বছরজুড়ে গ্যাসসংকট, ঘন ঘন লোড শেডিং, জ্বালানি তেল ও গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে ব্যাপক আলোচিত ছিল বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত। চলতি বছরই পায়রা ও রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র উদ্বোধনসহ শতভাগ বিদ্যুতায়নের মাইলফলক অর্জিত হলেও এই সাফল্য চাপা পড়ে যায় দেশজুড়ে ব্যাপক লোড শেডিংয়ে। সব মিলিয়ে এ বছর সাফল্যের চেয়ে ব্যর্থতার পাল্লা ভারী বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে।
লোড শেডিংয়ে নাকাল সারা দেশ
শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণার পর দেশে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের কথা থাকলেও বাস্তবে হয়েছে এর উল্টোটি।
বিজ্ঞাপন
বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় জুলাই থেকে স্পট মার্কেট (খোলাবাজার) থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি বন্ধ করে দেয় সরকার। এতে বেশ কিছু গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র বন্ধ হয়ে যায়। পাশাপাশি জ্বালানি সাশ্রয়ে ব্যয়বহুল তেলভিত্তিক কিছু বিদ্যুেকন্দ্রও বন্ধ রাখে সরকার। এতে গত বছরের টানা পাঁচ-ছয় মাস দেশ লোড শেডিংয়ে বিপর্যস্ত ছিল। রাজধানীতে গড়ে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা, বিভাগীয় ও জেলা শহরে ৮-১০ ঘণ্টা লোড শেডিং ছিল। গ্রাম পর্যায়ে লোড শেডিংয়ের প্রভাব আরো ভয়াবহ ছিল। লোড শেডিংয়ের সময় প্রচণ্ড দাবদাহ থাকায় প্রচণ্ড গরমে বেশ দুর্ভোগ পোহায় দেশের মানুষ। শিল্প-কারখানার উৎপাদনও ব্যাহত হয়। রপ্তানির গতি কমে যায়।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সরকার জ্বালানি সাশ্রয়ে ১৯ জুলাই থেকে সারা দেশে দিনে একবার এক ঘণ্টা লোড শেডিং করার ঘোষণা দেয়। কিন্তু সূচিভিত্তিক লোড শেডিংয়ের কথা জানানো হলেও তা ভেঙে পড়ে শিগগিরই। পরবর্তী সময়ে এলাকাভিত্তিক সপ্তাহে এক দিন শিল্প-কারখানাও লোড শেডিংয়ের আওতায় নিয়ে আসা হয়। সরকারি-বেসরকারি অফিসের কর্মঘণ্টা কমানো হয় এক ঘণ্টা। এত কিছুর পরও কমেনি লোড শেডিং। ঘোষণার সময় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, সেপ্টেম্বর থেকে কেটে যাবে লোড শেডিং। কিন্তু নভেম্বর পর্যন্ত লোড শেডিং ছিল। শীতের আগমনে নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে কমে যায় লোড শেডিং।
৪ অক্টোবর জাতীয় গ্রিড বিপর্যয়ের কারণে টানা চার-পাঁচ ঘণ্টা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন ছিল রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ অঞ্চলসহ দেশের অর্ধেক অংশ। কোথাও কোথাও ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ ছিল না। দীর্ঘ সময় টানা বিদ্যুত্হীন থাকায় দুর্ভোগ পোহায় কোটি কোটি মানুষ।
রাজধানীর একটি অংশে বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কম্পানি লিমিটেড (ডেসকো)। ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কাওসার আমীর আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বছরের লম্বা একটা সময় আমাদের বাধ্য হয়েই শিডিউল করে লোড শেডিং দিতে হয়েছিল। বিদ্যুৎ উৎপাদন স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় কিছুটা কমানো হয়েছিল। এতে আমরা চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ দিতে পারিনি। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক। আমাদের বিতরণ এলাকায় কোনো লোড শেডিং নেই। ’
গ্যাসসংকটে শিল্পোৎপাদন অর্ধেকে নামে
দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন কমে যাওয়া এবং স্পট মার্কেট এলএনজি আমদানি বন্ধ রাখায় শিল্প-কারখানা, সিএনজি স্টেশন, আবাসিক খাতসহ সব ক্ষেত্রে গ্যাসের তীব্র সংকট দেখা দেয়। দীর্ঘ সময় ধরে চলা এ সংকটের কারণে কমে গিয়েছিল শিল্প-কারখানার উৎপাদন। এর মধ্যে সিরামিক, ইস্পাত ও টেক্সটাইল খাতের উৎপাদন প্রায় অর্ধেকে নেমে আসে। শীতে বিদ্যুেকন্দ্রে গ্যাসের চাহিদা কিছুটা কমে যাওয়ায় গ্যাসসংকট কিছুটা কমেছে। তবে এখনো রাজধানীসহ দেশের কোথাও কোথাও চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত গ্যাস মিলছে না। শিল্প-কারখানাগুলো এখনো তাদের চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস পাচ্ছে না বলে উদ্যোক্তাদের অভিযোগ।
বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমইএ) সভাপতি মো. সিরাজুল মোল্লা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সিরামিক শিল্পটিই মূলত গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। গত এক-দেড় মাস আগেও টানা তিন-চার মাস গ্যাসসংকটে প্রায় ৫০ শতাংশ সিরামিক পণ্য উৎপাদন বন্ধ ছিল। এতে ব্যাংকের সুদ, কর্মচারীদের বেতন, বিদ্যুৎ বিলসহ সব মিলিয়ে আমরা বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মধ্যে ছিলাম। এখন গ্যাসসংকট আগের তুলনায় কিছুটা কমেছে, তবে এলাকাভেদে বিভিন্ন কারখানায় এখনো গ্যাসসংকট রয়েছে। ’
জ্বালানি তেল ও গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। এতে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে (বিপিসি) বিপুল পরিমাণ লোকসান দিতে হয়। লোকসান কমাতে গত ৫ আগস্ট জ্বালানি তেলের দাম এক ধাক্কায় ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এক লিটার ডিজেল ও কেরোসিন ৮০ টাকা থেকে বেড়ে ১১৪ টাকা, পেট্রল ৮৬ টাকা থেকে বেড়ে ১৩০ টাকা এবং অকটেন ৮৯ টাকা থেকে বেড়ে ১৩৫ টাকা হয়। দাম বাড়ানোর ২৩ দিনের মাথায় এসব জ্বালানি তেল লিটারপ্রতি পাঁচ টাকা কমানো হয়।
৫ জুন পাইপলাইনে সরবরাহ করা প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের পাইকারি দাম ৯ টাকা ৭০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১১ টাকা ৯১ পয়সা করেছে বিইআরসি, যা গত জুন মাস থেকে কার্যকর। রান্নার গ্যাসের জন্য দুই চুলার (ডাবল বার্নার) মাসিক বিল ৯৭৫ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১০৮০ টাকা। এক চুলার মাসিক বিল ৯২৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯৯০ টাকা করা হয়েছে। আর প্রিপেইড মিটারে প্রতি ইউনিটের খরচ ১২ টাকা ৬০ পয়সা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৮ টাকা।
২১ নভেম্বর বিদ্যুতের পাইকারি পর্যায়ে দাম বেড়েছে ১৯.৯২ শতাংশ। ইউনিটপ্রতি পাঁচ টাকা ১৭ পয়সা থেকে বেড়ে ছয় টাকা ২০ পয়সা নির্ধারণ করেছে বিইআরসি। পাইকারিতে দাম বাড়ায় বিতরণ কম্পানিগুলোও গ্রাহক পর্যায়ে মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছে। এ নিয়ে ৮ জানুয়ারি গণশুনানি করবে বিইআরসি।
জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বাড়ার পর সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর গণপরিবহনে ভাড়া বেড়েছে। পরিবহন খরচ বাড়ায় বাজারে নিত্যপণ্যের দামও বেড়েছে। কৃষি, শিল্প উৎপাদনসহ এই তেলের মূল্যবৃদ্ধি অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। গ্যাসের দাম বাড়ায় বাসাবাড়িতে রান্নার খরচ ও শিল্প-কারখানায় উৎপাদন খরচ বেড়েছে।
পায়রা ও রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র উদ্বোধন
পটুয়াখালীতে দেশের বৃহৎ পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় ২১ মার্চ। এদিন তিনি দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণাও দেন।
বাগেরহাটে বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের যৌথ বিনিয়োগে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির একটি ইউনিট গত সেপ্টেম্বরে উদ্বোধন করা হয়। সম্প্রতি কেন্দ্রটি বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করেছে।
ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চল গ্রিড লাইনে যুক্ত
পদ্মার ওপর দিয়ে আমিনবাজার-গোপালগঞ্জ ৪০০ কেভি বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন গত ১৫ ডিসেম্বর চালু হয়েছে। গ্রিড লাইনটি সম্পূর্ণ চালু হওয়ার ফলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের দুটি বৃহৎ বিদ্যুেকন্দ্র, ১৩২০ মেগাওয়াট পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও ১৩২০ মেগাওয়াট রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ঢাকা নগরে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের সুবিধা হবে। রামপালের প্রথম ইউনিটের উৎপাদিত বিদ্যুতের মধ্যে ৪০০ মেগাওয়াট ঢাকায় সরবরাহ হচ্ছে। বাকিটুকু খুলনা অঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ হচ্ছে।
সোর্স : কালের কন্ঠ