কম্পানিগুলো কয়েক দফায় পাস্তুরিত দুধের দাম বাড়ালেও নায্য মূল্য পাচ্ছেন না খামারিরা। কম্পানিভেদে চলতি মাসে প্রতি লিটার তরল দুধের দাম বাড়ানো হয়েছে পাঁচ থেকে ১০ টাকা। তবে খামারিদের কাছ থেকে আগের দামেই দুধ কিনছে কম্পানিগুলো। খামারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কম্পানিগুলোর এ আচরণে অনেক খামারি খামার বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
মিল্ক ভিটা, আড়ং, প্রাণ, ফার্মফ্রেশ, বাকারাসহ বেশ কয়েকটি কম্পানি দেশজুড়ে পাস্তুরিত দুধ বাজারজাত করে। গত জুলাইয়ের পর চলতি মাস পর্যন্ত দুই দফায় প্রায় সব কম্পানি দুধের দাম বাড়িয়েছে। খামারিদের কাছ থেকে কম্পানিগুলো প্রতি লিটার দুধ কেনে ৪৪ থেকে ৪৮ টাকায়। প্রক্রিয়াজাত করার পর দেশের বাজারে প্রতি লিটার দুধ বিক্রি করা হচ্ছে ৯০ থেকে ১১০ টাকা।
রাজধানীর তেজগাঁও, কারওয়ান বাজার, কাঁঠালবাগান ও শুক্রাবাদ এলাকার মুদি দোকানিদের কাছে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সর্বশেষ চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আবার বাড়ানো হয়েছে পাস্তুরিত দুধের দাম। দোকানিরা জানান, মিল্ক ভিটার এক লিটার দুধ চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে বিক্রি হয়েছে ৮০ টাকা। দ্বিতীয় সপ্তাহে ১০ টাকা বাড়িয়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকা লিটার। আড়ং গত আগস্টে ১০ টাকা বাড়িয়ে প্রতি লিটার দুধ বিক্রি করছিল ৯০ টাকা। চলতি মাসে আবার পাঁচ টাকা বাড়িয়ে বর্তমানে প্রতি লিটার বিক্রি করা হচ্ছে ৯৫ টাকা। একইভাবে ফার্মফ্রেশের আধালিটার ৫২ টাকা এবং এক লিটার দুধ ৯৫ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। প্রাণ দুধ আধালিটার ৫০ টাকা, এক লিটার ৯০ টাকা, বাকারা আধালিটার ৬০ টাকা এবং এক লিটার ১১০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে।
তেজগাঁওয়ের বেগুনবাড়ী এলাকার মুদি দোকান হাজী স্টোরের মালিক মনির হোসেন বলেন, ‘কয়েক দিন আগে মিল্ক ভিটা কম্পানি দুধের দাম বাড়িয়েছে। প্রাণ কম্পানির আধালিটার দুধ আগে ছিল ৪৫ টাকা, এখন সেটা ৫০ টাকা করেছে। দাম বাড়ানো নিয়ে ক্রেতারা আমাদের সঙ্গে তর্ক করে। কিন্তু আমরা কী করব? কম্পানিগুলো দাম বাড়ালে আমরা তো লোকসান দিয়ে বিক্রি করতে পারি না। দাম বাড়ানোয় তুলনামূলকভাবে আগের চেয়ে বিক্রি অনেক কমেছে। আগে প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ লিটার দুধ বিক্রি করতাম। এখন সেটা কমে আট থেকে ১০ লিটারে নেমেছে। দাম বাড়ায় কম আয়ের লোকজন দুধ কিনতে পারছেন না। বাজারে সব পণ্যের দামই বেশি। ফলে অনেকে চাপ সামাল দিতে তালিকা থেকে দুধ কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। ’
বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সাদিক অ্যাগ্রোর স্বত্বাধিকারী ইমরান হোসেইন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বর্তমানে কম্পানিগুলো আমাদের ফার্ম থেকে লিটারপ্রতি ৪৪ থেকে ৪৮ টাকায় দুধ কিনে নিচ্ছে। তারা দাম বাড়ালেও গত ছয় মাস ধরে আমাদের এই একই দাম দিচ্ছে। ’
গোখাদ্যের দাম অনেক বাড়লেও কম্পানিগুলোর ওপর তার চাপ পড়েনি। পড়েছে খামারিদের ওপর। গত তিন-চার বছরে কম্পানিগুলো খামারি পর্যায়ে লিটারপ্রতি দুধ কিনতে বাড়িয়েছে মাত্র চার টাকা। কিন্তু কম্পানিগুলো এই সময়ে ৬৫ টাকা লিটার থেকে বাড়িয়ে ৯৫ টাকা করেছে। অর্থাৎ তারা দাম বাড়িয়েছে অন্তত তিন ভাগের এক ভাগ। খামারিদের কাছ থেকে যখন লিটার ৪০ থেকে ৪৪ টাকায় দুধ কিনত, তখন বিক্রি করত ৭০ টাকা লিটার। আর বর্তমানে প্রতি লিটার ৪৪ থেকে ৪৮ টাকায় কিনে বিক্রি করছে ৯০ থেকে ৯৫ টাকা।
খামারিরা বলছেন, এ বিষয়ে সরকারকে বারবার চিঠি দিয়ে অনুরোধ করা হয়েছে দেশজুড়ে দুধের দাম নির্ধারণ করে দিতে। তাহলে খামারিরা কিছুটা রক্ষা পেতেন। কিন্তু সরকার সামনে এনেছে মুক্তবাজার অর্থনীতির কথা। তাহলে সরকার কেন তেল, পেঁয়াজ, চিনির দাম বেঁধে দিচ্ছে—প্রশ্ন করলে কোনো জবাব মেলেনি। খামার খাতে প্রায় এক কোটি লোক জড়িত। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, বেলকুচিতে এক-তৃতীয়াংশ খামারি এই পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে ২০ লাখ মেট্রিক টন দুধ উৎপাদন বেড়েছে বলা হলেও এ তথ্য সঠিক নয়।
বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়ন লিমিটেডের (মিল্ক ভিটা) ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের সমবায়ের যে সদস্যরা আছেন, তাঁদের কাছ থেকে দুধ কিনতে বেশি দাম দিতে হয়। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে সব ধরনের গোখাদ্যের দাম বেড়ে গেছে। তার পরও অন্য কম্পানিগুলোর দাম বাড়ানোর ছয় মাস পর আমরা বাড়িয়েছি। ’
তিনি বলেন, ‘আমাদের খামারিদের আমরা শুধু দুধের দাম দিচ্ছি না, পাশাপাশি নানা ধরনের সেবাও দিচ্ছি। যেমন—বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, লিকুইড নাইট্রোজেন ইত্যাদি সরবরাহ করছি। এ ছাড়া বিনা মূল্যে ঘাসের বীজ, কৃমিনাশক ট্যাবলেট, ভ্যাকসিনও দেওয়া হয়।
বাকারা ব্র্যান্ডের দুধের বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান ইয়ন ফুডস লিমিটেডের হেড অব অপারেশন সুলতান মাহমুদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা আমাদের নিজস্ব ডেইরি ফার্ম থেকে প্রিমিয়াম কোয়ালিটির নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত দুধ বাজারজাত করি। এ কারণে আমাদের দুধের দাম ১১০ টাকা লিটার। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে ভোক্তাদের কথা বিবেচনায় রেখে নতুন করে আমরা আর দাম বাড়াচ্ছি না। ’