বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি করা হয়। আমদানি করা হয় শিল্পের কাঁচামাল। এ কাঁচামাল দিয়ে পণ্য উৎপাদন করে স্থানীয় বাজারে চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিদেশে রফতানি করা হয়। আমদানিনির্ভর অর্থনীতিতে তাই সারা বছরই উত্তাপ ছড়ায় বৈদেশিক মুদ্রা মার্কিন ডলার। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কমে যাওয়ায় সারা বছরই অস্থির থাকে ডলারের মূল্য। চলতি বছরে ডলারের মূল্য রেকর্ড ভেঙে রেকর্ড গড়ে। প্রথমবারের মতো সেঞ্চুরি পার করে ডলারের মূল্য। একপর্যায়ে খোলাবাজারে ১২০ টাকা ছাড়িয়ে যায় প্রতি ডলার। ডলার মূল্যের এ উত্তাপের কারণে পণ্যের দামও বেড়ে যায়। এতে বেড়ে যায় মূল্যস্ফীতি। ভোগান্তিতে পড়ে সাধারণ মানুষ। শুধু তাই নয়, ডলারের সরবরাহ কম থাকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ থেকে ডলার বিক্রি বেড়ে যায়। এতে কমে যায় বৈদেশিক মুদ্রার মজুদও।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, চলতি বছরের শুরু থেকেই অর্থনীতিকে শাসন করতে থাকে এ মার্কিন ডলার। তবে, রেমিট্যান্স-প্রবাহ ভালো থাকায় অর্থনীতিতে তেমন একটা প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি এ বৈদেশিক মুদ্রা। কিন্তু করোনার দুই বছরে আমদানিকৃত পণ্যমূল্যের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পরিশোধ না করায় অর্থাৎ বাকি রাখায় চলতি বছরের শুরু থেকেই পরিশোধের চাপ বাড়তে থাকে। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় বেড়ে যায় পণ্যের আমদানি ব্যয়ও। সবমিলে একপর্যায়ে বাকি পরিশোধ ও চলতি দায় মিলে আমদানি ব্যয় আট বিলিয়নের ঘরে পৌঁছে। কিন্তু রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স মিলে যে পরিমাণ ডলারের আন্তঃপ্রবাহ হয় তা থেকে ব্যয় তিন বিলিয়ন ডলার বেড়ে যায়। এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রার চাপ বেড়ে যায়। আর এর প্রভাবেই ব্যাংকে ও খোলাবাজারে ডলারের দাম বাড়তে থাকে। দেশে প্রথমবারের মতো খোলাবাজারে ডলারের দাম সেঞ্চুরি অতিক্রম করে গত ১৭ মে। ওই দিন খোলাবাজারে ডলারের দাম বেড়ে ১০০ টাকা অতিক্রম করে। এর পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের এ অস্থিরতার কারণ অনুসন্ধানে নামে। ফলে কয়েক দিন ডলারের দাম আবার ১০০ টাকার নিচে নেমে আসে। কিন্তু ১৭ জুলাই থেকে আবারো খোলাবাজারে ডলারের দাম ১০০ টাকা অতিক্রম করে। এর পর একটানা ১০ আগস্ট পর্যন্ত বাড়তে থাকে। গত ২৭ জুলাই এসে খোলাবাজারে প্রতি ডলারের মূল্য বেড়ে হয় ১১২ টাকা। আর ১০ আগস্ট তা আরো বেড়ে হয় ১২০ টাকা।
এ দিকে খোলাবাজারে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে ব্যাংকেও ডলারের দাম বাড়তে থাকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেয়া আন্তঃব্যাংক ডলারের দর অকার্যকর হয়ে পড়ে। গত ২৭ জুলাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেয়া দর ছিল যেখানে ৯৪ টাকা ৭০ পয়সা, সেখানে ব্যাংকে ব্যাংকে ডলার বিক্রি হয় ১১০ টাকায়। একপর্যায়ে ব্যাংকেও আমদানিতে ডলারের দাম ১১৫ টাকা উঠে যায়। স্থানীয় বাজারে ডলারের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় রেমিট্যান্সেও ডলারের মূল্যপ্রবাহ বেড়ে যায়। প্রবাসীদের কাছ থেকে আহরিত রেমিট্যান্সের মূল্য হয় ১১৩ টাকা।
