খুলনা ব্যুরো : একসময় সুন্দরবন উপকূলীয় অঞ্চলে বন ও জলদস্যুদের হাতে অপহরণ ও খুন হওয়ার আতঙ্কে ছিলেন জেলে ও বনজীবীরা। মুক্তিপণের দাবিতে জেলে ও বনজীবীদের অপহরণ করে সুন্দরবনে আটকে রাখতো বিভিন্ন দস্যু বাহিনী। মুক্তিপণ না দিলে তাদের গুলী করে হত্যা করা হতো। বছরের পর বছর চাঁদাবাজি ও অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রচেষ্টায় ২০১৮ সালে সেই অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। এরই মধ্যে চলতি মাসে চার দফায় সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জ এলাকা থেকে অন্তত ৩০ জন জেলেকে মুক্তিপণের দাবিতে অপহরণ করা হয়েছে। ফলে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে, দস্যুমুক্ত সুন্দরবনে জেলেদের অপহরণ করছে কারা?
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৬ বছরের ৩১ মে মাস্টার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে সুন্দরবনে আতঙ্ক কমতে শুরু করে। এ পর্যন্ত ২৬টি বাহিনীর ২৭৪ বন ও জলদস্যু অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করেছেন। এরপর ২০১৮ সালের ১ নবেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত ঘোষণা করেন।
অবশ্য এর আগে ১৩৫ বন ও জলদস্যু র্যাবের গুলীতে নিহত হন। র্যাবের ক্রমাগত সাঁড়াশি অভিযানে দস্যুরা ফেরারী জীবনের অবসান ঘটিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার পথ খুঁজতে থাকেন। পরে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে অস্ত্র জমা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরেন তারা।
জেলে ও বনজীবীরা বলছেন, দীর্ঘ চার বছর দস্যুমুক্ত থাকার পর সুন্দরবনে আবারও শুরু হয়েছে দস্যুদের তান্ডব। গত ১৩ ডিসেম্বর চাঁদপাই রেঞ্জ এলাকা থেকে মুক্তিপণের দাবিতে আট জেলেকে অপহরণ করে জলদস্যুরা। তাদের হাতে সাত দিন জিম্মি থাকার পর ২০ ডিসেম্বর এক লাখ ৮০ হাজার টাকা দিয়ে মুক্তি পান আট জেলে।
মুক্তি পাওয়া এক জেলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, ‘অপহরণের পর মুক্তিপণের দাবিতে আমাদের নির্যাতন করা হয়েছে। পরে পরিবারের সদস্যরা মুক্তিপণের টাকা পাঠালে আমাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। ওই দস্যু বাহিনী কারা তা আমরা জানি না।’
গত ১৫ ডিসেম্বর বিকেলে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের বেড়ির খাল ও হরমল খালে জেলেবহর থেকে ১১ জেলেকে অপহরণ করে দস্যুরা। মুক্তিপণের দাবিতে তাদের অপহরণ করা হয়। ওই দিন জেলেদের কাছ থেকে প্রায় ছয় মণ কাঁকড়া, ২০টি মোবাইল ও দুটি জেলে নৌকা নিয়ে যায় দস্যুরা। গত বুধবার ভোরে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জ এলাকা থেকে তাদের উদ্ধারের কথা জানায় পুলিশ।
বাগেরহাটের পুলিশ সুপার কে এম আরিফুল হক বলন, ‘জেলেদের অপহরণের খবরে সুন্দরবনে বিশেষ অভিযান চালায় পুলিশ। টানা অভিযান চালিয়ে ১১ জন জেলেকে উদ্ধার করা হয়। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে দস্যুরা পালিয়ে গেছে। ফলে কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি। দস্যুদের আটকে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। সুন্দরবনকে জল ও বনদস্যুমুক্ত ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ওই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে আমরা আরও তৎপরতা বাড়াবো।’
