আদেশ-নিষেধ যথাযথভাবে পালন করতে পালন করতে। ঈমানের ওপর পরিপূর্ণভাবে দাঁড়াতে হবে। ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদেরকে সাহসী হতে হবে। মূলত, যার সাহস নেই, তার ঈমান দুর্বল। বিশ্বনবী (সা.) বিশ্বের সবচেয়ে সাহসী ব্যক্তি ছিলেন। তাই তার পক্ষে একটি সফল বিপ্লব সাধন করা সম্ভব হয়েছিল। তাই ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদেরকে হীনমন্য হলে চলবে না বরং বীরত্ব, সাহসিকতা ও প্রজ্ঞার সাথেই ময়দানে অকুতোভয় সৈনিক হিসাবে কাজ করতে হবে। তাহলেই দ্বীনের বিজয় অবশ্যাম্ভাবী হয়ে ওঠবে।
তিনি বলেন, আল্লাহ তা’য়ালা মু’মিনের জানমাল জান্নাতের বিনিময়ে কিনে নিয়েছেন। তাই আমাদেরকে জেল-জুলুম ও জীবনের ভয়ে কুন্ঠিত হলে চলবে না বরং সকল প্রতিকূলতা উপেক্ষা করেই দ্বীনকে বিজয়ী করার প্রচেষ্টা চালাতে হবে। কারণ, জীবন-মৃত্যু সহ সবকিছুই হয় আল্লাহর পক্ষ থেকেই। এর ব্যতিক্রম চিন্তা করা অবশ্যই শিরক। তাই ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদেরকে দ্বীন সম্পর্কে স্বচ্ছ ও সহীহ জ্ঞান অর্জন করে তা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যথাযথাভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। তিনি আল্লাহর আইন ও সৎলোকের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সকলকে ময়দানে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার আহবান জানান।
তিনি আরো বলেন, সরকার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিক ও আদর্শিকভাবে মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়ে জুলুম-নির্যাতনের পথ বেছে নিয়েছে। সে ধারাবাকিতায় বর্ষীয়ান জননেতা আমীরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমানকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে গ্রেফতার করে কারাগারে অন্তরীণ রেখেছে। কিন্তু জুলুম-নির্যাতন চালিয়ে অতীতে কোন আদর্শকে নির্মূল করা যায়নি; আর কখনো যাবেও না। তিনি সরকারকে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি পরিহার করে অবিলম্বে আমীরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমান, আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, এটিএম আজহারুল ইসলাম, মাওলানা আ ন ম শামসুল ইসলাম, অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার ও মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান সহ জাতীয় নেতৃন্দের মুক্তির জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানান এবং মহান আল্লাহ তা’য়ালার রহমত কামনা করেন।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, আমরা জান্নাতের পথের অভিযাত্রী। আমরা সে ট্রেনে উঠে পড়েছি। কিন্তু শয়তান এক্ষেত্রে আমাদের মধ্যে ওয়াসওয়াসা সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু শয়তানের প্ররোচণায় বিভ্রান্ত না আমাদেরকে আল্লাহর হুকুমের যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে। যখন মদ নিষিদ্ধ হয় তখন গলায় হাত দিয়ে বের করে আমরা আল্লাহর হুকুম পালন করেছি। আমরা আল্লাহর গোলাম; মুসলিম। মূলত, এটিই আমাদের পরিচয়। আমরা সৌভাগ্যবান এই জন্য যে, যিনি আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন আমরা তাকে চিনি। তিনি আমাদের যে বিধান দিয়েছেন তাও আমার হাতেই রয়েছে। তাই আমাদেরকে যথাযথভাবে আল্লাহর ওপর ঈমান আনতে হবে। পরিপূর্ণভাবে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করত হবে; প্রয়োজন একনিষ্ঠ ও ত্রæটিহীন ইবাদত। এতেই রয়েছে ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তি।
তিনি বলেন, বর্তমান সরকার ষড়ন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে দেশের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ধ্বংস করে দিয়েছে। তারা এখন সংবিধানে দোহায় দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে প্রতিশ্রুতির দিচ্ছে। কিন্তু জনগণ তাদের কথায় আস্থা রাখতে পারছে না। তারা যদি নিরপেক্ষ নির্বাচনে আন্তরিক হয়, আর দেশ ও জাতির জন্য এতোই ভালো কাজ করে থাকেন তাহলে কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে তাদের ভয় কোথায়? তিনি টালবাহানা পরিহার করে অবিলম্বে সরকারকে কেয়ারটেকার সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে নতুন করে জনমত যাচাই করার আহবান জানান। অন্যথায় জনদাবি জনগণই আদায় করবে-ইনশাআল্লাহ।
