এক রক্ষণশীল হিসাব অনুযায়ী বিরোধী দলের ‘ঢাকা চলো’ কর্মসূচি ও বিভাগীয় সম্মেলনগুলো ঠেকানোর জন্য বিএনপি-জামায়াতের ১৫ সহস্রাধিক নেতা-কর্মীকে আটক করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে বারবার বলা হয়েছে যে, গোয়েন্দাদের তরফ থেকে তারা এই দিন একাধিক নাশকতার ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরেছেন এবং এই নাশকতা যাতে ঘটতে না পারে তার জন্য অতিরিক্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে এসব পদক্ষেপ তারা গ্রহণ করেছেন। কিন্তু দেশবাসীর এখানে প্রশ্ন, ২০০৯ সালে যখন এদেশের গর্ব সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআর ও তাদের সামরিক নেতৃত্বকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার লক্ষ্যে ইতিহাসের মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছিল তখন আমাদের সামরিক-বেসামরিক ও আধাসামরিক গোয়েন্দা সংস্থাসমূহ কোথায় ছিল? তারা বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ মহাসমাবেশ অনুষ্ঠানের মধ্যে নাশকতার তথাকথিত ষড়যন্ত্র আবিষ্কারে সক্ষম হলেন, কিন্তু দেশ ও দেশের প্রতিরক্ষাবাহিনীকে ধ্বংসের এই পূর্বাভাস পেলেন না কেন? এবং যারা এই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলেন তাদের বিরুদ্ধে সরকার শাস্তিমূলক কোন পদক্ষেপই বা গ্রহণ করলেন না কেন? সারাদেশে এ যাবত শাসকদলের ছাত্রসংগঠন, যুব সংগঠন এবং শ্রমিক সংগঠন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মাদরাসা, স্কুল এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ৭৫১টি সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে এবং এতে ১০ সহস্রাধিক লোক হতাহত হয়েছে। তারা অস্ত্রের মহড়া দিয়েছে। নির্বিচারে দেশীয় ও আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেছে। গোয়েন্দারা এই নাশকতামূলক কাজগুলোর পরিকল্পনা সম্পর্কে সরকারকে কি অবহিত করেননি? এবং করে থাকলে এত পুলিশ, র্যাব, বিজিবি থাকতে তারা এই ঘটনাগুলো ঘটাল কিভাবে? দ্বিতীয়ত বিরোধীদলের মহাসমাবেশ ঠেকানোর জন্যে শাসকদল ও তার অঙ্গসংগঠনগুলো ১০ ডিসেম্বর ও তার আগে দেশব্যাপী যে সশস্ত্র মহড়া প্রদর্শন করেছে সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কি তা দেখেননি? আর দেখে থাকলেও কি তারা তাকে নাশকতা বা সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বলে মনে করেন না? হকিস্টিক, লগি, বৈঠা, কিরিচ, রামদা, চাইনিজ কুড়াল, পিস্তল, ছুরি-ড্যাগার এগুলো কি সরকারের কাছে শান্তির প্রতীক না সন্ত্রাসের বাহক? সরকার যদি মনে করেন যে, সরকারি দলের লোকেরা এসব অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বিরোধীদলের নেতা-কর্মীদের উপর হামলা করার শতভাগ অধিকার সংরক্ষণ করেন, তাহলে পুরো অভিধান এবং নীতি-নৈতিকতার সব মানদন্ডই পরিবর্তন করে দিতে হয়। কিন্তু তারা নিশ্চয়ই জানেন যে, দল বা ব্যক্তিবিশেষের ক্ষমতা ও বিত্ত-বৈভবের নিরাপত্তার জন্য তা পরিবর্তন করা সম্ভবপর নয়।
আমি অনেক মানুষের মুখে শুনেছি যে, বিরোধী দলের মহাসমাবেশ ভন্ডুল করার জন্য আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার দেশে যে অবস্থার সৃষ্টি করেছিলেন এবং যে যুদ্ধংদেহী অবস্থান তারা গ্রহণ করেছেন অতীতের ঔপনিবেশিক এবং স্বৈরাচারী সকল সরকারের রেকর্ডকে তা ম্লান করে দিয়েছে। কিন্তু তথাপি মহাসমাবেশ হয়েছে। এবং সরকার পল্টন ময়দানকে সমাবেশস্থল হিসেবে ব্যবহারের অনুমতি না দিয়ে মনে করেছিলেন যে, আংশিক হলেও বিরোধী দল ব্যর্থ হবে। কিন্তু সমাবেশস্থলে লাখ লাখ লোকের উপস্থিতি এবং গোলাপবাগ থেকে যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, মুগদা স্টেডিয়াম, কমলাপুর প্রভৃতি বিশাল অঞ্চলে তার বিস্তৃতি এ কথা প্রমাণ করেছে যে, সরকারের সকল অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে এবং বাধার বিন্ধাচল মাড়িয়ে প্রায় দশ লাখ লোকের সমাবেশ করা বিরোধী দলের জন্য মোটেই কঠিন কোন কাজ নয়। এটা ছিল সরকারের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে একটি প্রতীকী প্রতিবাদ। সরকার পতনের কর্মসূচি নয়। এই মহাসমাবেশে সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা কোন বিশালত্ব খুঁজে পাননি। তারা ধারণা করেছিলেন যে, টিভি চ্যানেলসমূহকে মহাসমাবেশের ধারা বিবরণী সরাসরি সম্প্রচারে বাধা দিয়ে দেশবাসীকে তারা অন্ধকারে রাখবেন। তারা একে খাটো করেই দেখেছিলেন, অনেকের দৃষ্টিতে চোখে গাড় ছানি পড়লে যেমন অবস্থা হয়। আওয়ামী