মোহাম্মদ জাফর ইকবাল : বিমানে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটে সিট খালি থাকে, অথচ বুকিং দেয়ার সময় সিট পাওয়া যায় না। আসন সংকট কিংবা ভাড়ার তারতম্যে ফিরতে হয় যাত্রীদের। ফলে তারা দ্বারস্থ হন ট্রাভেলস এজেন্সির। নির্দিষ্ট মূল্যের চেয়ে চড়া দাম দিয়ে জরুরি প্রয়োজনে টিকিট কিনে যাত্রা করতে হয়। কিন্তু বিমানে ওঠার পর দেখা যায় যাত্রীশূন্য। ফলে যাত্রীদের মধ্যে অনেক সময় ক্ষোভ তৈরি হয় বেশিদামে টিকিট কিনে। এ ধরনের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। কীভাবে এ ধরনের অনিয়ম ঘটে চলেছে, এসবের মানে কী? এসব নিয়ে আলোচনাও হয়েছে বারবার। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বরং একই অভিযোগগুলো নিয়েই চলছে বাংলাদেশ বিমান। টিকিট পাওয়া না গেলেও গত ৬ মাসে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক রুটে পরিচালিত ফ্লাইটে ২৩ শতাংশ আসন খালি ছিলো রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী এয়ারলাইনসটির। কর্তৃপক্ষ বলছে, টেকনিক্যাল কারণে লোড ব্যালান্সিংয়ের কারণে কিছু আসন খালি রাখতে হয়।
জানা গেছে, চলতি বছরের জুন থেকে নবেম্বর পর্যন্ত গত ৬ মাসে ৬৮ টি বিদেশী গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনা করেছে বিমান। এসব ফ্লাইটে আসন সংখ্যা ছিলো ১৪ লাখ ৭৭ হাজার ৪শ ৫৬টি। এর মধ্যে টিকিট বুকিং করা হয়েছে ১১ লাখ ৩৫ হাজার ৯শ ৭৪টি, বাকি ৩ লাখ ৪১ হাজার ৪শ ৮২টি আসন খালি ছিল। সে হিসেবে আসন খালি থাকা সত্ত্বেও গড়ে ২৩ শতাংশ যাত্রী ছাড়াই ফ্লাইট পরিচালনা করা হয়েছে। অপরদিকে, সব রুটে খালি আসনের চিত্র এক নয়। বেশ কয়েকটি রুটে মাত্র কয়েকটি আসন খালি ছিলো, কয়েকটি রুটে অল্প কিছু যাত্রী নিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা করা হয়েছে। আবার বেশ কয়েকটি রুটে অর্ধেকের বেশি আসন খালি ছিল। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
গত ছয় মাসে কতগুলো টিকিট বিক্রি হয়েছে তার পরিসংখ্যান এবং যেগুলো বিক্রি হয়নি তার কারণ বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কাছে জানতে চেয়েছিলো বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। এরপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি সংসদীয় কমিটির কাছে গত ৬ মাসের টিকিট বিক্রির তথ্য তুলে ধরে প্রতিবেদন জমা দেয় বিমান। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স কখনই তার টিকিট বিক্রয় সেবা বন্ধ রাখেনি। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক স্টেশনসমূহে নিজস্ব সেলস সেন্টার থেকে বিমানের নিবেদিত কর্মীদের মাধ্যমে টিকিটিং সেবা প্রদান করে যাচ্ছে। এছাড়াও গ্লোবাল ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম এর মাধ্যমে টিকিটিং সেবা প্রদান করা হচ্ছে। এছাড়াও বিমান কলসেন্টারের মাধ্যমে টিকিট প্রদান, পুনঃইস্যু, তারিখ পরিবর্তন এবং উচ্চ শ্রেণীতে আপগ্রেডেশন সহ অন্যান্য সেবা প্রদান করা যাচ্ছে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স তার পাসিঞ্জার সার্ভিস সিস্টেম পরিবর্তনের কারণে গত ৯ অগাস্ট ২১ থেকে- ২৬ ফেব্রুয়ারী-২২ ওয়েবসাইটে টিকিট বিক্রয় সেবা বন্ধ রাখে, যা ২৭ ফেব্রুয়ারি-২২ থেকে পুনরায় চালু করা হয়। ওয়েবসাইটে টিকিট বিক্রয় সেবা সাময়িক বন্ধ হওয়ার আগে বিমান তার বিক্রিত টিকিটের অতি সামান্যই ( প্রায় ৪.৫০ % ) ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিক্রয় করত। তবে, গড়ে ২৩ শতাংশ আসন খালি রেখে ফ্লাইট পরিচালনার কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি সংস্থাটি।
