সারা দেশের চোখ এখন ৩০ ডিসেম্বর শুক্রবারের ওপর। ঐ দিন আলাদা আলাদা মঞ্চ থেকে হলেও বিএনপি এবং সমমনা অন্যান্য দল গণমিছিল করবে। এছাড়া বহুল প্রচারিত যুগপৎ আন্দোলনের সূচনাও হবে ঐদিন থেকেই। এটা হলো ঢাকা মহানগরীর ব্যাপার। তবে মফস্বলে গণমিছিল হবে ২৪ তারিখে। গত ২৪ তারিখে মফস্বলে গণমিছিল হয়ে গেছে। কিন্তু তার এক দিন আগে অর্থাৎ শুক্রবার ২৪ তারিখ সকালেই আমাকে এই লেখা লিখতে হচ্ছে। তাই মফস্বলে গণমিছিল কেমন হলো সেটা যেমন আপনাদেরকে আমি জানাতে পারছি না, তেমনি সে সম্পর্কে কোনো মন্তব্যও করতে পারছি না। আর ৩০ ডিসেম্বরের গণমিছিল তো আরো ৫ দিন পরে। আশাকরি ২৪ তারিখ এবং ৩০ তারিখ, এই উভয় তারিখের গণমিছিল একসাথে করে লিখতে পারবো। আমার কাছে এই গণমিছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে ঠিক আন্দোলন শব্দটি যে অর্থে ব্যবহৃত হয় সেটি শুরু হবে গণমিছিল থেকেই। এর আগে অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বরের ১০ তারিখ পর্যন্ত যে সব মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়ে গেল সেগুলো আন্দোলনের একটি অংশ হলেও সেগুলো মূলত ছিল জনমত গঠনের কর্মসূচী। অবশ্য এর সাথে এই কথাও বলা যায় যে এই সরকারের বিরুদ্ধে জনমত ২০১৪ সালের আগেই গঠিত হয়ে আছে। তাই দেখা যায় যে ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বে বিরোধীদল সমূহ নির্বাচন বর্জনের যে ডাক দিয়েছিল সেটি প্রায় শতভাগ সফল হয়েছিল। সফল হয়েছিল এই অর্থে যে প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ ভোট দিতে যাননি। কিন্তু সেই তথাকথিত নির্বাচন প্রতিরোধ করার জন্য যে কাজটি করার দরকার ছিল, বিএনপি এবং বিরোধীদল সমূহ সেই কাজটি করতে পারেননি। তবে আওয়ামী লীগ যে ভয় পেয়েছিল সেটির প্রমাণ হলো ১৫৩ জন প্রার্থীকে নির্বাচনে জয়ী দেখিয়ে জাতীয় সংসদের মেজরিটি আসন ইলেকশনের আগেই দখল করা হয়েছিল। এটিও প্রতিরোধ করা দরকার ছিল। কিন্তু সেটি যে কোনো কারণে হোক, বিরোধী দলসমূহ করতে পারেনি। ২০১৮ সালেও আওয়ামী লীগ সরকার দারুণ ভয় পেয়েছিল। তাই ৩০ ডিসেম্বর দিনে যে ভোট হওয়ার কথা ছিল সেটি ২৯ ডিসেম্বর রাতেই সেরে ফেলা হয়েছিল। রাতে যে ব্যালট পেপারে ভোট দিয়ে ব্যালট বাক্স পূরণ করা হবে সেটি কিন্তু মোটামুটি জানা হয়ে গিয়েছিল। তাই রাতেই সবগুলো ভোট কেন্দ্রে পাহারা বসানোর দরকার ছিল। ভোটের ৪/৫ দিন আগে আমি একটি আসনে বিরোধী দলীয় একজন প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার জন্য ঐ এলাকার একটি হোটেলে অবস্থান করছিলাম। বস্তুত ২৮ ডিসেম্বর বিকালেই আমাদের কাছে খবর আসে যে পরদিন অর্থাৎ ২৯ ডিসেম্বর রাতেই ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্স ভরানো হবে। তৎক্ষণাৎ কেন্দ্রে যোগাযোগ করে নির্দেশনা চাওয়া হয় যে আগের রাতে ভোট বাক্স ভরার এই জঘন্য কাজটি কর্মী এবং গ্রামবাসীরা প্রতিরোধ করতে চায়। কিন্তু কেন্দ্র থেকে বলা হয় যে কোনোরূপ সংঘাতে যাওয়া যাবে না। তখন নির্দেশনা চওয়া হয় যে তাহলে কি আমাদের প্রার্থী এই অন্যায় কারচুপির প্রতিবাদে নির্বাচন বর্জন করবেন কিনা। তখন আবার নির্দেশ আসে যে নির্বাচনের দিন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে হবে।
