ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে এ বছর ১৯ শিক্ষার্থী নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। সব ঘটনায়ই অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। ১৪টি নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও ৯টি ঘটনায় প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে। এর মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে মাত্র দুটি ঘটনায়। চার ঘটনায় চাপে পড়ে ভুক্তভোগী অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেন। পাঁচটি ঘটনায় ভয়ে অভিযোগ দেওয়া হয়নি। এদিকে নির্যাতনে জড়িত অনেককে হল কমিটিতে পদায়ন করেছে ছাত্রলীগ।
সাধারণত প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরাই নির্যাতনের শিকার হন। তাঁরা বুঝতে পারেন না নির্যাতিত হলে কী করতে হবে। অনেকে ভয়ে মুখ খোলেন না। অনেক সময় অভিযোগ দিয়েও তুলে নিতে বাধ্য হন। নির্যাতনের শিকার হয়ে কেউ কেউ হল ছেড়ে উঠেছেন ভাড়া বাসায়। এতে নির্যাতনকারীও সুযোগ পেয়ে যায়। নির্যাতিতদের বোবাকান্না শোনার যেন কেউ নেই।
স্টুডেন্ট অ্যাগেইনস্ট টর্চারের (স্যাট) সমন্বয়ক সালেহ উদ্দিন সিফাত সমকালকে বলেন, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ভিন্নমত দমন এবং গঠনমূলক সমালোচনা বন্ধ করতে এ রকম নির্যাতন চালায়। দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ায় নিপীড়িতরা প্রশাসনের প্রতি আস্থা রাখতে পারছেন না। অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনই নির্যাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। নির্যাতনের অনেক ঘটনার খবর গণমাধ্যমে আসে না।
গত ১০ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের আবু তালিবকে ডেকে স্টাম্প দিয়ে পেটান ছাত্রলীগকর্মী শেখ শান্ত আলম, ইমদাদুল হক বাঁধন, শাহাবুদ্দিন ইসলাম বিজয় ও নাহিদুল ইসলাম ফাগুন। পরে আবু তালিব ভয়ে হল ছেড়ে দেন। এ ঘটনায় হল প্রশাসন পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করলেও আর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তালিবও হলে উঠতে পারেননি। অভিযুক্ত সবাই হল ছাত্রলীগের কমিটিতে পদ পেয়েছেন।
১৪ এপ্রিল এ এফ রহমান হলে এক অনলাইন পোর্টালের ঢাবি প্রতিনিধি রিফাত হককে মারধরের অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগ কর্মী ফারহান তানভীরের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় প্রাধ্যক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ দিলেও হল প্রশাসন থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ১৩ অক্টোবর হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ফারহান সাইফুলকে মেরে কক্ষ থেকে বের করে দেন ছাত্রলীগ কর্মী তাওহীদুল ইসলাম, মুহাম্মদ সামিন চৌধুরী, সাখাওয়াত অভি, শেখ ইমরান ইসলাম, শরিফুল ইসলাম ও মুনতাসীর হোসেন। পরে হল প্রশাসন কক্ষটি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। একই হলে ১৫ আগস্ট দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী কাজী সাকিব মিয়াকে অপদস্থ করেন ছাত্রলীগ কর্মী আবু হাসান রনি ও মশিউর রহমান শান্ত। সাকিব পরে আজিমপুরে ভাড়া বাসায় ওঠেন। তিনি আর হলে ফিরতে পারেননি। ৩০ আগস্ট একই হলে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ছয় শিক্ষার্থীকে গেস্টরুমে না যাওয়ায় নির্যাতন, মারধরের অভিযোগ ওঠে চার ছাত্রলীগ কর্মীর বিরুদ্ধে। কোনো অভিযোগ না দেওয়ায় এটি আর তদন্ত হয়নি।