সূত্র মতে, বিমানের ঢাকা-গুয়ানজু রুটে টিকিট চাহিদা অনেক বেশি। টিকিট ছাড়ার সাথে সাথেই শেষ হয়ে যায়, বেশি টাকা না দিলে পাওয়া যায় না। টিকিট বিক্রি নিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগটি দুদক পর্যন্ত গড়িয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন বিষয়টির তদন্ত করতে বিমানের কার্যালয়েও অভিযান চালায়। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হচ্ছে না।
বিমানের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ছয় মাসে ঢাকা থেকে চীনের গুয়াংজু রুটে বিমানের ফ্লাইটে আসন ছিলো ২ হাজার ৬শ ৭৫টি। যাত্রী পরিবহন করা হয়েছে ১ হাজার ৩৭ জন আর আসন খালি ছিলো ১ হাজার ৬ শ ৩৮ টি। মোট আসনের বিপরীতে ৬১ শতাংশ আসন খালি রেখেই ফ্লাইট পরিচালনা করা হয়েছে। এছাড়া মাস্কাট থেকে ঢাকা রুটে ১৭ হাজার ৬৬৫টি আসন ছিল। এর মধ্যে ৯ হাজার ২৮৫টি আসন বা ৫৩ শতাংশ ফাঁকা ছিলো। আবুধাবি-ঢাকা রুটে মোট আসনের পঁয়তাল্লিশ শতাংশই ফাঁকা ছিল। অন্যদিকে ঢাকা থেকে মাস্কাট, চট্টগ্রাম থেকে মাস্কাট, ঢাকা থেকে রিয়াদ, চট্টগ্রাম থেকে জেদ্দার ফ্লাইটগুলোতে যাত্রী বেশি ছিলো। এসব ফ্লাইটে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ আসন পূর্ণ ছিলো।
এভিয়েশন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অন্য এয়ারলাইন্সের তুলনায় বিমান পরিচালিত রুটে টিকিটের দাম কম হওয়ায় সব সময়ই চাহিদা থাকে। অথচ টিকিট পাওয়া যায় না। এমন পরিস্থিতিতে গড়ে ২৩ শতাংশ আসন খালি রেখে ফ্লাইট পরিচালনা করা অস্বাভাবিক। এর সাথে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা উচিত। এজন্যই লাভের মুখ না দেখে বিমানের হাজার হাজার কোটি টাকা লোকসান হয়। গুটিকয়েক বিমানের কর্মকর্তা ও এজেন্সির লোকজন এর সাথে জড়িত। আর ক্ষতি হচ্ছে রাষ্ট্রের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যে সব রুটে টিকিটের চাহিদা বেশি সেসব রুটের টিকিট বুকিং দেয়ার জন্য নির্দিষ্ট কয়েকটি এজেন্সিকে সুবিধা দেয় বিমান। ফলে সেই সব এজেন্সি ছাড়া টিকিট পাওয়া যায় না। টিকিটের সংকট দেখা দেয়। কিন্তু বুকিং দেয়া এজেন্সি যেসব টিকিট বিক্রি করতে পারে না নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিয়ে সেগুলোর বুকিং বাতিল করে দেয়। ফলে একদিকে টিকিটের সংকট দেখা দেয় অন্যদিকে বুকিং বাতিল করায় শূন্য আসন নিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা করতে হয় বিমানকে।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, বিমান যে সব আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করে সেসব রুটে টিকিটের চাহিদা অনেক বেশি, কিন্তু অভিযোগ পাওয়া যায় টিকিট পাওয়া যায় না। সেই বিবেচনায় ২৩ শতাংশ আসন খালি থাকা সন্তোষজনক নয়। ১০ থেকে ১৫ শতাংশ খালি থাকলে ঠিক আছে। কর্তৃপক্ষের এদিকে কঠোরভাবে নজর দেয়া উচিত।
জানা গেছে, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিমানের ও বিমানবন্দরের নানা ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়মের খবরে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। বৈঠকে বিমানযাত্রা বিলম্বিত হওয়ার বিষয়টি যাত্রীকে অবহিত করা হয় না বলেও অভিযোগ করা হয়। এ বিষয়ে বিমানকে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে।
