বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকার সাড়ে ৫ মাসে (১ জুলাই-১৫ ডিসেম্বর) ঋণ নিয়েছে ৪৯ হাজার ১৭ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ না নিয়ে বরং ফেরত দিয়েছিল ৬ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা। এ হিসাবে আলোচ্য সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫৬ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ায় এক দিকে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে যাচ্ছে, অপর দিকে উদীয়মান মূল্যস্ফীতির চাপ আরো বেড়ে যাচ্ছে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর গতকাল মঙ্গলবার নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার অর্থ হলো টাকা ছাপিয়ে ঋণ নেয়া। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ অর্থকে হাইপাওয়ার মানি বলে। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক টাকা ছাপিয়ে বাজারে ছাড়লে চারগুণেরও বেশি প্রভাব পড়ে। এটা দীর্ঘ মেয়াদে মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেবে। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ পরিহার করা ভালো। তিনি বলেন, ব্যাংকগুলোর এখন তারল্য সঙ্কট রয়েছে। সরকার এই মুহূর্তে ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে ঋণের সুদহার আরো বেড়ে যেত। আর এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অতিমাত্রায় ঋণ নেয়ায় স্বল্পকালীন তেমন প্রভাব পড়বে না, তবে দীর্ঘ মেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সরকার এক দিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অতিমাত্রায় ঋণ নিচ্ছে, অপর দিকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর কিছু অর্থ পরিশোধ করছে। এর ফলে ১ জুলাই থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাত থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে ৩১ হাজার ৯৭২ কোটি টাকা। যেখানে আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১৯ হাজার ৬৩৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ আলোচ্য সময়ে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণ বেড়েছে ১২ হাজার ৩৩৬ কোটি টাকা, যা শতকরা হিসাবে প্রায় ৬৩ শতাংশ। আর এ সুবাদে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারের ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ২ হাজার ১৫৮ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ২ লাখ ২১ হাজার ৭৫১ কোটি টাকা।
বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অতিরিক্ত ঋণ নেয়ার বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সরকারের টাকার সঙ্কট দেখা দিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে জোগান দেয়া হয়। এতে বাজারে টাকার প্রবাহ বেড়ে যায়। টাকার প্রবাহ বেড়ে গেলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘোষিত মুদ্রানীতি কার্যকারিতা হারায়। তারা বলেন, কাক্সিক্ষত হারে রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। কমছে না সরকারের ব্যয়। বাধ্য হয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া হচ্ছে। এজন্য রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে এবং অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমিয়ে আনতে হবে। অন্যথায় মূল্যস্ফীতি আরো বেড়ে গেলে মানুষের দুর্ভোগও বেড়ে যাবে। বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে বাজারে সরাসরি মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে যায়। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থ হট মানি এক টাকা ছাড়লে ৪ গুণ মুদ্রা সরবরাহ বাড়ায়। আর মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে গেলে তা মূল্যস্ফীতিকে আরো উসকে দেয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, দেশী-বিদেশী পুঞ্জীভূত ঋণ বেড়ে যাওয়ায় বেড়ে যাচ্ছে সুদব্যয়। প্রতি বছরই বেড়ে যাচ্ছে ঋণ পরিশোধের ব্যয়। বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, সরকারের রাজস্ব ব্যয় বাড়ছে। কিন্তু যে হারে ব্যয় বাড়ছে সেই হারে আয় বাড়ছে না। এতে ঘাটতি বাজেট বাড়ছে। আর ঘাটতি বাজেট বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংক খাতের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে। উচ্চ সুদে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেয়ার পাশাপাশি ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেয়ায় প্রতি বছরই বাড়ছে সুদব্যয়। চলতি অর্থবছরের বাজেটে সুদ পরিশোধের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮০ হাজার ৩৯৪ কোটি টাকা, যা আগের বছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ছিল ৬৮ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। এ সুদব্যয় অনুন্নয়ন বাজেটের একক খাত হিসেবে সর্বোচ্চ ১৯ দশমিক ২ শতাংশ, যা চলতি অর্থবছরেও একক খাত হিসেবে সর্বোচ্চ ছিল ১৮ দশমিক ১ শতাংশ। এ হিসেবে এক বছরে ঋণ পরিচর্যা বাবদ সুদব্যয় বাড়ছে ১১ হাজার ৭৯৪ কোটি টাকা, যা শতকরা হিসেবে প্রায় ১৭ দশমিক ১৪ শতাংশ। সুদব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সরকার ব্যাংকব্যবস্থা থেকে যে হারে ঋণ নিচ্ছে তার বেশির ভাগ অংশই পরিশোধ করতে হচ্ছে ঋণের সুদ পরিশোধে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সরকারের ব্যয় নির্বাহের জন্য লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। এনবিআরের সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত অক্টোবরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রাজস্ব আদায় কমেছে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা। এর অন্যতম কারণ আমদানি শুল্ক কমে যাওয়া। ডলার সঙ্কটের কারণে ব্যবসায়ীরা কাক্সিক্ষত হারে এলসি খুলতে পারছে না। এতে পণ্য আমদানির জন্য এলসি খোলার হার চার ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে। গত বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে পণ্য আমদানি ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল যেখানে ৪৮ শতাংশ, সেখানে এবার একই সময়ে পণ্য আমদানির প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ১২ শতাংশ। পণ্য আমদানি কমে যাওয়ায় আমদানি শুল্ক কমে গেছে।