নরসিংদীর রায়পুরার মেয়ে হাজেরা বেগম। বছর আড়াই আগে স্বামী তাঁকে ফেলে নিরুদ্দেশ হন। বাসাবাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে তিন শিশু ছেলের খাবার জোটাতে পারছিলেন না। নিরুপায় হাজেরা সন্তানদের বোনের কাছে রেখে পাড়ি জমান সৌদি আরবে। আশা ছিল, অভাব ঘুচবে। ভরপেট খেতে পাবে ছেলেরা, মানুষ হবে।
হাজেরা আজ স্বপ্ন পূরণের ঊর্ধ্বে। তিনি মারা গেছেন। মৃত্যুর সনদে লেখা আত্মহত্যা। তাঁর ছোট ছেলে বাইতুলের বয়স আড়াই বছর। মা মারা গেছেন, তা বোঝার বয়স হয়নি। বড় ছেলে রাহাতের বয়স ৯ বছর। মেজো ছেলে সিফাতের বয়স ৮। অনাথ এই তিন ভাই এখন আশ্রয়হীন।
হাজেরাসহ চলতি বছরের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ১০৯ নারীকর্মীর মরদেহ দেশে এসেছে, যাঁরা বিদেশ গিয়েছিলেন চাকরিতে। এ বছর মোট ৩ হাজার ২২২ জন কর্মীর মরদেহ এসেছে। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড সূত্রে তাঁদের ২ হাজার ৯৫২ জনের নথি পেয়েছে সমকাল। তাতে বিস্তারিত ঠিকানা, পাসপোর্ট নম্বর, জন্মতারিখ ও মৃত্যুর কারণ রয়েছে।
এসব নথি বিশ্নেষণে দেখা যায়, ১০৯ নারীর মধ্যে ৩৬ জনের অপমৃত্যু হয়েছে। ২২ জনের মৃত্যু আত্মহত্যায়। খুন হয়েছেন দু’জন। কর্মস্থলে দুর্ঘটনা, আগুনে ও বিদ্যুৎস্পর্শে ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে। পাঁচজনের প্রাণ গেছে সড়ক দুর্ঘটনায়। একজনের মৃত্যুর কারণ অজ্ঞাত।
বাকি ৭৩ নারীর স্বাভাবিক মৃত্যুর সনদ এসেছে। এ চিত্রকে ভয়াবহ বলছেন নারী শ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম। তিনি সমকালকে বলেছেন, বারবার চেয়েও সরকারের কাছে এসব তথ্য পাইনি। বিদেশ যাওয়া নারীকর্মীর ৬০ শতাংশই ‘সিঙ্গেল মাদার’। স্বামীর সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের কারণে সন্তানের ভরণপোষণ জোগাতে বিদেশ যান। একজন প্রবাসী মায়ের মৃত্যুতে সন্তানরা সর্বহারা হয়। ক্ষতিপূরণের টাকার ভাগ পেতে আত্মীয়রা কলহ করলেও সন্তানের দায়িত্ব নিতে চান না। কন্যাসন্তানদের ১২-১৩ বছর বয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়।
প্রবাসী পুরুষকর্মীর পিতৃহারা অনাথ সন্তানদের জীবনও একই রকমের কষ্টের। পুরুষকর্মীদের বিধবা স্ত্রীদের জীবন সবচেয়ে দুর্বিষহ। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের এক কর্মী, যিনি মারা গেছেন মালয়েশিয়ায়। তাঁর ২৭ বছর বয়সী স্ত্রী সমকালকে জানান, দুই সন্তান নিয়ে কোনোমতে বেঁচে আছেন। মালয়েশিয়ার কোম্পানি ও বাংলাদেশ সরকার ৫ লাখ ৮৫ হাজার টাকা দিয়েছে। এটাই সম্বল। তা দিয়ে সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন। কিন্তু আত্মীয়দের ধারণা, কোটি টাকা পেয়েছেন। টাকার ভাগ চেয়ে দেবর-ভাশুররা চাপ দিচ্ছেন। পরিচিত পুরুষরা বিয়ের নামে কুপ্রস্তাব দিচ্ছে। শুধু টাকার কষ্ট নয়, সম্মানেরও নিরাপত্তা নেই।
নারী শ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক আরও বলেছেন, বিধবা নারীর সঙ্গে এ ঘটনা অহরহ ঘটে। বিদেশে মারা যাওয়া নারী ও পুরুষ- দুই ধরনের কর্মীর সন্তানই দেশে কষ্ট থাকে। মৃত নারীকর্মীর স্বামীরা ক্ষতিপূরণের টাকা পেয়ে নতুন সংসার করেন। ফলে সন্তানরা বাবাহারাও হয়, যা ভয়াবহ সামাজিক সমস্যা। সরকারের সহায়তা প্রয়োজন। সন্তানদের শিক্ষাবৃত্তি ও নিরাপত্তা দেওয়া জরুরি।