বছরের প্রথম নির্যাতনের ঘটনা ঘটে বিজয় একাত্তর হলে। ২৬ জানুয়ারি গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী আকতারুল ইসলামকে অসুস্থ অবস্থায় মানসিক নিপীড়ন করায় ছয় মাসের জন্য বহিস্কার হন তিন ছাত্রলীগ কর্মী। এই হলে গত ২৬ মার্চ ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী আখলাকুজ্জামান অনিককে মারধর করায় ছয় ছাত্রলীগ নেতাকে হল থেকে স্থায়ী বহিস্কার করা হয়। ১৪ মে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ২০২০-২১ সেশনের শিক্ষার্থী মো. সিয়ামকে নির্যাতন করেন হল ছাত্রলীগের স্কুল ছাত্র উপসম্পাদক সালাউদ্দিন তারেক। গত ৮ নভেম্বর বাংলা বিভাগের রাসেল মাহমুদকে রড দিয়ে পেটান কার্যকরী সদস্য মোনাফ প্রান্ত।
সলিমুল্লাহ হলে তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী শিপন মিয়াকে নির্যাতনকারী মো. আল ইমরান, ইয়াছির আরাফাত প্লাবন ও ইয়াছিন আল শাহীন ছাত্রলীগে পদ পেয়েছেন। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি এ এফ রহমান হলে শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষার্থী মোল্লা তৈমুর রহমানকে নির্যাতন করেন হল ছাত্রলীগের সহসম্পাদক মো. রোকনুজ্জামান রোকন। গত ২৪ মে রাতে মাস্টারদা সূর্য সেন হলের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সাজ্জাদুল হককে মারধর করেন ছাত্রলীগ কর্মী মানিকুর রহমান মানিক। এসব ঘটনায় ভুক্তভোগীরা লিখিত অভিযোগ দিলেও পরে প্রত্যাহার করে নেন।
গত ১ এপ্রিল সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের রাজিমুল হককে নির্যাতন করে হল থেকে বের করে দেয় ছাত্রলীগ। পরে হল প্রশাসন তাঁকে পুনরায় হলে তোলে। ২৫ অক্টোবর রাতে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে শিক্ষার্থী সামির সাদিককে নির্যাতন করেন হল ছাত্রলীগের সহসভাপতি আহমাদুল্লাহ ও পাঠাগারবিষয়ক সম্পাদক রেজভী হাসান। পরে হল প্রশাসন তাঁকে পুনরায় সিটে তুলে দেয়।
শিক্ষার্থী নির্যাতনের বিষয়ে জানতে চাইলে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানকে বলেন, এ ধরনের নির্যাতন কোনোভাবে কাম্য নয়। সংশ্নিষ্টদের বলেছি, ঘটনা ঘটলে খতিয়ে দেখতে হবে। তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম গোলাম রব্বানী শিক্ষার্থীদের মধ্যে পারস্পরিক সহমর্মিতা বাড়ানোর কথা বলেন এবং অভিযোগ দায়ের হলে হল কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন।
প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির আহ্বায়ক বিজয় একাত্তর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. আব্দুল বাছির বলেন, কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা রোধে প্রথম বর্ষে আসা শিক্ষার্থীদের হলে ওরিয়েন্টেশন প্রয়োজন। এমন নিয়ম চালু করার কথা ভাবা হচ্ছে। তবে নির্যাতন হলেই আমরা জিরো টলারেন্স নীতি অনুযায়ী কাজ করি।
শিক্ষাবিদ ও ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন সমকালকে বলেন, আমরা ষাটের দশকে যে ছাত্রলীগ দেখেছি, তা এখন সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। বর্তমান ছাত্রলীগে ছাত্রও নেই, আদর্শও নেই। এরা শ্রেণিকক্ষে থাকে না। গ্রন্থাগারে যায় না। হাতে খাতা-কলম থাকে না। টেন্ডারবাজি করে, হলে ফাও থাকে, ফাও খায়। লেখাপড়ার সঙ্গে সম্পৃক্ততা নেই। এদের ছাত্রত্বই প্রশ্নবিদ্ধ। সরকার দলই হোক বা বিরোধী দলই হোক, কেউ ভিন্ন নয়। এদের দমাতে হলে সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশীজনকে শক্ত অবস্থানে যেতে হবে।
এ প্রসঙ্গে ঢাবি ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন বলেন, ‘আমরা নতুন দায়িত্বে এসেছি। আমরা এই সংস্কৃতিটাই পরিবর্তন করে ফেলতে চাই। যারা নেতিবাচক কার্যক্রম করবে তাদের প্রতি কঠোর নির্দেশনা থাকবে। এর সুফল দেখতে পাবেন। ‘
সোর্স : সমকাল