বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে রেকর্ড গড়েছিল দেশ, গত বছরের আগস্টেও যা ছিল ৪৮ বিলিয়নের ঘরে। তবে আমদানি ব্যয় মেটানো, রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় কমাসহ নানা কারণে চলতি বছর সেই রিজার্ভ ধীরে ধীরে কমেছে।
রিজার্ভ ঠিক রাখতে এক পর্যায়ে সরকার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ (আইএমএফ) বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীর দ্বারস্থ হয়। উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে প্রায় ৯৭০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা চেয়ে চিঠিও দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
বিজ্ঞাপন
সব মিলিয়ে বিদায়ি বছরজুড়েই আলোচনায় ছিল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের বিষয়টি।
যেমন ছিল রিজার্ভ : একটি দেশের রিজার্ভ হলো সেই দেশের রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স, বিদেশি বিনিয়োগ, বিভিন্ন দেশ বা সংস্থা থেকে পাওয়া ঋণ বা অন্যান্য উৎস থেকে পাওয়া বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ। অর্থনীতির তত্ত্ব অনুযায়ী, একটি দেশের তিন মাসের আমদানির খরচের সমমানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অবশ্যই থাকতে হয়।
গত বছরের আগস্টে বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার। সরকার তখন রিজার্ভের অর্থ বিনিয়োগের ঘোষণা দেয়। রিজার্ভ থেকে ৭০০ কোটি ডলার দিয়ে গঠন করা হয় রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ), লং টার্ম ফান্ড (এলটিএফ) ও গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ড (জিটিএফ)। এখান থেকে পায়রা বন্দরকে ৫২ কোটি ৪০ লাখ ইউরো এবং রপ্তানি ঋণ তহবিলে (ইডিএফ) ৬০০ কোটি ডলার বা ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা দেওয়া হয়। কারেন্সি সোয়াপ বা সাময়িক বিনিয়োগ হিসাবে ২০ কোটি ডলার বা এক হাজার ৭২০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে শ্রীলঙ্কাকে। রিজার্ভ থেকে উড়োজাহাজ কিনতে বাংলাদেশ বিমান ও সোনালী ব্যাংককে অর্থ দেওয়া হয়েছে। পায়রা বন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেলের খনন কর্মসূচিতেও রিজার্ভ থেকে ১০০ কোটি ডলার খরচ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে বিভিন্ন তহবিল ও প্রকল্পে রিজার্ভের আট বিলিয়ন ডলার দেওয়া হয়েছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানি, সার ও খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া, ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমানো, রেমিট্যান্সপ্রবাহ কমে যাওয়া এবং রপ্তানি আয় কমে যাওয়ায় রিজার্ভও কমতে থাকে। ফলে আমদানি সরবরাহ ঠিক রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক বাধ্য হয়েই রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করা শুরু করে। বিক্রীত ডলারের বেশির ভাগ খরচ করা হয়েছে জ্বালানি তেল ও সার আমদানিতে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে মোট রিজার্ভের পরিমাণ ৩৪ বিলিয়ন ডলার। সেখান থেকে বিভিন্ন তহবিলে বিনিয়োগ ও ঋণ হিসেবে দেওয়া আট বিলিয়ন ডলার বাদ দিলে রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৬ বিলিয়ন ডলার। তবে রিজার্ভ ২৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছলেও তা দিয়ে পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
আইএমএফের ঋণ : রিজার্ভ সংকট কাটাতে গত ২৪ জুলাই আইএমএফের কাছে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চেয়ে চিঠি দেয় অর্থ বিভাগ। চিঠিতে ঋণের বিষয়ে আইএমএফকে প্রয়োজনীয় আলোচনা শুরুর অনুরোধ করা হয়। তিন বছরের জন্য ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চায় সরকার। লেনদেনের ভারসাম্য রক্ষা এবং বাজেটের সহায়তা বাবদ এই ঋণ চাওয়া হয়েছে। এই ঋণ আইএমএফের বর্ধিত ঋণ সহায়তা (ইসিএফ), বর্ধিত তহবিল সহায়তা (ইএফএফ) এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব মোকাবেলার জন্য গঠিত সহনশীলতা ও টেকসই তহবিল (আরএসএফ) থেকে চাওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের চিঠিতে সাড়া দিয়ে গত ২৬ অক্টোবর আইএমএফের প্রতিনিধিদল ঋণ নিয়ে আলোচনা করতে ঢাকায় আসে। ২৬ অক্টোবর থেকে ৯ নভেম্বর পর্যন্ত প্রতিনিধিদলটি প্রায় ৩০টি বৈঠক করে। ৯ নভেম্বর ভর্তুকি কমানো, রাজস্ব খাত সংস্কার, ব্যাংকিং খাত সংস্কারসহ নানা শর্ত দিয়ে আইএমএফ বাংলাদেশকে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার ঘোষণা দেয়। ঋণের প্রথম কিস্তি পাওয়া যাবে আগামী ফেব্রুয়ারিতে।
আরো সহায়তা চাওয়া হয়েছে : রিজার্ভ সংকট মোকাবেলায় সরকার আইএমএফ ছাড়াও বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) মতো বড় উন্নয়ন সহযোগীর কাছে বাজেট সহায়তা চেয়ে চিঠি দিয়েছে। সব মিলিয়ে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে বাজেট সহায়তা বাবদ ৯৭০ কোটি ডলার চাওয়া হয়েছে। বাংলাদেশি টাকায় এর পরিমাণ ৯৮ হাজার ৬৩৪ কোটি ৯৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ১০০ কোটি ডলার বাজেট সহায়তা পেতে গত জুন মাসে চিঠি দিয়েছিল অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ। চলতি মাসের ১২ তারিখ ঢাকা সফর করেন বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্টিন রেইজার। সফরকালে তিনি অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশকে বাজেট সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।
এর আগে গত মে মাসে এডিবির কাছে ১০০ কোটি ডলার বাজেট সহায়তা চেয়ে চিঠি দিয়েছিল অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। এডিবি সহায়তা করতে রাজি হয়েছে। এখন চলছে দর-কষাকষি। আগামী মার্চ মাসে এডিবির বোর্ডসভায় এই ঋণ অনুমোদন করা হতে পারে।
জাইকার কাছেও ৭০ কোটি ডলার বাজেট সহায়তা চেয়েছে সরকার। গত জুলাই মাসে জাইকার প্রেসিডেন্ট আকিহিকো তানাকা ঢাকা সফর করেন। সফরকালে তিনি সচিবালয়ে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। তখন অর্থমন্ত্রী জাইকার কাছে বাজেট সহায়তা চান।
সোর্স : কালের কন্ঠ