প্রবাসী মায়ের মৃত্যুতে সন্তানের ভয়াবহ পরিণতির জ্বলন্ত উদাহরণ ঝিনাইদহ সদরের মোছা. পারভীনের ১৩ বছর বয়সী মেয়ে রিতু। গত ৩০ মে সৌদি আরব থেকে দেশে আসে ৩৫ বছর বয়সে মারা যাওয়া পারভীনের মরদেহ। তাঁর মৃত্যুর কারণ অজ্ঞাত। দেশেও মরদেহের ময়নাতদন্ত হয়নি। পারভীনের স্বামী বছির আহম্মেদ স্ত্রীর দাফনের জন্য ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড থেকে ৩৫ হাজার টাকা পেয়েছেন। পরে ক্ষতিপূরণ বাবদ আরও ৩ লাখ টাকা পান। বছির মাস চারেক আগে দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন।
বছির ও পারভীনের বড় মেয়ে রিতু ক্লাস ফোরে পড়ত। ১৩ বছর বয়সে তাকে গত সেপ্টেম্বরে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। বছির সমকালকে বলেছেন, ‘জোগালির কাজ করি। শরীরটাও ভালো না। মেয়েকে কে দেখবে? তাই শাশুড়ির কথায় মেয়েকে বিয়া দিয়া দিছি।’ ছোট মেয়ে রিতির বয়স ৬ বছর। সে প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। বছিরের দাবি, ছোট মেয়েকে দেখাশোনা করেন সৎমা। স্ত্রীর মৃত্যুতে পাওয়া ক্ষতিপূরণের টাকার কিছুটা খরচ হয়েছে বড় মেয়ের বিয়েতে। ছোট মেয়ের নামে ২ লাখ টাকা রেখেছেন।
সংসারের সচ্ছলতার জন্য বিদেশে চাকরিতে গিয়ে গঞ্জনার শিকার হন নারীরা। হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের তাসলিমা আকতার গত এপ্রিলে ওমানে আত্মহত্যা করেন। এর মাত্র চার মাস আগে তিনি গৃহকর্মীর কাজে বিদেশ যান। তাসলিমার মা আবিদা খাতুন সমকালকে বলেছেন, মেয়েকে খুব খারাপ কথা বলেছিল স্বামী। বিদেশে গিয়ে পরকীয়ার অপবাদ দিয়েছিল। মাত্র ৩০ বছর বয়সে মেয়েটার জীবন শেষ হয়ে গেছে।
মাঠ পর্যায়ে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন কর্মসূচির নির্বাহী পরিচালক শাকিরুল ইসলাম সমকালকে বলেছেন, নারীকর্মীরা বিদেশ গিয়ে ‘খারাপ কাজ’ করেন- এমন ভ্রান্ত ধারণা সমাজে রয়েছে। বিদেশ থেকে পাঠানো তাঁর কষ্টার্জিত বেতন স্বামীসহ পরিবার প্রতি মাসে নিয়েছে। কিন্তু নারীকর্মীটি দেশে ফেরার পর স্বামী গ্রহণ না করে দুশ্চরিত্রা অপবাদ দিয়েছে। নারীকর্মীদের সন্তানদের নিয়মিত কটু কথা শুনতে হয়। তাঁদের বলা হয়, ‘তোর মা বিদেশে খারাপ কাজ করে।’ এগুলো আত্মহত্যার কারণ।
প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদ বলছেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো মুনাফার আশায় অপ্রশিক্ষিত নারীদের বিদেশ পাঠায়। তাঁরা যে দেশে যাচ্ছেন, সেই দেশের ভাষা জানেন না। খাবারের সঙ্গে অভ্যস্ত নন। বিদেশে গিয়ে খুব একাকিত্বে ভোগেন। প্রশিক্ষণ না থাকায় কাজও জানেন না। ফলে কর্মক্ষেত্রেও চাপে থাকেন। এসব কারণে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে।
বরগুনার বামনার মাহফুজা বেগমের মরদেহ গত ১৯ জানুয়ারি দেশে আসে। তাঁর বয়স ছিল ৩২। তিনি তিন দফায় সাত বছর সৌদিতে ছিলেন। তাঁর ১৫ বছর বয়সী মেয়ের নাম মাফিয়া বেগম। স্বামী ফিরোজ মিয়ার সঙ্গে আগেই ছাড়াছাড়ি হয়েছে।
মাহফুজার বোন শিল্পী আখতার জানান, মাফিয়ার ভরণপোষণ দূরে থাক, খবরও নেন না বাবা। শর্ত দিয়েছিলেন মাহফুজার মৃত্যুতে পাওয়া ৩ লাখ ৩৫ হাজার টাকার অর্ধেক দিলে মেয়ের দায়িত্ব নেবেন। গার্মেন্টকর্মী তিনি আরও জানালেন, ভাগ্নিকে রক্ষায় নিজের কাছে রেখেছেন। ৩ লাখ টাকা মাফিয়ার নামে সঞ্চয় করেছেন। কিন্তু মাফিয়ার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে অভাবে। আগে বিদেশ থেকে মাহফুজার পাঠানো টাকায় মেয়ের লেখাপড়া চলত।
