দেশের মানুষের বড় অংশ এখন খাবার কিনতে হিমশিম খাচ্ছে। খাবার কেনার জন্য কেউ পরিবারের সম্পদ বিক্রি করছেন, কেউ ঋণ করেছেন। সাধারণ মানুষ এখন নিজেদের ডাউনগ্রেড করছেন। আগে যিনি ভালো চাল খেতেন তিনি এখন চালের মান কমিয়ে মোটা চাল খাচ্ছেন। আগে যিনি মোটা চাল খেতেন তিনি এখন চালের পরিমাণ কমিয়েছেন, ক্যালোরি কনজামশন কমিয়েছেন। আগে যিনি তিন দিন প্রোটিন খেতেন বা তিন দিন চিকেন বা একদিন পাঙ্গাশ মাছ খেতেন, তিনি হয়তো একদিন প্রোটিন খাচ্ছেন। তাদের পরিবারের লোকজন এখন স্যাক্রিফাইস করছেন, পরিবারসহ তারা নানাভাবে সাফার করছেন। অনেকেই খাদ্যসঙ্কটের কারণে পরিবারকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশে বর্তমানে এক কেজি গরুর গোশতের দাম ৬৮৪ টাকা। এ দামটা বিশ্বব্যাপী গরুর গোশতের গড় দামের চেয়ে বেশি। পাকিস্তানে বর্তমানে প্রতি কেজি গরুর গোশতের দাম ৩৭৫, ভারতে ৫৮০, নেপালে ৪৬৫ ও শ্রীলঙ্কায় ৫৪৫ টাকা। বাংলাদেশে বেশির ভাগ পণ্যের দাম দক্ষিণ এশিয়ার গড় দামের চেয়ে বেশি।
ঢাকায় খাদ্যপণ্যের মূল্য কলম্বোর চেয়ে ৪২ শতাংশ বেশি। হাউজিং খরচ ২৭ শতাংশ বেশি, কাপড় চোপড়ের খরচ ২৯ শতাংশ বেশি এবং যাতায়াত খরচ ৬৮ শতাংশ বেশি। গড়ে সার্বিক খরচ বেশি ৪২ শতাংশ। প্রশ্ন হলো, এটি কেন হচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তর আমরা জানব দু’টি পর্বে। প্রথম পর্বে আমরা জানব বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি কত ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে এবং দ্বিতীয় পর্বে আমরা জানব, মার্কেট কনসেন্ট্রেশন কিভাবে মূল্যস্ফীতিতে ভূমিকা রাখে, অর্থাৎ- অল্প কিছু পরিবারকেন্দ্রিক অলীগারদের হাতে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও ট্রেড কেন্দ্রীভূত হওয়ার ফলে মূল্যস্ফীতি কিভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিদায়ের দিন তারিখ খেয়াল নেই, পাকিস্তানে ইমরান খান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১৯ সালের শেষের দিকে রুপির মূল্যপতনের কারণে হঠাৎ করে জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়ে যায়। ওই সময় আল-জাজিরা একটি রিপোর্ট করেছিল যেখানে পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ বলছে, আহারে- আমরা তো ইমরান খানকে ভালো মনে করে ক্ষমতায় নিয়ে এসেছি। ক্ষমতায় আসার পর দেখছি- তার কারণে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। আমরা এখন চলতে পারছি না। সেই রিপোর্টটিতে পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ কী পরিমাণ দুর্ভোগে আছে সেটি বোঝানোর জন্য পূর্ববর্তী এক বছরে মূল্যস্ফীতির হিসাব দেয়া হয়, যাতে আটা চিনি চালসহ বেশ কিছু আইটেমের দাম ছিল।
মোবাইলে টিভির সেই দামের তালিকার ছবি তুলে রাখি এবং পরে সে দাম নিয়ে বাংলাদেশের বাজারের সাথে তুলনা করি। ইন্টারেস্টিংলি দেখতে পেলাম, পাকিস্তানে যখন মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠে গেছে, পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতি সারা বিশ্বের হেডলাইন রিপোর্ট হচ্ছে। ওই অবস্থাতেও পাকিস্তানের জিনিসপত্রের দাম বাংলাদেশ থেকে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কম। এটি শুধু পাকিস্তানে নয়, শ্রীলঙ্কায় যখন এই বছর একটি খাদ্যসঙ্কট হলো, যখন ডলার সঙ্কটের কারণে তাদের রুপির মূল্য অনেক বেড়ে গেল, কম্পেয়ার করে দেখলাম, শ্রীলঙ্কায়ও জিনিসপত্রের দাম তাদের সঙ্কটের পরে অনেকগুলো আইটেমে বাংলাদেশের চেয়ে কম। জানি আমার অনেক বন্ধুর এই তথ্যটি বিশ্বাস হবে না।