এমন একটি পটভূমিতে যা হবার তাই হয়ে গেল। ৩০ ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর যখন পাতানো নির্বাচনের ফলাফল টেলিভিশনে আসতে লাগলো তখন পুনরায় কেন্দ্রকে জানানো হলো যে এলাকাবাসী খুব গরম হয়ে আছে। তারা পরবর্তী দুই দিন এই ভোট ডাকাতির বিরুদ্ধে লাগাতার হরতাল করতে চায়। তখন কেন্দ্র থেকে নির্দেশ এলো যে এই মুহূর্তে এ সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত দেয়া যাবে না। ঢাকায় বসে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। তখন আমাদের প্রার্থীর সমর্থকদের সামনে আর কোনো পথ খোলা ছিল না। ৩০ ডিসেম্বর রাতে আন্তঃজেলা যোগাযোগ বন্ধ ছিল। তাই আমরা সদলবলে পরদিন সূর্য ওঠার পূর্বাহ্নেই ঢাকা রওয়ানা হই। ঢাকা পৌঁছার পর দুপুর বেলা রেস্ট নিয়ে কেন্দ্রীয় অফিসে যোগাযোগ করা হয়। ৩১ ডিসেম্বর এবং ১ জানুয়ারি ঐক্যফ্রন্ট বা ২০ দলীয় জোটের কোনো সভা হয়নি। ২ জানুয়ারি জোটের শীর্ষ নেতৃত্বের সভা হয়। জোটের অন্যান্য শরিক বলেন যে যেহেতু নির্বাচন হয়েছে অবৈধ, ভোটে হয়েছে ডাকাতি এবং সেই কারণে যেহেতু নব গঠিত পার্লামেন্ট জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য নয় তাই এই অবৈধ পার্লামেন্টের বিরুদ্ধে পরপর তিন দিন লাগাতার হরতাল দেয়া হোক। ঐ সভায় সভাপতিত্ব করেন ড. কামাল হোসেন। ২০ দলীয় জোট এবং ঐক্যফ্রন্টের প্রায় সব শীর্ষ নেতা ঐ সভায় উপস্থিত ছিলেন। ড. কামাল হোসেনের কোনো ভয়েস ছিল না। লাগাতার হরতালের প্রস্তাব বড় শরিক খারিজ করে দেন। কেন খারিজ করে দেন সেই রহস্য আজও উদঘাটিত হয়নি, যদিও ইনার সার্কেল আসল কারণটি জানতে সমর্থ হয়েছিলেন।
॥দুই॥
এসব কথা আজ মনে পড়ছে এবং ৪ বছর পর সেসব কথা লিখছি। লিখছি এই কারণে যে সবগুলো বিরোধীদল আন্দোলনে নামছে। কথায় বলে, ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়। গত বৃহস্পতিবার আমার বাসায় একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বেড়াতে এসেছিলেন। কথা প্রসঙ্গে তিনি জিজ্ঞেস করলেন যে বিএনপি যে রাষ্ট্র সংস্কারের ২৭ দফা দিয়েছে, ক্ষমতায় গেলে তারা কি সেগুলো পালন করতে পারবে? নাকি পালন করবে? আমি এবার অত্যন্ত স্পষ্ট জবাব দিলাম। বললাম, মরহুম সোহরাওয়ার্দীর একটি কথা স্মরণ করুন। একটি গুরুতর সমস্যা নিয়ে তার কাছে গিয়েছিলেন তার দলের কয়েকজন নেতা। সমস্যাটি কিন্তু তখনও সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু সমস্যাটি যে সৃষ্টি হবে তার আলামত দেখা যাচ্ছিল। সোহরাওয়ার্দীর জবাব ছিল, We shall cross the bridge when we come across it. অর্থাৎ যখন আমরা সাঁকোটির সামনে আসবো একমাত্র তখনই পার হওয়ার প্রশ্ন উঠবে। সোহরাওয়ার্দীর ঐ উক্তির রেফারেন্সে আমি ঐ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে বললাম যে ২৭ দফা বাস্তবায়ন করতে গেলে তো ক্ষমতায় যেতে হবে।
এখন প্রশ্ন হলো, ক্ষমতায় যাওয়ার আগে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারকে হয় স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে, না হয় ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করতে হবে। তার আগে ২৭ দফা বাস্তবায়নের চিন্তা বাতুলতা মাত্র। এখন বলুন, আওয়ামী লীগকে কিভাবে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করবেন। আওয়ামী লীগ সরকারের হাই কমান্ড থেকে একাধিকবার অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলা হয়েছে যে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হটানো এত সহজ নয়। আরো বলা হচ্ছে যে বিএনপিকে অনেক ছাড় দেয়া হয়েছে। আর কোনো ছাড় দেয়া হবে না। আরো বলা হচ্ছে যে এবার গোলমাল করতে আসলে একটাকেও ছেড়ে দেয়া হবে না। এসব কথা কেন বলা হচ্ছে সেটি যারা বলছেন তারাই জানেন। গোলমালের প্রশ্ন উঠছে কেন? এই যে লক্ষ লক্ষ লোকের সমাবেশ ঘটিয়ে ১০ টি মহাসমাবেশ করা হলো তার প্রত্যেকটির আগে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এবং দলীয় পর্যায়ে এমন সব বাধা বিঘেœর সৃষ্টি করা হয় যা সন্ত্রাসের পর্যায়ে পড়ে। তারপরেও বিএনপি যেকোনো মূল্যে সংঘর্ষ এড়িয়ে চলে।
