দুই মাসের বেশি সময় ধরেই বাজারে চিনির সরবরাহ কম। পাশাপাশি দামও বেড়েছে অস্বাভাবিক। অন্যদিকে ভোজ্যতেলের সরবরাহে সংকট না থাকলেও ক্রেতাদের কিনতে হচ্ছে আগের বাড়তি দরেই। দাম কমানোর ঘোষণার পাঁচ দিন পার হলেও নতুন কম দরের তেল মিলছে না কোথাও। এর মধ্যে পাম অয়েলের দাম উল্টো বেড়েছে। বাজারে চিনি আর ভোজ্যতেলের ‘শনির দশা’ যেন কাটছেই না। ফলে এ দুটি নিত্যপণ্য নিয়ে বড় বিপদে ক্রেতারা।
ভোক্তাদের অভিযোগ, চিনি নিয়ে বাজারে অরাজকতা চলছে। যে যেভাবে পারছে ক্রেতার ‘পকেট কাটছে’। ভোজ্যতেলের দাম কমানোর ঘোষণা দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছে সরকার। কার্যত এর কোনো প্রভাব নেই বাজারে। বাজারে পণ্যের সরবরাহ ও দাম নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সরকারের নজরদারি নেই বললেই চলে।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর তেজকুনিপাড়া এলাকায় ফ্রেশ ব্র্যান্ডের ৫ লিটারের একটি বোতল ৯২৫ টাকায় কেনেন আব্দুল আলী। বেসরকারি চাকরিজীবী এ ক্রেতা ক্ষোভ ঝেড়ে বলেন, ‘আপনারা লিখে জনগণের কোনো উপকার করতে পারছেন? টিভিতে এক সপ্তাহ আগে দেখলাম, তেলের দাম কমছে। এখন আগের দামেই কিনলাম।’
মোহাম্মদপুর টাউন হল মার্কেট থেকে ১৪০ টাকায় প্যাকেটজাত এক কেজি লাল চিনি কিনেছেন একই এলাকার বাসিন্দা সবুরা বেগম। তিনি বলেন, ‘চিনি নাই কেন বুঝতে পারছি না। ঘুরতে ঘুরতে দুই-এক দোকানে পাওয়া গেলেও দাম বেশি। এক কেজির দাম নিয়েছে ১৫০ টাকা।
গত ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকার নির্ধারিত প্রতি কেজি খোলা চিনি ৭৪ এবং প্যাকেটজাত চিনির দাম ৭৫ টাকা ছিল। তবে চিনি আমদানি ও পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশনের দাবির মুখে ২২ সেপ্টেম্বর দাম বাড়িয়ে খোলা চিনির কেজি ৮৪ এবং প্যাকেটজাত চিনি ৮৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়। দুই সপ্তাহের মাথায় গত ৬ অক্টোবর কেজিতে আরও ৬ টাকা বাড়িয়ে খোলা চিনি ৯০ এবং প্যাকেটজাত চিনির কেজি ৯৫ টাকা করা হয়। তৃতীয় দফায় গত ১৭ নভেম্বর কেজিতে ১৩ টাকা বাড়িয়ে প্যাকেটজাত চিনি ১০৮ টাকা এবং খোলা চিনির কেজিতে ১২ টাকা বাড়িয়ে ১০২ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
সেই হিসাবে গত দুই মাসে সরকার চিনির কেজিতে ৩৩ টাকা দাম বাড়িয়েছে। এর পরও বাজারে চিনির সংকট চলছে। কোথাও পাওয়া গেলেও কিনতে
হচ্ছে সরকার নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি দামে। এর মধ্যে খোলা চিনির কেজি ১১০ থেকে ১১৫ টাকায় পাওয়া গেলেও প্যাকেটজাত লাল চিনির দাম অনেক বেশি।
গত ৩ নভেম্বর ১৪ টাকা বাড়িয়ে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন প্রতি কেজি লাল চিনির (দেশি) দাম নির্ধারণ করে ৯৯ টাকা। অথচ বাজারে বিভিন্ন কোম্পানির প্যাকেটজাত লাল চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৩৫ থেকে ১৬০ টাকা কেজি দরে। সেই হিসাবে চিনিকল করপোরেশন নির্ধারিত দরের চেয়ে কেজিতে ৩৬ থেকে ৬১ টাকা বেশি দামে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা।
দামে না পোষানোর কারণে ও জরিমানার ভয়ে খুচরা ব্যবসায়ীদের অনেকেই চিনি বিক্রি করা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। কারওয়ান বাজারের ইয়াসিন জেনারেল স্টোরের এক বিক্রয়কর্মী বলেন, ‘প্যাকেটজাত সাদা চিনির কেজি ১০৭ টাকা। কোম্পানিগুলো এই দামেই খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে। এ কারণে খুচরা ব্যবসায়ীরা ১১০ টাকায় বিক্রি করেন। তবে বেশি দামে বিক্রি করলে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা জরিমানা করে। এ জন্য আমরা চিনি বিক্রি করি না।’
চিনির সরবরাহে সংকট থাকলেও ভোজ্যতেলের সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে। গত ১৩ ডিসেম্বর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সয়াবিন তেল লিটারে ৫ এবং পাম অয়েল লিটারে ৪ টাকা কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর ১৫ ডিসেম্বর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দাম কমানোর ঘোষণা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল ১৬৭ টাকা, বোতলজাত তেল ১৮৭ টাকা, ৫ লিটারের বোতল ৯০৬ এবং পাম অয়েলের লিটার ১২১ টাকা থেকে কমিয়ে ১১৭ টাকা করা হয়েছে। ১৮ ডিসেম্বর থেকে এ দর কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। তবে পাঁচ দিন পার হলেও বাজারে নতুন দরের বোতলজাত তেল দেখা যায়নি। আগের দামে অর্থাৎ লিটার ১৯২ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে বোতলজাত তেল আর খোলা সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে ১৭০ থেকে ১৭২ টাকায়। অন্যদিকে দাম না কমে উল্টো বেড়েছে পাম অয়েলের। লিটার বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৩২ টাকা দরে।
কারওয়ান বাজারের আব্দুর স্টোরের এক বিক্রয়কর্মী বলেন, দাম কমলেও নতুন তেল আসতে ৮ থেকে ১০ দিন লেগে যায়। কোম্পানিগুলো আগের বাড়তি দরের তেল দিচ্ছে। তবে কেউ কেউ আগের তেল দিলেও দাম কিছুটা কম রাখছে বলে জানিয়েছেন একই বাজারের শাহপরাণ স্টোরের স্বত্বাধিকারী মো. মামুন।
সোর্স : সমকাল