মশা বা মশক এক প্রকারের ছোট মাছি প্রজাতির পতঙ্গ। পতঙ্গ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অধিকাংশ প্রজাতির স্ত্রী-মশা স্তন্যপায়ী প্রাণীর রক্ত পান করে থাকে। যদিও যেসব প্রাণীর শরীর থেকে রক্ত শুষে নেয় তা তাদের শরীরের তুলনায় খুবই অল্প, কিন্তু কিছু মশা রোগজীবাণু সংক্রামক। মশার মাধ্যমে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, ফাইলেরিয়া, পীতজ্বর, জিকা ভাইরাস প্রভৃতি রোগ সংক্রমিত হয়ে থাকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, বিশে^র প্রায় সকল দেশেই মশক নিধন বা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা থাকলেও এক্ষেত্রে এখনো আমরা অনেকটাই পিছিয়ে। মশা নিয়ন্ত্রণে নেই আমাদের আধুনিক প্রযুক্তিও।
সম্প্রতি রাজধানীসহ সারাদেশেই মশকের উৎপাত বেড়েছে। গত ১০ ডিসেম্বর বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশ ও ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস নাজেহালকে কেন্দ্র করে মাঠের রাজনীতিতে সংঘাত-সংঘর্ষের ডামাডোলে রাজধানীবাসীর নিত্যযন্ত্রণা। গ্যাস-বিদ্যুৎ সঙ্কট, পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ডলার সঙ্কট, ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতিসহ অসংখ্য ইসু চাপা পড়ে গেছে বলেই দৃশ্যত মনে হচ্ছে। একই সাথে চাপা পড়েছে রাজধানী ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনে মশার যন্ত্রণার বিষয়টিও। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানীতে এডিস মশার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সংক্রামক কিউলেক্স মশা। রাতে শুধু বাসায় নয়, দিনেও অফিস-আদালত, মার্কেট, বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশনসহ মানুষের উপস্থিতি স্থানে মশার উপদ্রপ অস্বভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। কিন্তু এক্ষেত্রে সিটি কর্পোরেশনগুলোর উল্লেখযোগ্য কোন তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, পুরো ঢাকা মহানগরীই যেন সংক্রামক মশার অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। মশার যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে মানুষ কয়েল, মশা তাড়ানোর ¯েপ্র, ইলেক্ট্রোনিক্স ব্যাট কিনে মশা থেকে নিজেদের রক্ষা করার চেষ্টা করছেন। আগে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে পাড়া-মহল্লায় মশার ওষুধ ছিটানোর যে দৃশ্য দেখা যেত তা এখন অনেকটাই স্তিমিত হয়ে এসেছে। কালেভদ্রে ছিটানো হলেও তা থেকে তেমন একটা উপকৃত হতে পারছে না নগরবাসী। মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে সম্প্রতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী এক সেমিনারে বলেছেন, ‘আমি বারিধারায় থাকি। সেটা অভিজাত এলাকা। সেখানেও মশার যন্ত্রণায় থাকা যায় না। সন্ধ্যা হলেই ঝাঁকে ঝাঁকে মশা বাসাবাড়িতে হানা দেয়’। যা মশক বাহিনীর ভয়াবহ উপদ্রবের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
সূত্রমতে, এ বছর ফেব্রুয়ারিতে মশার ঘনত্ব বেড়েছে চার গুণ। বছরের ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত কিউলেক্স মশার প্রজনন মৌসুম। এ সময়ে একই চিত্র থাকে কিউলেক্স মশার ক্ষেত্রেও। কিউলেক্স মশার প্রজনন স্থানগুলো সঠিকভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে উপদ্রপ কমিয়ে আনা সম্ভব হলেও জোরালো কোন পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। এ জন্য ডোবা-নালা বা জলাশয়গুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে কিটনাশক ও মশার প্রজনন বিরোধী ওষুধ প্রয়োগ করা দরকার। সর্বোপরি মশক নিধনে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা আবশ্যক। আর সঠিক নিয়মে এসব কার্যক্রম পরিচালনা করা গেলে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান করা সম্ভব বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, আরামবাগ, গোপীবাগ, সায়েদাবাদ, শনিরআখড়া, ধোলাইপাড়সহ পুরান ঢাকার কয়েকটি এলাকায় মশকের উপদ্রব খুবই ভয়াবহ রূপ নিয়েছে বলে জানা গেছে। প্রতিটি পাড়া-মহল্লার মানুষ কিউলেক্স মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন। এখন এডিস মশা কিছুটা কম দেখা গেলেও বড় আকৃতির কিউলেক্স মশা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কিউলেক্স মশার কারণে ফাইলেরিয়া ও ম্যালেরিয়া রোগ ছড়ায়। নবেম্বর থেকে শুরু করে মার্চ পর্যন্ত এর উৎপাত থাকে বেশি। দুই সিটি কর্পোরেশনে কিউলেক্স মশার উপদ্রপ বেশি। এতে ভোগান্তিতে পড়ছে রাজধানীবাসী। তারা অভিযোগ করছেন, গোটা নগরজুড়েই মশার উপদ্রব অসহনীয় মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। মশক দমনে করপোরেশনের কার্যক্রম আগে ‘নামমাত্র’ দেখা গেলেও এখন তাও নেই বললেই চলে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক জরিপে রাজধানী ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের মশক ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ডগুলোর নাম তুলে ধরা হয়েছে।
ওই জরিপের ফলাফল অনুযায়ী, দুই সিটির মোট ১১টি ওয়ার্ডকে মশক ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি বলে চিহ্নিত করা হয়। এরমধ্যে উত্তর সিটির ৫টি এবং দক্ষিণ সিটিতে ৬টি ওয়ার্ডে মশার উপদ্রব অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওই গবেষণা প্রতিবেদনে জানানো হয়, ঢাকা উত্তর সিটির ১, ১২, ১৬, ২০ ও ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে মশকঝুঁকি বেশি। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৫, ৬, ১১, ১৭, ৩৭ এবং ৪২ নম্বর ওয়ার্ডে মশা অসহনীয় পর্যায়ে বেড়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কর্তৃপক্ষের কোন কার্যকর ব্যবস্থা দৃশ্যমান নয়।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, খাল ও নর্দমা ছাড়াও বস্তি, রাস্তার পাশের ময়লার ভাগাড়, বাসস্ট্যান্ডের বিভিন্ন খোসা, ঝোপঝাড়, টায়ারের দোকান, দীর্ঘদিন ধরে রাস্তার পাশে ফেলে রাখা মোটর যান মশা জন্মানোর উপযুক্ত স্থান। এছাড়া ঢালাই মেশিন, রাস্তার পাশে পরে থাকা পলিথিন, কর্কসীট, বিভিন্ন মার্কেটের পরিত্যাক্ত ছাদ, দুই বাড়ির মাঝের পেসেজে বৃষ্টির পানি ও ভবনের টাংকীর পানি জমে সেখানে মশা জন্মাচ্ছে। এ ছাড়াও ছাদকৃষি যারা করেন তাদের বাগানে ফুলের টবে পানি জমে মশার লার্ভা জন্মায়। নির্মাণাধীন ভবনে বেশি মশা দেখা যায়। নির্মাণাধীন ভবনে ঠিকাদার ও বাড়ি মালিকদের অসচেতনায় সেখানে জন্ম নিচ্ছে এডিস ও কিউলেক্স উভয় ধরনের মশা। এসব মশা নিধনে সিটি কর্পোরেশন কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নেয় নি। ফলে রাজধানীতে মশক বাহিনীর উপদ্রব এখন নিয়ন্ত্রণহীন।
ডিএসসিসি সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, এখন ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব অনেকটা কমে এসেছে। বর্তমান সময়ে কিউলেক্স মশার মৌসুম শুরু হয়ে গেছে। কিউলেক্স ও এডিস মশা নিধনের জন্য তারা খাল, বিল, নালা-নর্দমা পরিষ্কার রাখছেন। ইতোমধ্যেই আদি বুড়িগঙ্গাও পরিষ্কারের কার্যক্রম চলছে। মশা নিধনে লার্বি সাইট প্রয়োগ করা হচ্ছে। তারা অব্যাহত মশা নিয়ন্ত্রণে কর্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছেন যথাযথভাবে। কিন্তু তাদের দাবির সাথে বাস্তবতার কোন মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে সার্বিক পরিস্থিতির কোন উন্নতি হচ্ছে না।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, পুরান ঢাকার কামরাঙ্গীর চর, লালবাগ, হাজারীবাগ, পোস্তগোলা, ডেমরা, শ্যামপুর, দনিয়া, পল্টনসহ অভিজাত এলাকা গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি, উত্তরা, মোহাম্মদপুরের বাসিন্দারাও মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ। দুই সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে যোগ হওয়া নতুন ওয়ার্ডগুলোর অবস্থা আরো করুণ। মশার প্রজনন স্থান খাল ও নর্দমা পরিষ্কার করা বা সেখানে ওষুধ প্রয়োগ নাগরিকদের পক্ষে সম্ভব নয়। ওয়ার্ডভিত্তিক মশক নিধন শ্রমিকদের দিয়ে যেভাবে ডেঙ্গু ভাইরাসবাহিত এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে কাজ হয়েছে, এখন তেমন কোনো তৎপরতা নেই। ফলে কিউলেক্স মশার প্রজনন বেড়ে যাওয়া দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার ব্যর্থতা বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, মশা নিয়ন্ত্রণে যেসব পদক্ষেপ দরকার সেসব ক্ষেত্রে দুই সিটি কর্পোরেশনের বড় ধরনের দুর্বলতা রয়েছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং ওষুধ ছিটানোর কার্যক্রম সঠিকভাবে সম্পাদন করা গেলে মশার উপদ্রব এত বৃদ্ধি পেত না। কিন্তু এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষে রয়েছে উদাসীনতা।
এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) বক্তব্য হলো, ডিএনসিসি ৫৪ টি ওয়ার্ডে একযোগে এই মশক নিধন অভিযান পরিচালনা করছে। এখন এডিস মশার পাশাপাশি কিউলেক্স মশা বেড়ে যাওয়ায় মূল ফোকাস দেয়া হচ্ছে কিউলেক্স মশার বিরুদ্ধে। যতগুলো নালা-নর্দমা আছে সবগুলো পরিষ্কার করা হচ্ছে। কচুরিপানা পরিষ্কার করার পর এসব স্থানে লার্বি সাইট প্রয়োগ করা হচ্ছে। প্রত্যেকটি বাড়িতে পানির মধ্যে ট্যাবলেট প্রয়োগ করা হচ্ছে। যতগুলো মশার হটস্পট আছে সেগুলোকে নির্দিষ্ট করে মূলত ডিএনসিসি নিবিরভাবে কাজ করে যাচ্ছে। প্রত্যেকটি অঞ্চলে আলাদাভাবে জনপ্রতিনিধিদের সাথে নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। কিন্তু তারপরও মশার উপদ্রপ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি বরং আগের তুলনায় বেশ বেড়েছে।
সূত্র বলছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) আয়তন ১০৯ দশমিক ২৫১ বর্গকিলোমিটার। সাধারণ ওয়ার্ড ৭৫টি। কিন্তু এসব ওয়ার্ডের আয়তন অনুযায়ী জনবল, মশার ওষুধ, ফগার মেশিনের সঙ্কট আছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) এলাকার আয়তন ১৯৬ দশমিক ২২ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে ৫৪টি সাধারণ ওয়ার্ড। প্রতিটি ওয়ার্ডে গড়ে ১২ জন কর্মী সকাল-বিকাল দুই শিফটে মশা মারার ওষুধ ছিটান। কিন্তু ওয়ার্ডের আয়তন অনুযায়ী লোকবল অনেক কম।
কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দুই সিটি কর্পোরেশনের। এটা নগরবাসীর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। কিউলেক্স মশার প্রজননস্থল ডোবা-নালায় জমে থাকা পানি। দুই সিটি করপোরেশন মশা নিধনে তাদের কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনা করলে কিউলেক্সের উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে থাকবে। ডোবা, নালা বা জলাশয়ের পানি পচে গেলে সেখানে মশার প্রজনন ঘটে। শুষ্ক মৌসুমে ঢাকার ডোবা-নালাগুলোর পানি পচে যায়। আর এসব স্থানে কচুরিপানা থাকলে তা কিউলেক্স মশার প্রজননে আরও সহায়ক হয়।
মূলত, রাজধানীতে মশার উপদ্রব নতুন কিছু নয়। বছরের বিভিন্ন সময়ে ঢাকায় মশকের উপদ্রব অসহনীয়ভাবে বেড়ে যায়। ফলে অনাকাক্সিক্ষতভাবে নগরীতে সৃষ্টি হয় জনদুর্ভোগ। ক্রমবর্ধমান মশক নিয়ন্ত্রণ করে নগরজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব উভয় সিটি কর্পোরেশনের হলেও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও আন্তরিক তৎপরতার অভাবে ঢাকা নগরীতে এখন মশক বাহিনী রীতিমত অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে।
এমতাবস্থায় মশকের উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে নগরজীবনে স্বস্তি ও জনস্বাস্থ্য নিরাপদ করার জোরালো দাবি উঠেছে নগরবাসীর পক্ষ থেকে। এ জন্য উভয় সিটি কর্পোরেশনের যৌথ উদ্যোগে ব্যাপকভিত্তিক মশক নিধন কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন। মশার প্রজনন স্থানগুলোতে নিয়মিত কীটনাশক ও মশক প্রতিরোধী ওষুধ ছিটানোর ব্যবস্থা করার দরকার। একই সাথে আবাসিক এলাকাসহ অফিস-আদালতসহ বিভিন্ন সকল পাবলিক প্লেসে প্রয়োজনীয় ও মানসম্মত ফগার স্প্রে করতে হবে। কারণ, অনেক ক্ষেত্রে ছিটানো ওষুধের মানহীনতার কারণেও ইতিবাচক ফল পাওয়া যায় না। সর্বোপরি মশক নিধনে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারও নিশ্চিত করা দরকার। অন্যথায় আগামী দিনে মশক জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করবে; নগরীতে সংক্রামক রোগ বৃদ্ধি জনস্বাস্থ্যও হুমকীর মুখে পড়ছে।
সোর্স : দৈনিক সংগ্রাম