এটিএম মা’ছুম বলেন, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দেশ থেকে ইসলাম ও ইসলামী আদর্শ উৎখাত করার গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। সে ষড়যন্ত্র এখন সর্বব্যাপী রূপ লাভ করেছে। সমাজের সকল স্তর ও পর্যায় থেকে ইসলামী মূল্যবোধের চর্চায় নানাবিধ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। এমনকি জাতিকে নাস্তিক্যবাদী ও দ্বীনবিমূখ করার জন্য পাঠ্যসূচিতে বিবর্তনবাদ ও ইসলাম বিরোধী অধ্যায় সংযুক্ত করা হয়েছে। তাই এই দেশ, জাতি ও ইসলাম বিরোধী ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় দ্বীনকে বিজয়ী আদর্শ হিসাবে প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চেষ্টা চালাতে হবে। মূলত, দুনিয়ায় শান্তি ও আখেরাতে মুক্তির জন্য দ্বীন বিজয়ী করার কোন কোন বিকল্প নেই। তিনি দ্বীন বিজয়ের লক্ষে সকলকে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ও সর্বোচ্চ কোরবানী পেশের আহবান জানান।
এ এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, গোটা বিশ্বেই এক ক্রান্তিকাল চলছে। ক্ষুধা-দারিদ্র, বেকারত্ব, নিরাপত্তাহীনতা, অশান্তি ও নানাবিধ সঙ্কট বিশ্বকে অশান্ত ও অস্থিতিশীল করে তুলেছে। আমাদের দেশের অবস্থা আরো করুণ। মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নেই। অপশাসন-দুঃশাসন, লাগামহীন লুটপাট ও দুর্নীতি জাতিস্বত্তাকেই হুমকীর মুখে ঠেলে দিয়েছে। জনগণ নিজেদের অধিকার ভোগ করতে পারছে না। আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠিত না থাকায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। মূলত, ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে সমাজ পরিবর্তন ছাড়া মানুষের মুক্তি মিলবে না। আর এ জন্য প্রয়োজন নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রাম ও জনমত গঠন। তিনি সেই স্বপ্নের সমাজ প্রতিষ্ঠায় প্রতিটি ঘরে ঘরে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছানোর কর্মীদের প্রতি আহবান জানান।
মাওলানা আব্দুল হালিম বলেন, মু’মিন জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো দ্বীন প্রতিষ্ঠার যথাযথ প্রচেষ্টা চালানো। এজন্য আল্লাহর প্রতি অবিচল ঈমান ও জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ অপরিহার্য অনুসঙ্গ। এ পথ কখনো কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না; এখনো নয়। মূলত, যুগে যুগে যারাই মানুষের কাছে দ্বীনে হক্বের দাওয়াত দিয়েছে তাদের ওপরই নেমে এসেছে নানাবিধ বাধা-প্রতিবন্ধকতা। তাই জুলুম-নির্যাতনে হতাশ হলে চলবে না বরং সকল বাধা উপেক্ষা করেই ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের দ্বীন প্রতিষ্ঠার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালাতে হবে। তিনি কর্মীদেরকে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ময়দানে কাজ করার আহবান জানান।
আব্দুর রহমান মুসা বলেন, দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য দাওয়াতি কার্যক্রম সম্প্রসারণের কোন বিকল্প নেই। ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের এই প্রত্যয় নিয়ে কাজ করা উচিত যাতে কেউই দাওয়াতের বাইরে না থাকেন। আর এ জন্য সমাজসেবা কার্যক্রম বাড়াতে হবে। তাহলেই দ্বীনের বিজয় তরান্বিত হবে-ইনশাআল্লাহ।
সভাপতির বক্তব্যে মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন বলেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে আশরাফুল মাখলুকাত হিসাবে সৃষ্টি করেছেন। একই সাথে দিয়েছেন দুনিয়াতে খিলাফতের দায়িত্ব। আর খলিফার দায়িত্ব হলো সমাজ-রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রেই আল্লাহর হুকুম যথাযথভাবে পালন করার পরিবেশ সৃষ্টি করা। আর তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন রাষ্ট্রক্ষমতা ছাড়া কোন ভাবেই সম্ভব নয়। সে লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে আল্লাহর পথে সংগ্রাম অবিরাম সংগ্রাম চালাতে হবে। মূলত, সে সংগ্রাম চালাতে গিয়ে সাবেক আমীরে জামায়াত শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীসহ শীর্ষনেতৃবৃন্দ নির্ভয়ে শাহাদাতকে বরণ করে নিয়েছেন। ইসলামী আন্দোলনের ওপর জুলুম-নির্যাতন ইতিহাসে ধারাবাহিকতা। এ কাজে আঞ্জাম দিতে দিয়ে অনেক নবী-রাসূল (সা.)গণকে শাহাদাত বরণ করতে হয়েছে। অনেককে কারা নির্যাতনও ভোগ করত হয়েছে। তাই ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের পিছপা হলে চলবে না বরং সকল বাধা-প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করেই দ্বীনকে বিজয়ী আদর্শ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।