শিল্পী বলেন, ‘আমি গার্মেন্টে কাজ করি। কয় টাকা বেতন পাই? আমার নিজেরও দুইটা সন্তান আছে। মাফিয়ারে মায়ের মতো আগলে রাখছি। কিন্তু লেখাপড়া করামু এই সাধ্য আমার নাই। মেয়েটা আরেকটু বড় হলে বিয়া দিয়া দিমু।’
মৃত পুরুষকর্মীর সন্তানদের কষ্টও অভিন্ন। বাহরাইনে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় মাত্র ৩২ বছর বয়সে মারা যান সুনামগঞ্জের ধর্মপাশার মোহাম্মদ আনোয়ার। জানুয়ারিতে মরদেহ আসে দেশে। তাঁর ২৫ বছর বয়সী স্ত্রী জ্যোৎস্না বেগম জানান, দুই ও চার বছর বয়সী দুটি সন্তান রয়েছে তাঁদের। স্বামী বেঁচে থাকতে প্রতি মাসে টাকা পাঠাতেন। সচ্ছল ও সুখের সংসার ছিল। এখন পদে পদে কষ্ট। ছেলে দুটিকে কীভাবে বড় করবেন ভেবে পান না। ক্ষতিপূরণের ৩ লাখ টাকায় কতদিন চলবে।
কথা হয় প্রতিবেদনের শুরুতে উল্লেখ করা হাজেরার বড় ছেলে ৯ বছর বয়সী রাহাতের সঙ্গে। সে ও তার ভাই সিফাত স্থানীয় জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম গনেরগাঁও শাহি ঈদগাহ মাদ্রাসার ছাত্র। রাহাত জানাল, মাদ্রাসায় অন্য শিশুদের জন্য বাবা-মায়েরা ভালো খাবার নিয়ে আসেন। তাদের দুই ভাইয়ের কেউ নেই। মাদ্রাসার এতিমখানা থেকে যা দেওয়া হয়, তাই খেতে হয়।
হাজেরার মা-বাবা মারা গেছেন অনেকে আগেই। বড় বোন নাদিরা বেগমের সঙ্গে নরসিংদীর গাবতলীতে থাকতেন। হাজেরার স্বামীর নাম নূর মোহাম্মদ। বাড়ি কিশোরগঞ্জে। আগের বিয়ে ও সংসারে চার সন্তানের কথা লুকিয়ে বছর দশেক আগে হাজেরাকে বিয়ে করেন। আড়াই বছর ধরে হাজেরার তিন ছেলের ভরণপোষণ দূরে থাক, খোঁজখবরও নেন না।
বড় বোন নাদিরা বেগম বলেন, হাজেরা সৌদি আরব যাওয়ার পর গত ১০ জুলাই প্রথম ফোনে কথা হয়। শেষ কথা হয় ১৭ জুলাই রাত ১টার দিকে। হাজেরা জানিয়েছিলেন, ভাষা বোঝেন না। খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট হচ্ছে। সন্তানদের জন্য যোগাযোগের জন্য গৃহকর্ত্রী ইন্টারনেট সংযোগ দিচ্ছেন না। নাদিরার ভাষ্য, তাঁর বোন আত্মহত্যা করার মতো মেয়ে নন।
হাজেরা বিদেশ যাত্রার নথি ঘেঁটে দেখা যায়, তাতেও অনিয়ম হয়েছে। রিক্রুটিং এজেন্সি গালফ ওভারসিজ (আর.এল-৮২৫) হাজেরার ভিসা সংগ্রহ করে। কিন্তু তাঁর নামে বিএমইটি থেকে ছাড়পত্র সংগ্রহ করে জাবির ইন্টারন্যাশনাল (আর.এল-৭২৩) নামের আরেক এজেন্সি। নাদিরা জানান, দুই এজেন্সিতে ধরনা দিয়েও লাভ হয়নি। ক্ষতিপূরণ দূরে থাক, সামান্য সহযোগিতা পাননি।
হাজেরার বড় দুই ছেলে মাদ্রাসায় থাকলেও আড়াই বছরের বাইতুল থাকে খালার কাছে। কারখানায় কাজ করে নাদিরা বেগম নিজের দুই সন্তানের খাবার জোগান খুব কষ্টে। বাইতুলের তিন কুলে কেউ নেই। তাকে কীভাবে মানুষ করবেন, তা ভেবে পান না নাদিরা।
প্রবাসী কর্মীদের সহায়তার দায়িত্বে থাকা সরকারি প্রতিষ্ঠান ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক (ডিজি) হামিদুর রহমান সমকালকে বলেন, কেন আমাদের এত কর্মী মারা যাচ্ছে তা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। কারণ জানা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। প্রবাসী কর্মীর সন্তানদের জন্য শিক্ষাবৃত্তি ও সহায়তা রয়েছে। আরও কী করা যায়, তা সরকার দেখবে।
সোর্স : সমকাল