আসুন আমরা রিয়েল-টাইমে এটি দেখি। Expakistan.com নামে একটি ওয়েবসাইটে বিশ্বের বিভিন্ন শহরের জীবন ধারণের প্রকৃত ব্যয়ের তুলনা (real-time cost of living) করা হয়। এতে দেখা যায়, এই মুহূর্তে ঢাকার খাদ্যপণ্যের মূল্য কলম্বোর চেয়ে ৪২ শতাংশ, হাউজিং ২৭ শতাংশ, ক্লোদিং ২৯ শতাংশ ও ট্রান্সপোর্টেশন ৬৮ শতাংশ বেশি- ওভারঅল ৪২ শতাংশ বেশি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, লেনদেনের ভারসাম্য থেকে রিজার্ভ সঙ্কটের কারণে যে শ্রীলঙ্কায় প্রতি ডলারের বিপরীতে রুপির দাম এক মাসে ২০০ রুপি থেকে সাড়ে ৩০০ রুপিতে চলে গেছে- এ ধরনের সঙ্কটে থাকা আর অতিরিক্ত মূল্যস্ফীতি হওয়া শ্রীলঙ্কা বা কলম্বোর পণ্যমূল্যের চেয়ে কেন ঢাকা শহরের পণ্যের দাম বেশি হবে! এখানে আমার অনেক বন্ধু সঙ্গত কারণ দেখিয়ে বলতে পারেন-Expakistan.com এটি একটি ক্রাউডসোর্স ওয়েবসাইট। এখানে কেউ যদি ভুল ডাটা দেয় তবে সে ডাটাটা ভুল কম্পারিজন দেখাবে। ফলে এ ডাটা গ্রহণযোগ্য নয়। কেউ এটি বলতেই পারেন।
আসুন আমরা সিপিডি কী বলছে সেটি দেখি। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ গত ২০ অক্টোবর একটি সংবাদ সম্মেলনে জানায়, বাংলাদেশের বেশির ভাগ পণ্যের দাম দক্ষিণ এশিয়ার গড় দামের চেয়ে বেশি। তারা উদাহরণ দেয়, বাংলাদেশে আধা কেজি পাউরুটির দাম ৬২ টাকা, যা দক্ষিণ এশিয়ার সর্বোচ্চ। আধা কেজি পাউরুটির দাম পাকিস্তানে ৪৫ টাকা, ভারত ও নেপালে ৪৮ টাকা এবং এমনকি শ্রীলঙ্কাতেও এই পাউরুটির দাম ৫০ টাকা। যা বাংলাদেশ থেকে কম। সিপিডি আরো জানিয়েছে, বাংলাদেশে বর্তমানে এক কেজি গরুর গোশতের দাম ৬৮৪ টাকা। তা শুধু দক্ষিণ এশিয়াতে সর্বোচ্চ নয়, এ দামটা বিশ্বব্যাপী গরুর গোশতের গড় দামের চেয়ে বেশি। ফলে স্পষ্টতই বাংলাদেশে পণ্যমূল্য আমাদের সাথে তুলনীয় দেশগুলোর চেয়ে বেশি। এটি কেন হচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তর আমরা খুঁজব। বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি কেন বেশি? সেটি উদ্ঘাটনের আগে মূল্যস্ফীতির ফলে সমাজে কী সঙ্কট তৈরি হয়েছে সেটি আমরা একটু দেখে নিতে পারি।
চোখ মেলে তাকালে আমরা দেখতে পাই, দেশের মানুষের বড় অংশ এখন খাবার কিনতে হিমশিম খাচ্ছে। মানুষ কতভাবে জোড়াতালি দিয়ে খাবারের ব্যবস্থা করছেন এবং আরো কী কী ব্যবস্থা নিচ্ছেন সেটি শুরুতেই বলেছি।
এতক্ষণ যে আলাপটা করলাম সেটি কোনো রাজনৈতিক আলোচনা নয়, তার একটি প্রমাণ আছে সাম্প্রতিক একটি গবেষণায়। জাতিসঙ্ঘের সংস্থা বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি বা ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম এ বছরের মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত এক হাজার ২০০ মানুষের ওপর একটি জরিপ চালায়। এই জরিপটিতে দেখা গেছে, বাংলাদেশের নি¤œআয়ের ৪২ শতাংশ পরিবারের জীবনযাত্রা ও খাদ্য পরিস্থিতি সব ক্ষেত্রে অবনতি হয়েছে এবং আগস্ট মাসের চিত্রে দেখা গেছে, ওই মাসে খাদ্য কেনার জন্য ৬৪ শতাংশ মানুষ ঋণ নিয়েছে, ২৯ শতাংশ পরিবার তাদের সঞ্চয় ভেঙেছে। আবার খাবার কিনতে গিয়ে ১০ শতাংশ পরিবার তাদের গত ১২ মাসের সব সঞ্চয় ভেঙে ফেলেছে। এই পরিবারগুলোর খাদ্যসঙ্কট দিনে দিনে ঘনীভূত হতে থাকবে। কিন্তু এই পুরো সঙ্কটের পেছনে আছে মূল্যস্ফীতি।
বাংলাদেশ সরকারের নীতিনির্ধারকরা প্রায়ই বলে থাকেন, বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতির জন্য প্রধানত দায়ী ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক জ্বালানি তেলের মূল্যস্ফীতি। কিন্তু আসলে কি তাই? আমরা ইতঃপূর্বে আলোচনায় দেখেছি- এই মূল্যস্ফীতি শুধু ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরই হয়নি, বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি অন্যান্য দেশ থেকে বা আমাদের কম্পিটিটিভ যেসব দেশ ও আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলো, তাদের চেয়ে বেশিই ছিল। সুতরাং এখানে ভিন্ন কিছু আছে! যেটি বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতিতে বড় ভূমিকা রেখেছে। এই ভিন্ন অনেকগুলো কারণের মধ্যে গত এক দশকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রেখেছে। তা হচ্ছে- অল্প কিছু পরিবারকেন্দ্রিক গ্রুপের হাতে মার্কেট পাওয়ারের কনসেন্ট্রেশন বা কেন্দ্রীভূত হওয়া। মার্কেট পাওয়ারের কনসেন্ট্রেশন কিভাবে মূল্যস্ফীতিতে বড় ভূমিকা রাখে তা নিয়ে একটি ভিডিও আপনি দেখে নিতে পারেন নিচের লিঙ্ক থেকে। হ
ভিডিও লিঙ্ক: : https://www.facebook.com/ zia.hassan.rupu/videos/475508908089761
লেখক : সামষ্টিক অর্থনীতি ও উন্নয়ন-
বিষয়ক গবেষক