পাঠ্যপুস্তকের বিপুল পরিমাণ ঘাটতি নিয়ে উদযাপিত হতে যাচ্ছে আগামী শিক্ষাবর্ষের বই উৎসব। নতুন বছরের প্রথম দিন থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনা মূল্যে বিতরণ করা হবে এসব পাঠ্য বই।
প্রেস মালিকদের মতে, বছরের প্রথম দিন ৫০ শতাংশের বেশি বই সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। প্রাথমিকে এই সংকট তীব্র।
বিজ্ঞাপন
মাধ্যমিকের বই ছাপা হয়েছে নিউজপ্রিন্টে। এতে বইয়ের উজ্জ্বলতা কাঙ্ক্ষিত মানের নিচে থাকবে।
বই উৎসবের প্রধান আকর্ষণ প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের বই বিতরণ। কিন্তু বইয়ের বেশ ঘাটতি থাকায় একসঙ্গে দেশের সব শিক্ষার্থীকে পাঠ্য বই বিতরণ করা সম্ভব হবে না।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে বইয়ের ঘাটতি থাকার তিনটি কারণ উল্লেখ করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা; দেশে ভার্জিন পাল্প (কাগজ তৈরির মণ্ড) না থাকা, আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিরতায় পাল্পের মূল্যবৃদ্ধি ও বই ছাপার দরপত্র কার্যক্রমের ধীরগতি।
পাঠ্যপুস্তক তৈরি ও বিতরণের তত্ত্বাবধানে রয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। চলতি বছর প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রায় ৩৪ কোটি বই ছাপার কাজ চলমান। এর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিকের বই রয়েছে প্রায় ৬৫ লাখ, প্রাথমিকের প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় ১০ কোটি, মাধ্যমিকের ২৩ কোটি ৮২ লাখ ৭০ হাজার ৫৮৮টি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় রচিত দুই লাখ ৩৫ হাজারের বেশি বই।
সংকট বেশি প্রাথমিকে : এনসিটিবির তথ্য মতে, দরপত্র কার্যক্রমে ধীরগতির কারণে মাত্র দেড় সপ্তাহ আগে প্রাথমিক স্তরের বই ছাপার কাজ শুরু হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে বই ছাপা হয়েছে মাত্র ৩০ শতাংশ, যেখানে মাধ্যমিক পর্যায়ে ছাপা হয়েছে ৬০ শতাংশ বই। প্রাথমিকের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির মোট দুই কোটি ৩৬ লাখ বইয়ের মধ্যে এক কোটি বইয়ের ছাপার কাজ শেষ হয়েছে। তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ছয় কোটি ৪৮ লাখের মধ্যে প্রস্তুত হয়েছে তিন কোটি পাঠ্য বই। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর দুই লাখ ৩৫ হাজারের মধ্যে শতভাগ প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রাক-প্রাথমিকের জন্য প্রস্তুত প্রায় ৬৫ লাখ বা শতভাগ বই। প্রস্তুত করা বই জেলা-উপজেলা পর্যায়ে পাঠানো হচ্ছে। মাধ্যমিকের প্রায় ২৪ কোটি বইয়ের মধ্যে ছাপা হয়েছে ১৫ কোটি। এর মধ্যে ১২ কোটি বই সারা দেশে পৌঁছে গেছে।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান মো. ফরহাদুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রাথমিকের বই দ্রুত প্রস্তুত করতে আমিনি, এসআর, সরকার প্রিন্টার্সসহ বড় কিছু প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হয়েছে। মোট ৯৮টি লটের মধ্যে ৪২টি লট এমন মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে, যারা আগে কাজ পায়নি। যেসব প্রতিষ্ঠান মাধ্যমিক ও প্রাথমিকের কাজ পেয়েছে, তাদের মাধ্যমিকের বই ছাপানো আপাতত বন্ধ রেখে প্রাথমিকের বই ছাপাতে বলা হয়েছে।
