আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরা: উপকূলীয় অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর হু হু করে নেমে যাচ্ছে। এ কারণে বোরো চাষিরা ১০ থেকে ১২ ফুট পর্যন্ত মাটি গর্ত করে শ্যালো মেশিন বসিয়ে পানি তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এতে বিপাকে পড়েছেন হাজার হাজার বোরো চাষি। বাংলাদেশ ওয়াটার পার্টনারশিপ হুঁশিয়ারি করে বলেছে, ২০৩০ সাল নাগাদ ভূগর্ভের ওপরের অ্যাকোয়াফারের পানি ফুরিয়ে যাবে। এতে ব্যাপক হারে ভূমির অবনমন ঘটবে। আর ভূ-উপরিভাগের খাবার পানির উৎস কমে যাবে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ডিপিএইচই) দেয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিদিন প্রায় ২৭ লাখ ৫০ হাজার লিটার পানির প্রয়োজন হয়, যার ৮০ শতাংশ ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে উত্তোলন করা হয়।’ মেকিং দ্য ইনভিসিবল ভিসিবল’ শিরোনামে জাতিসংঘের বৈশ্বিক পানি উন্নয়ন প্রতিবেদন ২০২২ এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের চেয়ে বেশি পানি উত্তোলনকারী বাকি ৬ দেশ হলো চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, পাকিস্থান ও তুরস্ক। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের ৯৯ শতাংশ সুপেয় পানির উৎস হচ্ছে মাটির নিচে সঞ্চিত পানি। জাতিসংঘের সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১০ সালে বাংলাদেশ বছরে ৩০ ঘন কিলোমিটার এলাকা থেকে পানি উত্তোলন করেছে এবং ৮৬ শতাংশ পানি সেচ কাজে ব্যবহার করেছে। বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, উত্তোলন করা পানির প্রায় ৯০ শতাংশ সেচ কাজে এবং বাকি ১০ শতাংশ গৃহস্থালি কাজে ও শিল্প খাতে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের প্রায় ৫ থেকে ২৪ শতাংশ ভূমি এলাকা উচ্চ পর্যায়ের আর্সেনিক, লবণাক্ততা ও ভূগর্ভস্থ পানির সঞ্চয় ফুরিয়ে যাওয়ার আশংকায় আছে। ফলে চলতি মৌসুমে বোরো ধানের আবাদ নিয়ে সংশয়ে রয়েছে চাষিরা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, বিগত এক দশকের ব্যবধানে খুলনাঞ্চলের জেলাগুলোতে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহারে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়েছে বলে পরিবেশবিদরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটাতে চাষি অধিক মাত্রায় বোরো চাষে ঝুঁকছেন। গত বোরো মৌসুমে প্রায় ১০ হাজার কোটি ঘনফুট ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার হয়েছিল। কৃষি স¤প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, বোরো চাষে গড়ে একরে ৮০ ইঞ্চি পানির প্রয়াজন হয়। ওই হিসাব অনুযায়ী এক একরে দুই লাখ ৮৩ হাজার ১৪০ ঘনফুট পানির প্রয়োজন পড়ে। সূত্রে জানা যায়, চলতি রবি মৌসুমে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট জেলায় প্রায় পৌনে এক লাখ অগভীর (শ্যালো মেশিন) এবং ছয় শতাধিক নলকূপ সেচ কাজে ব্যবহারে হচ্ছে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সাতক্ষীরা সূত্রে জানা যায়, সরকারি হিসাব মতে জেলাতে সাড়ে ৩৬ হাজার নলকূপ রয়েছে। যার মধ্যে অকেজো রয়েছে সাজে ৫ হাজারটি এবং সচল রয়েছে ৩১ হাজারটি। তবে বাস্তবতা হলো অকেজোর সংখ্যা আরও বেশি।