সামছুল আরেফীন: অনেকটা হঠাৎ করেই ঘোষণা আসলো প্রাথমিকে বৃত্তি পরীক্ষার। তবে এই পরীক্ষায় সবাই অংশ নিতে পারবে না। মাত্র তিন সপ্তাহ আগে পরীক্ষা নেওয়ার ঘোষণায় ক্ষুব্ধ অভিভাবক-শিক্ষকরা। বৃত্তি পরীক্ষা নিতে হলে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের এক ধরনের দীর্ঘ প্রস্তুতির বিষয় থাকে। সেটি এই স্বল্প সময়ের মধ্যে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আকস্মিকভাবে পরীক্ষা নেওয়ার ঘোষণায় আনন্দ মাটি হয়ে গেছে শিক্ষার্থীদের। নানা-দাদা বাড়ি বেড়ানোর পরিবর্তে এখন তারা ঘরবন্দী। নিচ্ছে পরীক্ষার প্রস্তুতি। আগামী ৩০ ডিসেম্বর শুক্রবার এই পরীক্ষা নেওয়ার ঘোষণা করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। চার বিষয়ে ২৫ নম্বর করে একশ নম্বরে নেওয়া হবে এ পরীক্ষা। এ লক্ষে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই) ব্যাপক ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। পাশাপাশি মাঠপর্যায়ের জেলা ও উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে চলছে কর্মযজ্ঞ। এদিকে দেশের ৩০ বিশিষ্ট নাগরিক এক বিবৃতিতে এই বৃত্তি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন।
একসময় বাছাই করা শিক্ষার্থীদের নিয়ে হতো প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা। সেটি বাদ দিয়ে ২০০৯ সালে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য শুরু হয় প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষা। এতে সব শিক্ষার্থীই বৃত্তি পাওয়ার প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারত। যদিও পিইসি পরীক্ষা নিয়ে ছিল সমালোচনা। করোনার সংক্রমণ পরিস্থিতি এবং নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখা বিবেচনায় নিয়ে ২ বছর ধরে পিইসি পরীক্ষা হচ্ছে না। আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে চালু হচ্ছে নতুন শিক্ষাক্রম। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য শ্রেণিতেও তা বাস্তবায়ন করা হবে। যেখানে প্রথাগত পরীক্ষাকে কম গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই ধারাবাহিক মূল্যায়নের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বছরের একেবারে শেষ বেলায় এসে আকস্মিকভাবেই এ বছর সেই পুরোনো ব্যবস্থার মতো প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। সর্বশেষ বৃত্তি পরীক্ষা নেওয়া হয় ২০০৮ সালে। এরপর ২০০৯ সালে পিইসি পরীক্ষা চালু করা হয়। এই পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দেওয়া হতো।
এবারের বৃত্তি পরীক্ষা সংক্রান্ত সরকারি আদেশে বলা হয়, প্রাথমিক বৃত্তি দেওয়ার লক্ষ্যে পিইসির বিকল্প হিসাবে মেধা যাচাই পদ্ধতি নির্ণয়ের জন্য গত ২৮ নভেম্বর আন্তঃমন্ত্রণালয় বিষয়ক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রচলিত মেধাবৃত্তি দেওয়ার কার্যক্রম অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত হয়।
মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এত দিন প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার ভিত্তিতে প্রাথমিক বৃত্তি দেওয়া হতো। যেহেতু সমাপনী পরীক্ষা বাদ দেওয়া হয়েছে, তাই বিকল্প হিসেবে পুরোনো পদ্ধতির মতো করে বৃত্তি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ গণমাধ্যমকে বলেন, এই বৃত্তি পরীক্ষার ব্যাপক চাহিদা আছে। আমরা প্রথমে ১০ শতাংশ শিক্ষার্থীর পরীক্ষা নিতে চেয়েছিলাম। পরে মাঠপর্যায় থেকে অভিভাবকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তা ২০ শতাংশ করতে হয়েছে। তিনি বলেন, আসলে এই পরীক্ষার বাস্তবতা ঢাকায় বসে বোঝা যায় না। সারা দেশের দৃশ্যপট ভিন্ন। তাছাড়া শিক্ষার্থীদের সামষ্টিক এবং ফরমেটিভ (গঠনমূলক) উভয় ধরনের মূল্যায়ন প্রয়োজন আছে। এসব কারণ সামনে রেখেই বৃত্তি পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