॥তিন॥
একই কথা জামায়াতের ইসলামীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বিএনপি তো তাও অনেক দিন ধরেই ছোট হোক বড় হোক কর্মসূচী পালন করে যাচ্ছে। কিন্তু জামায়াত তো বলতে গেলে বিগত ৪ বছর ধরে প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক কর্মসূচী থেকে দূরে আছে। তারা এই ৪ বছর ধরে তাদের দলীয় আদর্শ অর্থাৎ পবিত্র ইসলাম প্রচারের দাওয়াতি কার্যক্রমে নিয়োজিত ছিল। অথচ তারপরেও জামায়াতের রেহাই নাই। এই চার বছরে সারা দেশজুড়ে জামায়াতের বহু নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের কেউ কেউ জামিনে মুক্ত হয়েছেন, আবার কেউ কেউ এখনও কারাগারে আছেন। জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল সাবেক এমপি মিয়া গোলাম পরওয়ার এখনও জেলে। এমন একটি অবস্থায় হঠাৎ করে আমীরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে এতদিন পর্যন্ত কোনো অভিযোগ খুঁজে পাওয়া যায়নি। এবার সন্ত্রাসবাদে জড়িত থাকা অথবা সহায়তা দানের মত মারাত্মক অভিযোগে আমীরে জামায়াতকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বিগত ১০/১৫ দিনে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে জামায়াতের জেলা পর্যায়ের শীর্ষ নেতা এবং কর্মীবৃন্দকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
এর পাশাপাশি আরেকটি বিষয় নজর করুন। মির্জা ফখরুল, মির্জা আব্বাস, রুহুল কবির রিজভীসহ বিএনপির যেসব শীর্ষ নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে তাদেরকে জামিনে মুক্তি দেয়ার জন্য এই কলামটি লেখা পর্যন্ত চারবার আদালতে আবেদন করা হয়েছে। চারবারই তাদের আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। সুতরাং অভিজ্ঞ রাজনৈতিক মহলের বুঝতে অসুবিধা হয়না যে সরকার বিরোধীদলকে মোকাবেলা করার জন্য অত্যন্ত হার্ড লাইন গ্রহণ করেছে। সুতরাং শাসকগোষ্ঠী মুখ দিয়ে যেসব শক্ত শক্ত কথা বলছে, বাস্তবেও কাজ করে সেই সব শক্ত কথা কার্যকর করছে।
বিগত ৫০ বছর ধরে আমি আওয়ামী লীগের রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করে আসছি। এর ফলে এই দলটি কখন কি করবে সে সম্পর্কে আমি পূর্বাহ্নে যে ধারণা করি সেটি দেখি বাস্তবের সাথে মিলে যায়। একটি কথা সকলকে মনে রাখা দরকার যে অধিসর Awami League simply cannot afford to relinquish power. অর্থাৎ আওয়ামী লীগ বাঘের পিঠে চড়েছে। তারপক্ষে বাঘের পিঠ থেকে নামা সম্ভব নয়। নামলেই তার সমূহ বিপদ। বাঘ তাকে খেয়ে ফেলতে পারে। কিন্তু বাঘের পিঠে চড়ে থাকাও ভয়াবহ বিপদ। তাহলে আওয়ামী লীগ কি করবে? এর উত্তরও অত্যন্ত সহজ। ক্ষমতায় থাকার জন্য তারা সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করবে।
এখন ফিরে যাচ্ছি আজকের আলোচনার শুরুতে। ২৭ দফা বাস্তবায়ন করতে গেলে আগে তো এই সরকারকে অপসারণ করতে হবে। সেটি কিভাবে সম্ভব? অবশ্য সেদিন এক আলোচনা সভায় বিএনপির অন্যতম শীর্ষ নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন যে গণ অভ্যুত্থানে এই সরকারের পতন ঘটানো হবে। এখন দেখতে হবে যে ৩০ ডিসেম্বরের যুগপৎ আন্দোলন তথা গণমিছিল গণঅভ্যুত্থানের সূচনা করে কিনা। এ পর্যন্ত যা দেখা যাচ্ছে তাতে যুগপৎ আন্দোলনে ৫ টি মঞ্চ হতে যাচ্ছে। একটি বিএনপি, দ্বিতীয়টি জামায়াতে ইসলামী, তৃতীয়টি গণতন্ত্র মঞ্চ, চতুর্থটি ২০ দল থেকে বেরিয়ে আসা ১২ দলীয় জোট। পঞ্চমটি এখনও গঠিত হয়নি। শুনতে পাচ্ছি ইসলামী দল সমূহ মিলে নাকি আরেকটি জোট গঠিত হবে।
সূচনাটি অত্যন্ত ভাল। তবে ঐ যে কথায় বলে, “All is well whose end is well”. অর্থাৎ “সব ভাল যার শেষ ভাল”।
Email: asifarsalan15@gmail.com