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৮০-৮১ সালে এক কেজি ধান উৎপাদনে সেচের পানির প্রয়োজন হতো ২ হাজার ৮০০ লিটার। ২০০৬-০৭ সালে তা বেড়ে ৩ হাজার ২০০ লিটারে গিয়ে দাঁড়ায়। সর্বশেষ ২০২১-২২ সালে তা চার হাজার লিটারে উঠেছে। প্রতি বছরই ধান উৎপাদনে পানির ব্যয় বাড়ছে। বিশেষ করে হাইব্রিড ধানের ব্যবহার বাড়ায় পানির প্রয়োজন বাড়ছে।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) হিসাবে, বর্তমানে দেশে কৃষিকাজে ব্যবহার করা পাম্প আছে প্রায় ১৪ লাখ। এর মধ্যে ডিজেলচালিত ১১ লাখ ৯২ হাজার ৬৩০টি। বিদ্যুতে চলে মাত্র ১ লাখ ৮৬ হাজার ৪০০টি। অগভীর নলকূপ বিদ্যুতে চলে ১ লাখ ৫০ হাজার। ডিজেলে চলে ১০ লাখ ৭০ হাজার। গভীর নলকূপের মধ্যে ১২ হাজার ডিজেলে এবং ২৬ হাজার বিদ্যুতে চলে। বোরো মৌসুমে ১৭ লাখ শ্যালো টিউবওয়েল কার্যকর থাকে। আগে এসব টিউবওয়েলে ২০ থেকে ২২ ফুট মাটির নিচ থেকে পানি তোলা যেত। কিন্তু এখন মাটির ২৮ ফুট নিচে গিয়েও পানি পাওয়া যাচ্ছে না। কৃষক পাঁচ ফুট মাটি গর্ত করে সেখানে শ্যালো টিউবওয়েল বসাচ্ছে। এর পরও অনেক জায়গায় পানি পাওয়া যাচ্ছে না।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ১৯৭০-৭১ সালে প্রকৃতিনির্ভর আমন ও আউশ থেকে মোট উৎপাদনের সিংহভাগ আসত। মাত্র ২০ শতাংশ ফসল আসত বোরো থেকে। এখন দেশের ৬০ শতাংশ চাল আসে বোরো থেকে। ৩০ শতাংশ আমন এবং ১০ শতাংশ আসে আউশ থেকে। এ সময়ে বোরোর মোট উৎপাদন বেড়েছে প্রায় আট গুণ। এ সময়ে দেশে বর্ষার পানিনির্ভর আউশের চাষ কমেছে এক-তৃতীয়াংশ জমিতে। আর আমনের চাষ কমেছে ৪৪ শতাংশ।
সরেজমিনে তালার কয়েকটি ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ মাঠে বোরো আবাদের জমিতে দেখা যায়, অনেক বোরো চাষি গভীর নলকূপ স্থাপনের পরও জমিতে সেচ কাজে আশানুরূপ পানি পাচ্ছে না। তারা গর্তের মধ্যে মেশিন বসিয়ে পানি তোলার চেষ্টা করছে। ভুক্তভোগী বোরো চাষি সোলাইমানসহ কয়েকজন বলেন, ‘৯০ থেকে ১২০ ফুট গভীরে পাইপ বসিয়েও সেচ কাজের জন্য ঠিকমতো পানি পাওয়া যাচ্ছেনা। শ্যালো মেশিনে পানি কম ওঠায় বোরো চাষাবাদে জ্বালানি খরচ বেড়ে গেছে। সেচ কাজে সময় বেশি লাগছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তেল দূষণ, শিল্প, কৃষি ও পশুপালন, রোগ-জীবাণু, পয়োনিষ্কাশন, তেজস্ক্রিয় পদার্থ, বন উজাড়, লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ এসব বিভিন্ন কারণে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে
এদিকে ভূ-গভীরে বৃষ্টির পানি পাঠাতে নতুন প্রকল্প নিচ্ছে সরকার। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, উপকূলীয় অঞ্চলসহ যেসব এলাকায় পানির স্তর নেমে যাচ্ছে শ্যালো গ্রাউন্ড ওয়াটার বা অগভীর ভূগর্ভস্থ পানিতে, যেখানে হালকা লবণাক্ততা এলাকায় এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে।
সোর্স : দৈনিক সংগ্রাম