আকস্মিকভাবে নেওয়া এই সিদ্ধান্তে ছাত্রছাত্রী ও তাদের অভিভাবকরা মনস্তাত্ত্বিক চাপে পড়েছে বলে মনে করেন শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এর যুক্তি তুলে ধরতে গিয়ে তারা বলেন, বাংলা, ইংরেজি, গণিত এবং বিজ্ঞান-এই চার বিষয়ে ২৫ নম্বর করে ১০০ নম্বরে পরীক্ষা হলেও গোটা বিষয়ে শিক্ষার্থীদেরকে গোটা বই-ই পড়তে হবে, যা তাদের ওপর বড় চাপ হবে। সারা দেশে প্রায় ২৭ লাখ শিক্ষার্থী পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। তাদের ২০ শতাংশ ধরা হলে সারা দেশে সাড়ে ৫ লাখ এই পরীক্ষায় বসবে।
শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আকস্মিক এ সিদ্ধান্তে বৈষম্য সৃষ্টি হবে। কারণ, প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার মাধ্যমে সব শিক্ষার্থী অন্তত সুযোগটি পেত। এখন ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী এ সুযোগ পাবে। এতে বিদ্যালয়গুলোর নজর থাকবে অনেকটা এই ২০ শতাংশ শিক্ষার্থীর ওপর। ফলে অন্যরা আরও পিছিয়ে পড়বে। এ ছাড়া আগে থেকে ঘোষণা না দেওয়ায় প্রস্তুতির অভাবে অনেকে সুযোগবঞ্চিত হবে এবং শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ পড়বে। সাধারণত পরীক্ষাসংক্রান্ত বড় কোনো সিদ্ধান্ত হলে আগেভাগেই জানানো হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা করা হয়নি।
জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পরিমার্জন কোর কমিটির সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক এম তারিক আহসান বলেন, বছরের শেষে এসে হঠাৎ প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার সিদ্ধান্তটি নেওয়া একদিকে শিক্ষার্থীদের জন্য যেমন ক্ষতিকর বিষয় হবে, তেমনি ভবিষ্যৎ শিক্ষাসংস্কারের জন্যও নেতিবাচক নির্দেশনা দিচ্ছে। তাই এটি নিয়ে আরেকটু ভাবার অবকাশ রয়েছে। তিনি বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখা অনুযায়ী শিক্ষায় পরিবর্তনের যে ধারা তৈরি হচ্ছে, সেখানে হঠাৎ করে সামষ্টিক পরীক্ষা নেওয়ার প্রচেষ্টা কখনোই ইতিবাচক চর্চা হতে পারে না, বরং ক্ষতির কারণ হতে পারে। কাজেই ভবিষ্যতের পরিবর্তনের সঙ্গে ধারাবাহিকতা রক্ষা করে, এমন চর্চাকে উৎসাহিত করতে হবে। তার মতে, হুট করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের প্রচেষ্টায় শিক্ষার্থীদের ওপর নানামুখী মানসিক ও শারীরিক চাপ পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে করে শিক্ষার্থীদের ওপর নানা রকমের নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই আমি মনে করি, শিক্ষার্থীর বিদ্যালয়ভিত্তিক যেসব তথ্য রয়েছে, তার ফলাফলের রেকর্ডের ভিত্তিতে এই বিষয়টিকে পুনর্বিবেচনা করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, বৃত্তি পরীক্ষা নেওয়ার এই সিদ্ধান্ত অনেকটা তাড়াহুড়ো করে নেওয়া হয়েছে। কেননা এত অল্প সময় দিয়ে বৃত্তি পরীক্ষার মতো মেধা যাচাই ও পুরস্কৃত করার মতো এমন গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার তারিখ এভাবে ঘোষণা করা সমীচীন হয়নি। তবে এই ঘোষণার মাধ্যমে প্রকারান্তরে পিইসি পরীক্ষাযুগের সমাপ্তিকে তিনি সাধুবাদ জানিয়েছেন।
উল্লেখ্য, গত ৫ ও ৬ জুন যথাক্রমে জেএসসি-জেডিসি এবং পিইসি ও ইইসি (ইবতেদায়ী সমাপনী পরীক্ষা) এ বছর না নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। ২০০৯ সালে প্রথম জাতীয়ভাবে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য পিইসি পরীক্ষা শুরু করে সরকার। পরে ইইসি পরীক্ষাও শুরু করা হয়। এরপর অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য ২০১০ সালে শুরু হয় জেএসসি পরীক্ষা। পরে মাদ্রাসার অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য চালু করা হয় জেডিসি