সারা দেশে প্রচণ্ড শীত। দিনের বেশির ভাগ সময় কুয়াশায় আকাশ ঢাকা থাকায় সূর্যের মুখ দেখতে পাওয়া যায়নি দেশের অধিকাংশ স্থানে। স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা যাচ্ছে, গতকাল দেশের অধিকাংশ স্থান ঘন কুয়াশায় ঢেকে গেছে। ঘন কুয়াশার কারণে দৃষ্টিসীমা ১০০ গজেরও নিচে নেমে এসেছে। বিশেষ করে নদী, অববাহিকা, বিল-ঝিল এলাকায় ঘন কুয়াশা এত বেশি যে ২০ গজ দূরের কোনো বস্তুত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। ফলে হাইওয়েতে রাতে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে ও প্রাণহানি হচ্ছে। রাতে গাড়ি কম গতিতে সতর্কতার সাথে চালানোর জন্য আবহাওয়াবিদরা পরামর্শ দিয়েছেন।
গতকাল শুক্রবার দেশে শৈত্যপ্রবাহের আওতা না বাড়লেও দিনের বেশির ভাগ অংশে কুয়াশা থাকায় শীতের মাত্রা বেড়েছে অনেক বেশি। বলা হচ্ছে, চলতি শীত মৌসুমে সবচেয়ে বেশি ঠাণ্ডা অনুভূত হয়েছে গতকাল। শীতকে সামাল দেয়ার জন্য পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র অথবা কম্বল না থাকায় নির্ঘুম রাত কাটে অসংখ্য মানুষের। শহর এলাকায় ছিন্নমূল মানুষ রাতে ঘুমাতে পারছে না। আবহাওয়া অফিস বলছে, আজ রাতে শীতের তেমন উন্নতি না ঘটলেও দিনে শীত বাড়বে না। আগামী সোমবারের দিকে তাপমাত্রা সামান্য বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
আজ শনিবার নওগাঁ, পঞ্চগড়, যশোর ও চুয়াডাঙ্গা জেলায় মৃদু শৈত্য বয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস। এর আগে গতকাল শুক্রবার রাজশাহী, পাবনা, চুয়াডাঙ্গা, নীলফামারী, নওগাঁ জেলায় মৃদু শৈত্যপ্রবাহ ছিল। নতুন করে শৈত্যপ্রবাহের আওতায় এসেছে যশোর ও পঞ্চগড় জেলা। শৈত্যপ্রবাহের আওতাভুক্ত জেলাগুলোতে ৮ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে নিম্ন তাপমাত্রা থাকতে পারে। গতকাল দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়ায়। এই এলাকাটির অপর পাশে ভারতের অংশে প্রচণ্ড শীত থাকায় পঞ্চগড়ে শীতকালে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়।
এ দিকে রাজধানী ঢাকায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ১৪.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগেও ঢাকায় নি¤œ তাপমাত্রা ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি ছিল। কিন্তু গতকালই অনেক বেশি শীত অনুভূত হওয়ার কারণ হিসেবে কুয়াশাকে দায়ী করা হয়েছে। কারণ ঢাকায় দুপুরের দিকে কিছু সময় ছাড়া দিনের বাকি অংশ মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশাচ্ছন্ন ছিল। সূর্য কিরণ না থাকায় এবং দিবাভাগ উষ্ণ না হওয়ায় প্রচণ্ড শীতে কাবু ছিল ঢাকাবাসী। গতকাল ছিল সাপ্তাহিক ছুটির দিন। শীতের কারণে গতকাল অন্য শুক্রবারের চেয়ে রাস্তায় মানুষের চলাচল অনেক কম ছিল। যানবাহনের উপস্থিতিও কম ছিল সকালে।
ঢাকার পাশের জেলা নরসিংদী থেকে বেশ কয়েকজন জানিয়েছেন, সেখানে সারা দিন পার হলেও মানুষ সূর্যের মুখ দেখতে পারেননি। নরসিংদীতে অনেকগুলো নদী ও বিল-ঝিল থাকায় সেখানে কুয়াশা ছিল বেশ ঘন। গ্রামের যেখানে বেশি গাছ-গাছালি ছিল সেখানে কুয়াশায় ১০ গজের দূরে বস্তুও দেখা যায়নি। নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার সালুরদিয়া গ্রামের মো: রিয়াদুল হক নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, সারা দিন সূর্যের দেখা মেলেনি। বাধ্য না হলে শীতে এলাকার মানুষ বাইরে বের হচ্ছে না। রাতে গা গরম করতে খড়কুটা ও আবর্জনা পোড়াচ্ছেন অনেকে। এই শীতে ভারী লেপ অথবা কম্বল না থাকায় দরিদ্র মানুষের বেশ কষ্ট হচ্ছে।
অন্য দিকে দেশের উত্তরাঞ্চলের সংবাদদাতারা জানিয়েছেন, তাপমাত্রা এত কম যে, ভোরের দিকে পানি ছোঁয়া যাচ্ছে না। শিশু ও বৃদ্ধরা ঠাণ্ডার কারণে গোসল করতে পারছে না। অন্য দিকে উত্তরাঞ্চলের সর্বত্রই ঠাণ্ডাজনিত কারণে নানা ধরনের রোগব্যাধি দেখা দিয়েছে। বৃদ্ধরা সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছেন। অর্থনৈতিক টানাপড়েনের এ সময়ে কষ্ট কিনে খাওয়ার সামর্থ্য হারিয়েছে অনেক পরিবার। সরকারি হাসপাতালে গেলে নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ ছাড়া তেমন কোনো ওষুধ পাওয়া যায় না। কিছু ওষুধ পেলেও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আনতে হয় বাইরে থেকে। সে টাকা না থাকায় রোগ নিয়েই কাটে তাদের জীবন।