লীগ ১৯৭২-৭৫ সাল পর্যন্ত দুঃশাসন, অত্যাচারের একটি রেকর্ড সৃষ্টি করেছিল। তাদের বর্তমান মেয়াদে তারই পুনরাবৃত্তি ঘটছে বলে অনেকে অভিমত প্রকাশ করছেন। কারো কারো মতে তাদের এই রেকর্ড অতীতের রেকর্ড থেকেও ভয়াবহ। দেশ ও জাতির স্বার্থে এই অবস্থার পরিবর্তন হওয়া বাঞ্ছনীয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি বলেছেন যে, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করা এত সহজ নয়। এর আগে তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন যে, দিল্লী গিয়ে তিনি ভারত সরকারকে যে কোনভাবে হোক শেখ হাসিনা সরকারকে রক্ষা করতে বলে এসেছেন। তাদের কথার অর্থ হচ্ছে এখানে বাংলাদেশের কোটি কোটি ভোটারের কোন ভূমিকা নেই। তার এই মন্তব্যের পর আমি বহু ভোটারের মধ্যে হতাশার ভাব দেখতে পেয়েছি। একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা নিশ্চয়ই দায়িত্বশীলতা নিয়ে কথা বলেছেন। আর যদি তাই হয় তাহলে নিজ দেশের ভোটারদের প্রতি অপমান এবং আস্থাহীনতার এর চেয়ে দ্বিতীয় কোন নজীর থাকতে পারে না। দল মত নির্বিশেষে বাংলাদেশের সকল ভোটারের উচিত তার এই মন্তব্যের প্রতিবাদ করা। শেখ হাসিনার এই মন্তব্যটি যদি সঠিক হয় তাহলে ধরে নিতে হয় যে, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে তার দল বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসার ঘটনাটি আসলে একটি প্রহসন। ঐ নির্বাচনের কোন তাৎপর্যই ছিল না। যুক্তরাষ্ট্র, ‘র ও আইএসআইকে সন্তুষ্ট করেই তিনি ক্ষমতায় এসেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এটা কি আসলেই সম্ভব? হয়ত সম্ভব। কেননা তার সরকার গত ১৪ বছরে গণবিরোধী যে সব কর্মকান্ড বাস্তবায়ন করেছেন এবং করে চলেছেন তাতে মনে হয় না যে, ভোটারদের সমর্থনে আরেকবার তারা ক্ষমতায় আসার আশা করেন। তার দ্বিতীয় মন্তব্যটি হচ্ছে ১৯৯১ সালে বিএনপি কর্তৃক পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ সংক্রান্ত। ১৯৯১ সালে নির্বাচনে হেরে তিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনার, প্রধান উপদেষ্টা ও রাষ্ট্রপ্রধান এমনকি সেনাপ্রধানকেও বিশ্বাসঘাতক আখ্যায়িত করেছেন। ঐ সময়ে তার দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি এবং জামায়াতের সমর্থনে সরকার গঠনের জন্য জামায়াত প্রধান অধ্যাপক গোলাম আযমের কাছে ধরনা দিয়েছিলেন। জামায়াতের সমর্থনে বিএনপি তখন সরকার গঠন করেছিল। এত বছর পর তিনি বিএনপির বিরুদ্ধে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে অর্থগ্রহণের অভিযোগ করছেন এবং বিএনপি নেত্রীকে এই অপরাধে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়ার ঘোষণা দিচ্ছেন। এর মধ্যে অনেকেই ইদি আমীনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাচ্ছেন। এর মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পাকিস্তান সুপ্রিমকোর্টে দেয়া সে দেশের গোয়েন্দা প্রধান দুররানীর এফিডেভিটের কপি সংগ্রহ করেছেন এবং সাংবাদিকদের মধ্যে তা বিতরণ করেছেন। এতে দেখা যায় যে, জনাব দুররানীর দেয়া জবানবন্দীতে বাংলাদেশ কিংবা বিএনপিকে বিতরণকৃত অর্থের কোন উল্লেখ নেই। অর্থ প্রদানের তথ্যটির সূত্র হচ্ছে ভারতের একজন সাংবাদিক। যিনি আওয়ামী বান্ধব হিসেবে পরিচিত। দ্যা ইকোনোমিস্ট পত্রিকা কয়েক বছর আগে একটি চাঞ্চল্যকর খবর দিয়েছিল এবং বলেছিল যে, ভারতের বস্তা বস্তা টাকা এবং কূটনৈতিক সমর্থন নিয়ে ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে বাংলাদেশের ক্ষমতায় এসেছে। অনেকেই ধারণা করছেন যে, ঐ তথ্যটির মোকাবিলায় আরেকটি তথ্য খাঁড়া করার উদ্দেশ্যেই ভারতীয় এই সাংবাদিক আইএসআইয়ের অর্থ বিতরণ সংক্রান্ত এই ভুয়া তথ্যটি তৈরি করে দিয়েছেন। একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির কাজ হচ্ছে তথ্যের সত্যতা যাচাই করে তার উপর মন্তব্য করা। এ সম্পর্কে ঢালাও মন্তব্য তার ব্যক্তিত্বকে খাটো করে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর উচিত রাষ্ট্রীয়ভাবে এর সত্য-মিথ্যা যাচাই করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এক্ষেত্রে আইএসআই, ‘র এবং প্রয়োজনবোধে সিআইএ ও মোসাদের তৎপরতাও বিচার্য বিষয় হতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারে বসে বাংলাদেশের কোন নাগরিককে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রী তো দূরের কথা, অন্যদেশে পাঠিয়ে দেয়ার ঘোষণা শোভনীয় হতে পারে না। আর ক্ষমতা কখনো কারো চিরস্থায়ী হয় না।