তবে জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে ১৫ ডিসেম্বর সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের জিউধারা ও ধানসাগর স্টেশনের বেড়ির খাল এবং হরমল খালে জেলেরা ১০ থেকে ১১টি নৌকায় কাঁকড়া ধরছিলেন। তখন ৮-৯ জনের একদল দস্যু জেলেদের বহর থেকে ১১ জনকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। তারা মুক্তিপণ হিসেবে জেলেদের কাছে মুঠোফোনে ১০ হাজার টাকা করে দাবি করে। অপহরণকারী দস্যুরা নয়ন বাহিনীর সদস্য।
এরপর ১৮ ডিসেম্বর রাতে সুন্দরবনের হাড়বাড়িয়া ও চরপুটিয়ার বুজবুজ এলাকায় জেলেদের ওপর হামলা চালিয়ে মুক্তিপণ দাবি করে একটি দস্যু বাহিনী। মুক্তিপণের টাকা দিতে না পারায় জেলেদের মাছ লুটে নেয় তারা। একইভাবে ১৯ ডিসেম্বর শ্যালা নদী সংলগ্ন আলকি এলাকা থেকে তিন জেলেকে অপহরণ করে অপর দস্যু বাহিনী। তাদের কাছে ৯০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। এই তিন জনকে এখনও ছাড়া হয়নি।
মুক্তিপণ দিয়ে দস্যুদের হাত থেকে ছাড়া পাওয়া জেলে ফারুক খাঁন বলেন, ‘১৩ ডিসেম্বর আমাদের নিয়ে যাওয়ার সময় তাদের (দস্যু) কাছে দুটি পাইপগান, ছয়টি রামদা ও বেশকিছু লাঠি ছিল। দুটি নৌকায় আট দস্যু ছিল। তাদের কাছে এখনও ৩০-৩৫ জন জেলে জিম্মি আছে।’
এদিকে, হঠাৎ সুন্দরবনে দস্যুরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠায় আতঙ্কে রয়েছেন জেলে ও বনজীবীরা। দ্রুত অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন তারা।
মোংলার চিলা এলাকার জেলে বিদ্যুৎ মন্ডল ও মোতাহার হোসেন জানান, বন বিভাগ থেকে অনুমতি নিয়ে কাঁকড়া ও মাছ ধরতে সুন্দরবনে যান জেলেরা। সেখানে অস্ত্রের মুখে তাদের অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করে দস্যুরা। এ অবস্থায় কীভাবে বনে যাবেন তা নিয়ে আতঙ্কে আছেন তারা।
র্যাব-৬-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মোস্তাক আহমেদ বলেন, ‘র্যাব ও কোস্টগার্ডের সমন্বয়ে গত দু’দিন ধরে আমরা অভিযান চালিয়ে যাচ্ছি। অভিযানিক দল এখনও সুন্দরবনের ভেতরে আছে। দস্যুদের ধরার পর বিস্তারিত জানানো হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘অভিযানের ফলে দস্যুরা কয়েকজন জেলেকে ছেড়ে দিয়েছে। সুন্দরবনে র্যাব এ পর্যন্ত ২২৩টি সফল অভিযানে ৫০৭ জলদস্যু ও বনদস্যুকে গ্রেফতার করেছে। এক হাজার ৫৫৫টি অস্ত্র এবং ৩৩ হাজার ৩২৪ রাউন্ড গুলী উদ্ধার করেছে। আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে।’
মোস্তাক আহমেদ বলেন, ‘এ পর্যন্ত ২৬টি বাহিনীর ২৭৪ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছে। তাদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। নতুন কোনও জলদস্যু বাহিনী গঠন হয়েছে কিনা তা গ্রেফতারের পর বোঝা যাবে।’
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘গত কয়েক বছর দস্যুদের তৎপরতা ছিল না। হঠাৎ আবারও জেলেদের অপহরণের ঘটনা বেড়েছে। বিষয়টি র্যাব, কোস্টগার্ড ও নৌ-পুলিশকে জানিয়েছি আমরা।’
দস্যুদের ধরতে যৌথ অভিযান চলছে জানিয়ে কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের (মোংলা সদর দফতর) অপারেশন কর্মকর্তা লে. কমান্ডার শেখ মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘হঠাৎ সুন্দরবনে দস্যুদের তৎপরতা বেড়েছে। আমরা টহল জোরদার করেছি। অপহৃত জেলেদের উদ্ধার এবং দস্যুদের ধরতে যৌথ অভিযান চলছে। দস্যুরা সংগঠিত হতে পারবে না। দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের গ্রেফতার করা হবে।’
সোর্স : দৈনিক সংগ্রাম