মো. ফরহাদুল ইসলাম বলেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ৮০ শতাংশ বই প্রস্তুত করা হবে বলে আশা করছি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক প্রেস মালিক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কাগজসংকট থাকায় বছরের প্রথম দিনে নিম্নমানের কাগজ দিয়েও সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ বই বিতরণ সম্ভব হবে। এ সময় প্রাথমিকের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশের বেশি বই দেওয়া সম্ভব হবে না। এ বছর একটি প্রতিষ্ঠানকেই প্রাথমিকের ৩০ শতাংশ বই ছাপতে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া দু-তিনটি বড় প্রেস মালিকের কাছে এনসিটিবি জিম্মি হয়ে পড়েছে। এসব প্রেস মালিকের সরবরাহ করা বইয়ের হিসাব করলে প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে। ’
উজ্জ্বলতা কাঙ্ক্ষিত মানের নিচে : প্রতিবছর অফসেট পেপারে ৮৫ শতাংশ উজ্জ্বলতা দিয়ে পাঠ্যপুস্তক তৈরির নির্দেশনা দেওয়া হয়। এ বছর কাগজসংকট থাকায় রিসাইকল পেপার দিয়ে বই প্রস্তুত করা হচ্ছে। এতে ৮২ শতাংশ উজ্জ্বলতা দিতে প্রেস মালিকদের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করে এনসিটিবি।
বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি শহীদ সেরনিয়াবাত কালের কণ্ঠকে বলেন, রিসাইকল পেপার দিয়ে পাঠ্যপুস্তকে সর্বোচ্চ ৬৫ শতাংশ উজ্জ্বলতা দেওয়া যাবে। কাগজসংকট থাকায় মাধ্যমিকের বেশির ভাগ বই তৈরিতে নিউজপ্রিন্টের ব্যবহার হচ্ছে। সেখানে উজ্জ্বলতার প্রশ্নই আসে না। আবার প্রাথমিকের বই আরজিবি কালার (চার রং) প্রিন্ট করতে হয়। এসব বই রিসাইকল পেপার দিয়ে নয়, ভার্জিন পাল্প দিয়েই করতে হবে।
চক্ষু বিশেষজ্ঞের বক্তব্য : কাঙ্ক্ষিত মানের উজ্জ্বলতা না থাকালে নতুন পাঠ্য বই শিক্ষার্থীদের চোখে সমস্যা তৈরি করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের চক্ষুবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. আফজাল মাহফুজউল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শিশুদের ক্ষেত্রে কাছে দেখার দৃষ্টি প্রবণতা অনেক বেড়ে গেছে। ২০২০ সালের পর থেকে অনলাইন অ্যাক্টিভিটিজ অনেক বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে শিশুরা স্ক্রিননির্ভর হয়ে পড়েছে। তাদের চোখে প্রচণ্ড চাপ পড়েছে। ২০২১-২২ সালে শিশুদের চশমার প্রয়োজন আগের তুলনায় বেড়েছে।
এই চক্ষু বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘এ পরিস্থিতিতে কাছে দৃষ্টি দেওয়া কমিয়ে আমরা পর্যাপ্ত আলোতে পড়াশোনা করার পরামর্শ দিয়েছি। কিন্তু দেখা যায়, বেশির ভাগ শিশুর স্কুলের ক্লাসরুমে পর্যাপ্ত আলো থাকে না। আবার বাসায় যেখানে পড়াশোনা করে, সেখানেও পর্যাপ্ত আলো থাকে না। আমি মনে করি, যেহেতু আমাদের সর্বত্র আলোকস্বল্পতা রয়েছে, সে কারণে বইয়ে উজ্জ্বলতা যা আছে, তা কোনোভাবে কমানো উচিত নয়। এতে শিশুদের চোখের চাপ আরো বাড়বে। ’
বইয়ের মান খারাপ হলে ব্যবস্থা : এনসিটিবি সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক লুত্ফুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, এখন মুদ্রণপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নিম্নমানের বই ছাপার সুযোগ কম। সপ্তাহে তিন দিনের বদলে এখন সাত দিন ছাপাখানা পরির্দশন করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত সাতটি প্রতিষ্ঠানে নিম্নমানের কাগজ বা ছাপা বই পাওয়া গেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্য রয়েছে কচুয়া, সরকার অফসেট পেজ, হাওলাদার, আলামিন, মেরাজ ও আমিন প্রিন্টার্স। সংকট থাকার কারণে কাগজ পুড়িয়ে দেওয়া হয়নি। তবে কেটে ওয়েস্টেজ হিসেবে ফেরত দেওয়া হয়েছে। এগুলো তাদের রিসাইকল পেপার তৈরিতে কাজে লাগবে।
এ ব্যাপারে এনসিটিবি চেয়ারম্যান বলেন, মুদ্রণপ্রতিষ্ঠানগুলোর ২০ শতাংশ অর্থ জমা থাকে। বই পাঠানোর দুই মাস পর ওই অর্থের ছাড়পত্র দেওয়া হয়। যদি কোনো প্রতিষ্ঠান মানহীন বই দিয়ে থাকে, তবে শাস্তি হিসেবে তাদের অর্থদণ্ড করা হবে। এ বছর যারা নির্ধারিত সময়ে বই দিতে গড়িমসি করবে, তাদের শুধু কালো তালিকাভুক্তি নয়, বরং তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।