গোলাপগঞ্জ (সিলেট) সংবাদদাতা জানান, সিলেটের গোলাপগঞ্জে গত পাঁচ দিন ধরে শীতের তীব্রতা বেড়েছে। কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকছে রাস্তাঘাট। পাঁচ দিন পর গত শুক্রবার দুপুরে সূর্যের আলো দেখেছেন উপজেলাবাসী। আবার বিকেল ৪টার পর থেকে কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় সমগ্র উপজেলা। সন্ধ্যার পর থেকে সড়কে যানবাহনের লাইট জ্বালিয়েও চলাচল করা দুরূহ বলে জানান একাধিক চালক। ইতোমধ্যে ঘন কুয়াশার কারণে সড়ক দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে ছোটবড় অনেক যানবাহন।
সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলাসহ একাধিক উপজেলায় শীতের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় দুর্ভোগ বেড়েছে ছিন্নমূল মানুষের। আর উপজেলায় তীব্র শীত আর ঘন কুয়াশায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। তুষারাচ্ছন্ন বাতাস আর ঘন কুয়াশাসহ হাড় কাঁপানো শীতে চরমভাবে কাহিল হয়ে পড়ছেন উপজেলার খেটে খাওয়া মানুষজন। শীতের তীব্রতা বৃদ্ধি পাওয়ায় নিম্ন আয়ের মানুষজন গরম কাপড় সংগ্রহে জেলা ও উপজেলায় পুরাতন কাপড়ের দোকানে ভিড় জমতে দেখা যায়। ইতোমধ্যে সরকারিভাবে কোনো শীতবস্ত্র বিতরণ করতে দেখা না গেলেও বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন এবং বিত্তবানরা শীতবস্ত্র বিতরণ করতে দেখা যায়। এদিকে উপজেলায় শীতের তীব্রতার কারণে শীতজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন শিশু ও বৃদ্ধরা। প্রচণ্ড শীত ও ঘন কুয়াশার কারণে কর্মহীন হয়ে পড়ছেন দিনমজুরসহ খেটে খাওয়া মানুষজন।
উপজেলার সচেতন মহল শীতার্ত মানুষদের সহায়তার জন্য ও শীতবস্ত্র বিতরণ করতে সরকারি বেসরকারি দফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন। পাশাপাশি বিত্তবানদের শীতার্ত মানুষজনের পাশে দাঁড়াতে উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন।
হোসেনপুর (কিশোরগঞ্জ) সংবাদদাতা জানান, গত কয়েক দিনের টানা শৈত্য প্রবাহ ও ঘন কুয়াশায় কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে বিকেল পর্যন্তও সূর্যের দেখা মিলছে না। ফলে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ রাস্তায় বের হচ্ছেন না। তারপরও অনেকেই যানবাহনে লাইট জ্বালিয়ে চলাচল করতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে অহরহ ঘটছে দুর্ঘটনা। বাড়ছে হতাহতের সংখ্যাও।
রাজবাড়ী প্রতিনিধি জানান, যমুনায় ঘন কুয়াশার কারণে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে ফেরি চলাচল বন্ধ ছিল। পরে শুক্রবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে কুয়াশা কেটে গেলে ফেরি চলাচল শুরু হয়। তবে ঘাটে কোনো অপেক্ষমাণ গাড়ি না থাকায় এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত ফেরি ঘাটে বসে থাকায় কোনো যানজট নেই। এর আগে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ২টা থেকে কুয়াশার ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ায় ফেরি চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। এ সময় ঘাটে তিনটি রো রো ফেরি লোড করে নোঙর করে থাকে।
বিআইডব্লিউটিসি দৌলতদিয়া ঘাট শাখার ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) মো: সালাহ উদ্দিন বলেন, ঘন কুয়াশার কারণে মাঝেমধ্যেই মাঝরাত থেকে ফেরি চলাচল বন্ধ থাকে। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে পদ্মায় কুয়াশার ঘনত্ব বেড়ে গেলে রাত ২টা থেকে দুর্ঘটনা এড়াতে ফেরি চলাচল বন্ধ রাখা হয়। পরদিন শুক্রবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে কুয়াশার ঘনত্ব কমে এলে আবারো ফেরি চলাচল শুরু হয়।
সোর্স : নয়া দিগন্ত