কাক্সিক্ষত মাত্রায় বৈদেশিক অর্থ প্রাপ্তিতে অনিশ্চয়তা আর একই সাথে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায়ের শ্লথ গতিকে মাথায় রেখে আগামী অর্থবছরের জন্য বাজেটের স্ফীতির রাশ টেনে ধরছে সরকার। এ কারণে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের আকার চলতি অর্থবছরে বাজেটের চেয়ে ১০ দশমিক ৬৩ ভাগ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরে বাজেটের আকার বৃদ্ধি পেয়েছিল পূর্ববর্তী বাজেটের তুলনায় সাড়ে ১২ ভাগের বেশি। আগামী অর্থবছরে বাজেটের আকার বৃদ্ধি টাকার চলতি মূল্যেই দুই ভাগের মতো কমিয়ে দেয়া হচ্ছে। ডলারের হিসাবে বাজেটের বরাদ্দ এবার গত বছরের তুলনায় আরো কমছে। আগামী অর্থবছরে বাজেট হচ্ছে পুরোপুরি গতানুগতিক। সেখানে ভোটারদের তুষ্ট করার বেশ কয়েকটি কর্মসূচি রাখা হবে। বড় রকমের কোনো কাঠামোগত পরিবর্তনের প্রস্তাব থাকছে না এতে। অন্য দিকে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের আকার মূল বাজেট থেকে ৩ শতাংশের বেশি কমানো হচ্ছে।
প্রাথমিকভাবে আগামী জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের আকার প্রাক্কলন করা হয়েছে সাত লাখ ৫০ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা। যা কিনা চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে মূল বাজেটে চেয়ে ১০ দশমিক ৬৩ ভাগ বেশি। আবার সংশোধিত বাজেটের প্রস্তাবিত আকার থেকে বাড়বে ১৪ ভাগ। এই বাজেটে ঘাটতিই ধরা হয়েছে দুই লাখ ৬৪ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা। মূল বাজেটে ঘাটতি ধরা হয় দুই লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা।
আগামী অর্থবছরের জন্য বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ধরা হয়েছে দুই লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে যা রয়েছে দুই লাখ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। নতুন অর্থবছরের জন্য জিডিপির প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে সাড়ে ৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির একই হার নির্ধারিত রয়েছে। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমিয়ে সাড়ে ৬ ভাগে নামিয়ে আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। আর মূল্যস্ফীতি হার প্রক্ষেপণ করা হয়েছে ৬ শতাংশ।
উল্লেখ্য, চলতি অর্থবছরে বাজেটের আকার ধরা রয়েছে ছয় লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে এর আকার কমিয়ে প্রাক্কলন করা হয়েছে ছয় লাখ ৫৭ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। এতে বরাদ্দ কমছে ৩ শতাংশের মতো।
গতকাল দুপুরে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ‘আর্থিক, মুদ্রা ও মুদ্রাবিনিময় হার সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের’ সভায় এ সিদ্ধান্তগুলো নেয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট এক সূত্র জানিয়েছেন। ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত এই সভাটি চলতি অর্থবছরের প্রথম সভা।
এই সভায় আগামী অর্থবছরের জন্য রাজস্ব আদায়ের টার্গেট ধরা হয়েছে চার লাখ ৮৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) আদায় করতে হবে চার লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা। উল্লেখ্য, চলতি অর্থবছরে রাজস্ব প্রাপ্তির লক্ষ্য রয়েছে চার লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআরকে রাজস্ব আয়ের টার্গেট দেয়া রয়েছে তিন লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা।
জানা গেছে, সভার আলোচ্যসূচির মধ্যে ছিল, বাংলাদেশে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের অগ্রগতি এবং বিশ্ব ও জাতীয় অর্থনীতিতে ইতোমধ্যে সূচিত পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে ২০২২-২৩ অর্থবছরের সামষ্টিক অর্থনৈতিক কাঠামো (এমটিএমএফ) পর্যালোচনা। আর দ্বিতীয় বিষয় ছিল চলতি অর্থবছরসহ মধ্যমেয়াদি (২০২৩-২৪ হতে ২০২৫-২৬) সামষ্টিক অর্থনৈতিক কাঠামোর (এমটিএমএফ) সূচকগুলোর প্রক্ষেপণের ওপর আলোচনা ও অনুমোদন।
জানা গেছে, কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন আগামী অর্থবছরে বাজেট ও দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির একটি সার্বিক চিত্র তুলে ধরেন। এর সাথে দেশের মুদ্রাবাজারসহ আরো কিছু বিষয়ের ওপর বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। দেশে রফতানি বাণিজ্যের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়ব সচিব তপন কান্তি ঘোষ। সভাটি দুই ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলে।
এ বিষয়ে অর্থ বিভাগের এক কর্মকর্তা গতকাল বলেছেন, আগামী অর্থবছরে বাজেটের আকার পৌনে আট লাখ কোটি টাকায় নিয়ে যাওয়া আমাদের ইচ্ছে ছিল; কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে এটি নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। কারণ আগামী বছরে বিদেশী সহায়তা কমে যেতে পারে। একই সাথে দেশের ভেতর থেকেও রাজস্ব আদায়ের গতি শ্লথ হতে পারে। এসব বিষয় মাথায় রেখেই নতুন অর্থবছরের বাজেটের আকার সাড়ে সাত লাখ কোটি টাকায় মধ্যে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে আগামী এপ্রিল মাসে যখন কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিসেল দ্বিতীয় সভায় অনুষ্ঠিত হবে সেখানে বাজেটের মূল আকারটি নির্ধারিত হবে।
উল্লেখ্য, গত কয়েক বছর ধরে চলমান প্রবণতা অনুসারে মূল বাজেটের বরাদ্দ সংশোধিত বাজেটে এক দফা কমানো হয়। এরপর বাস্তব ব্যয় হয় তার চেয়েও অনেক কম। ২০২১ অর্থবছরে পাঁচ লাখ ৬৭ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকার মূল বাজেট সংশোধন করে পাঁচ লাখ ৩৮ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকায় নামানো হয়। এর বিপরীতে বাস্তবে এই অর্থবছরে বাজেটের ব্যয় হয় চার লাখ ৬০ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। আর ২০২২ অর্থবছরে ছয় লাখ তিন হাজার ৬৮০ কোটি টাকার মূল বাজেট সংশোধন করে পাঁচ লাখ ৯৩ হাজার ৪৯৯ কোটি টাকায় নামানো হয়। বাস্তবে ব্যয় হয় পাঁচ লাখ ১০ হাজার ৩৪৯ কোটি টাকা। বাজেটের রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে।