সরকারের ব্যয় সংকোচন নীতির প্রভাব পড়েছে দেশের সার্বিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন গত সাত বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। অন্তত পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন হার ২ শতাংশেরও কম। সরকারের অগ্রাধিকার দেওয়া মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নেও ধীরগতি চলছে।
উন্নয়ন বিশ্নেষকরা বলছেন, সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে স্থানীয় উৎসের চেয়ে এ মুহূর্তে বিদেশি সহজ উৎসে সরকারের আরও বেশি নজর দেওয়া উচিত। বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন সমকালকে বলেন, পরিস্থিতি সামাল দিতে আপাতত প্রকল্প বাস্তবায়নে কৃচ্ছ্র সাধনের প্রাথমিক লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। তিন ক্যাটাগরিতে প্রকল্প বিন্যাস করা হয়েছে। সে কারণে বাস্তবায়ন হয়তো কিছুটা কম হতে পারে। তবে অপ্রয়োজনে যাতে প্রকল্প বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত না হয়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। সরকারি উৎস থেকে ব্যয়ের ক্ষেত্রে সতর্কতার প্রয়োজন রয়েছে। কারণ, সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এতে মূল্যস্ম্ফীতির চাপ বেড়ে যেতে পারে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) হিসাবে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এডিপি বাস্তবায়নের হার ১৮ দশমিক ৪১ শতাংশ। করোনাকালেও এর চেয়ে বেশি হারে এডিপির বাস্তবায়ন হয়েছিল।
গত অর্থবছরের একই সময়ে বাস্তবায়নের হার ছিল ১৮ দশমিক ৬১ শতাংশ।
পরিকল্পনা কমিশনের সচিব মামুন-আল-রশীদ সমকালকে বলেন, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নেওয়া সরকারের কৃচ্ছ্রতা নীতির কারণেই মূলত বাস্তবায়ন কম হচ্ছে। বি ক্যাটাগরির প্রকল্প কম বরাদ্দ পেয়েছে। সি ক্যাটাগরির প্রকল্প তো কোনো অর্থ বরাদ্দ পায়নি। প্রকল্পভিত্তিক অন্যান্য কারণও রয়েছে।
চলতি অর্থবছর এডিপিতে মোট বরাদ্দের পরিমাণ ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। পাঁচ মাসে বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ৪৭ হাজার ১২২ কোটি টাকা। এডিপির মোট বরাদ্দের মধ্যে সরকারের জোগান দেওয়ার কথা ৪৯ হাজার ১৬ কোটি টাকা, যা মোটের ৫৮ দশমিক ২১ শতাংশ। বিদেশি অর্থায়নের অংশ ৯২ হাজার ২০ কোটি টাকা বা ৩৬ শতাংশ। বিভিন্ন সংস্থার নিজস্ব উৎস থেকে ৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ বা ৯ হাজার ৯৩৭ কোটি টাকা জোগান দেওয়ার কথা।
এডিপি বাস্তবায়নের প্রবণতা বিশ্নেষণে দেখা যায়, স্থানীয় উৎসের চেয়ে বিদেশি অর্থায়নের ব্যবহার কিছুটা বেশি। বিদেশি অর্থায়ন ব্যবহারের হার ১৯ দশমিক ২৯ শতাংশ। আর সরকারি অর্থের উৎসের অর্থায়নে বাস্তবায়ন হার ১৮ দশমিক ৪২ শতাংশ। এ প্রসঙ্গে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ডলারের বিপরীতে টাকার মান ২০ থেকে ২৫ শতাংশ কমে যাওয়ার কারণে বিদেশি উৎসের ব্যয় বেশি দেখা যাচ্ছে।
এডিপি বাস্তবায়নের দিক থেকে পিছিয়ে থাকা বড় মন্ত্রণালয় এবং বিভাগের মধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এ সময়ে কোনো ব্যয় হয়নি। অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের বাস্তবায়ন হার মাত্র শূন্য দশমিক ৫৩ শতাংশ। প্রায় একই অবস্থা সরকারি কর্ম কমিশনের। বাস্তবায়নের হার ২ শতাংশেরও কম। জননিরাপত্তা বিভাগের বাস্তবায়নের হার ৩ শতাংশেরও কম।
এ ছাড়া গুরুত্বের দিক থেকে বৃহৎ বরাদ্দের ১৫ মন্ত্রণালয় এবং বিভাগের মধ্যে বরাবরের মতোই পিছিয়ে আছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। গেল পাঁচ মাসের এই বিভাগের বাস্তবায়নের হার সাড়ে ৭ শতাংশ। ৪২ প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে এই বিভাগের অধীনে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এডিপি বাস্তবায়নের হারও ১০ শতাংশের কম।
অগ্রাধিকারের বড় প্রকল্পের বাস্তবায়নও ধীর :বাস্তবায়নে সরকারের অগ্রাধিকার সত্ত্বেও ফাস্টট্র্যাক প্রকল্পের অগ্রগতিও সন্তোষজনক নয়। ফাস্টট্র্যাক প্রকল্পের সংখ্যা আটটি। কৃচ্ছ্রতার অংশ হিসেবে চলতি অর্থবছরের বাজেটে এসব প্রকল্পের বরাদ্দ কমানো হয়েছে। শুরু থেকে নভেম্বর পর্যন্ত মেট্রোরেল প্রকল্পের বাস্তবায়ন হয়েছে ৬৫ শতাংশ। প্রকল্পের একটি অংশ উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত আগামী ২৮ ডিসেম্বর উদ্বোধন করা হচ্ছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অগ্রগতি ৫৩ শতাংশের কিছু কম। আর্থিক অগ্রগতি ৫১ শতাংশের মতো। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রগতি ৬৭ শতাংশ। আগামী ২০২৪ সালের জুনে প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা। দোহাজারী-রামু- কক্সবাজার-মিয়ানমারের ঘুনধুম পর্যন্ত রেলের ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ৩৯ শতাংশ। ২০১০ সাল থেকে প্রকল্পটি চলছে। আগামী ২০২৪ সালের জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা।
সোর্স : সমকাল