কিন্তু রেমিট্যান্সের প্রবাহ হঠাৎ করে হোঁচট খায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকারদের ডেকে ডলারের একক দর নির্ধারণ করতে বলা হয়। বলা যায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেয়া দরই ব্যাংকাররা ১১ সেপ্টেম্বর একক দর হিসেবে ঘোষণা করে। ওই দিন রেমিট্যান্সের ডলারের মূল্য বেঁধে দেয় ১০৮ টাকা। রফতানি আয় নগদায়ন করার ঘোষণা দেয়া হয় সর্বোচ্চ ৯৯ টাকা দরে। আর আমদানিতে একক দর নির্ধারণ করা হয় সর্বোচ্চ ১০৪ টাকা ৫০ পয়সা। কিন্তু আমদানিতে একক দর কার্যকর হয় না। ১১ সেপ্টেম্বর ব্যাংকভেদে আমদানিতে ডলার লেনদেন হয় সর্বোচ্চ ১০৯ টাকা দরে। যদিও করপোরেট ডিলিংয়ের নামে আরো বেশি মূল্য ডলার লেনদেন করা হয়। একপর্যায়ে রেমিট্যান্সের ডলারের মূল্য কমতে কমতে ১০৬ টাকায় নামানো হয়। এতে রেমিট্যান্স-প্রবাহ কমতে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত জুন মাসে যেখানে রেমিট্যান্স আসে ১৮০ কোটি ডলার, সেখানে জুলাই মাসে এক লাফে বেড়ে হয় ২০১ কোটি ডলার। আগস্টে আরো বেড়ে হয় ২০৩ কোটি ডলার। কিন্তু রেমিট্যান্সের ডলারের মূল্য বেঁধে দেয়ায় এক মাসের ব্যবধানে সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্সের প্রবাহ ৫০ কোটি ডলার কমে ১৫০ কোটি ডলারে নেমে যায়। এর পর থেকেই আর রেমিট্যান্সের প্রবাহ ১৬০ কোটি ডলারের নিচেই অবস্থান করছে।
এক দিকে ডলারের সরবরাহ কমে যায়, অপর দিকে বেড়ে যায় ডলারের মূল্য। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ থেকে শুধু অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনাকাটায় ডলার সরবরাহ করতে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে প্রায় ৬১০ কোটি ডলার। এ সুবাদে ওই দিন বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ৩৩ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে আসে।
ডলারের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় অর্থনৈতিক চাপ বেড়ে যায়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দোহাই দিয়ে জ্বালানি তেলের দাম এক লাফে ৫০ শতাংশের উপরে বাড়ানো হয়। ডলার সঙ্কটের কারণে জ্বালানি তেল আমদানি কমিয়ে দেয়া হয়। তরল জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে উৎপাদন কমিয়ে আনা হয়। এতে দেশে ভয়াবহ আকারে বেড়ে যায় লোডশেডিং। এক দিকে লোডশেডিংয়ের কারণে পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়, অপর দিকে ডলারের মূল্য অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় বেড়ে যায় পণ্যের আমদানি ব্যয়। সবমিলে সবধরনের পণ্যের দামই অস্বাভাবিক হারে বাড়তে থাকে। এতে দুর্ভোগে পড়ে সাধারণ মানুষ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, মূল্যস্ফীতি একপর্যায়ে সোয়া ৯ শতাংশে উঠে যায়। যদিও বিবিএসের তথ্য মতে, গত নভেম্বর শেষে ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশে নেমে আসে। কিন্তু বাজারে বাস্তবে এর কোনো প্রতিফলন নেই। এভাবেই বছরজুড়েই দেশের অর্থনীতিকে শাসন করে এ বৈদেশিক মুদ্রা ডলার।