বিমানের এক যাত্রী অভিযোগ করে বলেন, সম্প্রতি বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট (বিজি-৬০২) বোয়িং ৭৩৭ সিলেট থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা হয়। ১৬২ যাত্রী ধারণ ক্ষমতার বিমানে মাত্র ৯৭ জন ছিলেন। বিমানে খালি পড়েছিল ৬৫টি আসন। অথচ সিলেট থেকে বিমানের টিকিট চাইতে গেলে টিকিট পাননি অনেকে। পরে চড়া দাম দিয়ে ট্রাভেলস এজেন্সি থেকে যাত্রীদের অনেকে টিকিট কিনে নেন।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, মাথাভারি প্রশাসনের কারণে বিমানের এমন অব্যবস্থাপনা। শুরুতে টিকিটের মূল্য বাড়তি ধরা হয়। পরবর্তীতে সময় ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে টিকিটের মূল্য কমিয়ে আনা হয়। তখন আর যাত্রী মেলে না। যে কারণে আসন খালি থেকে যায়। তাছাড়া বিমানের অব্যবস্থাপনা কারণে যাত্রী কমার অন্যতম কারণ। কেননা, বেসরকারি এয়ারলনাইন্সগুলোর কর্মীরা দায়িত্বের সঙ্গে তাৎক্ষণিক যাত্রীদের মালামাল সংরক্ষণ ও সরবরাহ করেন। অপরদিকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কর্মীরা অনেকটা উদাসীন। তারা এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখেন না। যাত্রীদের অভিযোগ, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কর্মীরা যাত্রীদের লাগেজ ও ব্যাগেজগুলো যেনতেনভাবে ফেলে রাখেন। যাত্রীর লাগেজের ব্যাপারেও তারা যত্মশীল নন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণত এয়ারলাইন্সগুলোর যেসব রুটে আসন বেশি ফাঁকা থাকে সেখানকার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের জবাবদিহি করতে হয়। কিন্তু বিমানে এই জবাবদিহি আছে বলে মনে হয় না। এটা কখনো সেভাবে দেখা যায়নি। আসন খালি থাকার বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহির আওতায় আনা প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এবং সিইও শফিউল আজিম বলেন, ক্যাভিন ফ্যাক্টর মানে মোট আসনের কতটুকু ব্যবহার করা হবে। এটার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭৪ শতাংশ, সেখানে বিমান অর্জন করেছে ৭৭ শতাংশ। তিনি বলেন, অনেক ক্ষেত্রে টেকনিক্যাল কারণে লোড ব্যালান্সিংয়ের কারণে কিছু আসন খালি রাখতে হয়।
তবে বিমান কর্তৃপক্ষ কিসের ভিত্তিতে কেবিন ফ্যাক্টর ৭৪ শতাংশ নির্ধারণ করল সেটি নিয়েও প্রশ্ন আছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিমানের সাবেক একজন কর্মকর্তা বলেন, অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বিমানবহরে এখন সবচেয়ে বেশি এবং নতুন প্রজন্মের উড়োজাহাজ রয়েছে। তাই এই লক্ষ্যমাত্রা আরও বেশি হওয়া উচিত।
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মুজিবুল হক বলেন, বিমানে টিকিট পাওয়া যায় না। কিন্তু সিট ফাঁকা থাকে। বিমানে যারা কাজ করেন, তারা বিমানকে বাপের সম্পত্তি মনে করেন।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, ঢাকা থেকে অন্য যেসব এয়ারলাইন্স ফ্লাইট পরিচালনা করে থাকে, তারা বর্তমান প্রেক্ষাপটে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত আসন ফাঁকা থাকাকে ‘স্ট্যান্ডার্ড’ (গ্রহণযোগ্য) বলে বিবেচনা করে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স অধিক চাহিদাসম্পন্ন গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনা করে থাকে। তাই ২৩ শতাংশ আসন ফাঁকা থাকাটা উদ্বেগের। তিনি বলেন, সাধারণত অন্য এয়ারলাইন্সগুলোর যেসব গন্তব্যে আসন বেশি ফাঁকা থাকে, সেখানকার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের জবাবদিহি করতে হয়। কিন্তু বিমানে এই জবাবদিহি আছে বলে মনে হয় না। আসন খালি থাকার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনা প্রয়োজন।
সোর্স : দৈনিক সংগ্রাম