পরীক্ষা। কিন্তু এসব পরীক্ষা নিয়ে নানামুখী বিতর্ক ছিল। এতে নোট-গাইড আর কোচিং ব্যবসা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছিল। পাশাপাশি পরীক্ষার কারণে শিক্ষার্থীদের ওপর বাড়তি চাপ পড়ায় অনেক অভিভাবক ও শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা অসন্তুষ্ট হন। বিশেষ করে ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতে পরীক্ষাগুলোর কথা উল্লেখ না থাকায় সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে এ নিয়ে আপত্তি ছিল। সবমিলে পরীক্ষা বাতিলের দাবি করে আসছিলেন সবপক্ষ।
উল্লেখ্য, এই পরীক্ষা সামনে রেখে ইতিমধ্যে ১২ পৃষ্ঠার ৩২ দফা নীতিমালা করা হয়েছে। তাতে পরীক্ষার্থী নিবন্ধনের নীতিসহ ফল প্রকাশ পর্যন্ত বিভিন্ন নির্দেশনা উল্লেখ আছে।
৩০ নাগরিকের বিবৃতি : সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় বিষয়ক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী প্রেরিত নাগরিকদের দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, একসময় প্রচলিত ব্যবস্থায় মেধাবৃত্তি প্রদানের উপায় হিসাবে বাছাই করা শিক্ষার্থীদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হতো ‘প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা’। ২০০৯ সালে সেটি বাদ দিয়ে শুরু হয় পিইসি পরীক্ষা। কিন্তু আমরা জানি যে, করোনা-পরবর্তী পরিস্থিতি ও নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখা বিবেচনায় নিয়ে তিন বছর ধরে পিইসি পরীক্ষা হচ্ছে না। আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে চালু হচ্ছে নতুন শিক্ষাক্রম আসছে। যে শিক্ষাক্রমে প্রাথমিক পর্যায়ে পাবলিক পরীক্ষাকে কম গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই ধারাবাহিক মূল্যায়নের ওপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, তা পর্যায়ক্রমে অন্যান্য শ্রেণিতেও বাস্তবায়ন করার পরিকল্পনা রয়েছে। এ অবস্থায় বছরের একেবারে শেষ সময়ে আকস্মিকভাবেই পুরোনো ব্যবস্থার মতো পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা ও নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন।
বিবৃতিতে বলা হয়, নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখা অনুযায়ী শিক্ষায় পরিবর্তনের যে ইতিবাচক ধারা তৈরি হচ্ছে, সেখানে এভাবে হুট করে বৃত্তি পরীক্ষা চালু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হলে শিক্ষার্থীদের ওপর নানামুখী মানসিক ও শারীরিক চাপ পড়বে বলে আমাদের বিশ্বাস। এছাড়াও নতুন শিক্ষাক্রমে যেখানে সব শিক্ষার্থীর মেধার সম্পূর্ণ বিকাশের নানা দিককে উৎসাহিত করা হচ্ছে, সেখানে মাত্র ২০ শতাংশ শিক্ষার্থীকে বাছাই করে একটি বৃত্তি কার্যক্রম শুরু করলে সুবিধাভোগী ও সুবিধা বঞ্চিতদের মধ্যে বৈষম্য আরও বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এটি আমাদের সংবিধানের মূলনীতির পরিপন্থি। শুধু ২০ ভাগ শিক্ষার্থীর জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে একটি বৃত্তি পরীক্ষা চালুর ঘোষণা আমাদের হতাশ করেছে। শিক্ষা নিয়ে প্রায়শ এত পরীক্ষা-নিরীক্ষা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের বিভ্রান্ত করে থাকে, যা মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়।
তারা বলেন, আমরা আশা করছি, নীতিনির্ধারকরা আকস্মিকভাবে ঘোষিত এবং জাতীয়ভাবে পরিচালিত ‘প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা’র মতো পাবলিক পরীক্ষার পরিবর্তে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর দিকনির্দেশনার আলোকে সব শিক্ষার্থীর জন্য উপজেলাভিত্তিক বাছাইয়ের মাধ্যমে মেধা বৃত্তি প্রদানের বিষয়টিকে বিবেচনা করবেন। এর মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থাপনা বিকেন্দ্রীকরণের পথে এগিয়ে যাবে বলে আমরা মনে করি।