মুহাম্মাদ আখতারুজ্জামান: ধীরে ধীরে প্রকাশ্যে চলে আসছে দেশের সব লুকোনো টানাপোড়েন। আর্থিক এবং সামাজিক সকল ক্ষেত্রেই শুধু ঘাটতি আর ঘাটতির প্রমাণপত্র বেরিয়ে আসছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ফলে জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। দুর্বল হয়ে যাচ্ছে মধ্যবিত্ত। আইনের শাসনের ব্যাপক ঘাটতি দেখা দিয়েছে। জীবন মানের যে উন্নয়ন হয়েছিল, সেটিও ক্রমান্বয়ে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। যুব সমাজের কর্মসংস্থানের ঘাটতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সব জায়গায় একটি ভয় বা ভীতির সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। সরকারি ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হচ্ছে। এতে প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা ও সেবা কমেছে। ফলে দেশের উন্নয়ন এখন চোরাবালিতে আটকে গেছে। এ অবস্থা থেকে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
সম্প্রতি এসডিজি বাস্তবায়নে গঠিত নাগরিক প্ল্যাটফর্ম জানিয়েছে, দেশে আয় কমে যাওয়ার পাশাপাশি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় মধ্যবিত্ত শ্রেণি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। ফলে গত কয়েক বছরে মানুষের জীবনমানের যে উন্নতি হয়েছিল, তার ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। দেশে এখন একধরনের ভয় বা ভীতির সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। কথা বলতে নাপারা অথবা কথা বলার ক্ষেত্রে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হচ্ছে। ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় সরকার এবং রাজনীতিসহ সব ক্ষেত্রে এ কথা সত্য। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যেও এ সংস্কৃতি সংক্রমিত হচ্ছে। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহি কমে যাচ্ছে, যা অত্যন্ত আশঙ্কার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশে ব্যাপক উন্নয়নের কথা বলা হলেও এ উন্নয়ন চোরাবালিতে আটকে গেছে। নাগরিক প্ল্যাটফর্মের মতে তারা তৃণমূলের মানুষের কাছ থেকে ছয়টি বার্তা পেয়েছে। প্রথমত, দেশে যুবসমাজের শোভন কর্মসংস্থানের ঘাটতি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। তাতে সীমিত আয়ের মধ্যবিত্তদের জন্য সমস্যাটি প্রকট আকার ধারণ করেছে। দ্বিতীয়ত, দেশে বিভিন্নকাজে নারীর সম্পৃক্ততা বাড়লেও তাদের প্রতি সহিংসতা ও তাদের অধিকার হরণ অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে আইনের শাসনের ব্যাপক ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। তৃতীয়ত, পরিবেশ বিপর্যয় একটি জাতীয় সমস্যায় রূপ নিয়েছে। সব জায়গায় কোনো না কোনো ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা যাচ্ছে। চতুর্থত, সরকারি সেবার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মান কমেছে। এসব সেবার মধ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও সুরক্ষা কর্মসূচি অন্যতম। পঞ্চমত, বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক যে মূল্যবোধ ছিল, সেখানে বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। একই সঙ্গে দুর্বল জনগোষ্ঠী নানাভাবে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। আর তৃণমূলের মানুষের ষষ্ঠ বার্তাটি হচ্ছে, সব জায়গায় একটি ভয় বা ভীতির সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। ভয়ের সংস্কৃতির কারণে উন্নয়নের সুফল সবার কাছে নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। বিভিন্ন পর্যায়ে জবাবদিহির ঘাটতি তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি সরকারি ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান দুর্বল হয়েছে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. রেহমান সোবহান বলেন, বর্তমানে রাজনৈতিক ক্ষমতাকে গ্রাস করছে অর্থনৈতিক ক্ষমতা। ফলে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শুরু করে সব জায়গায় ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা জনপ্রতিনিধিতে পরিণত হচ্ছেন। আমাদের দেশে চরম বৈষম্য বিরাজ করছে। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে সব কিছুই বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। বাজার ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। এছাড়া ব্যবসার পরিবেশ উন্নত করা জরুরি। স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং জনগণের প্রতি দায়বন্ধ থাকতে হবে। ড. রেহমান সোবহান বলেন, বর্তমান সিস্টেমের কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে হবে। তাহলেই বৈষম্য কমবে। দারিদ্র্য নিরসন এবং করকাঠামো সংস্কার দরকার। কল্যাণমূলক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, কিছু বড় বড় শিল্প গ্রুপের মুনাফা অর্জনকারী শিল্প প্রতিষ্ঠান থাকলেও তারা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধে খেলাপি হয়ে যায়। এর একটা কারণ হলো অবৈধভাবে বিদেশে মুনাফা পাচার। তিনি বলেন, কর নীতির কিছু বড় পরিবর্তনও বিবেচনা করা যায়। আমাদের দেশে সম্পত্তির উত্তরাধিকারে কর নেই, অথচ শিল্পোন্নত দেশগুলোতে উচ্চ হারে এ ধরনের কর আরোপ করা হয়। অর্থনৈতিক সাম্যের প্রশ্নে আমাদের মতো অর্থনীতি একটি বড় চালিকাশক্তি। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের স্বার্থরক্ষার বিষয়টি উল্লেখ করা দরকার। তিনি বলেন, মোট কথা, এ যাবৎকালের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষণীয় বিষয় হলো, বাজার অর্থনীতি ও ব্যক্তি উদ্যোগের অন্তর্নিহিত শক্তি অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু সেই সঙ্গে কিছু মানুষের হাতে এত সম্পদ কেন্দ্রীভূত হতে দেওয়া যাবে না, যাতে সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং জনকল্যাণমুখী নীতি প্রবর্তনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, লুকোনো কিছু টানাপোড়েন এখন প্রকাশ্যে চলে এসেছে। এর মধ্যে ব্যাপক সংখ্যক শিক্ষিত যুবক বেকার হয়ে পড়েছে। এরা সমাজের মূল ধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারছে না। ভবিষ্যতও ভালো দেখছে না। এরা দেশের বাইরে চলে যেতে চাচ্ছে। এর ফলে সামাজিক অসন্তোষ সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, মধ্যবিত্ত শ্রেণি ক্রমাগত দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। যার ফলে নৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হচ্ছে। একসময় মধ্যবিত্তরা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর প্রতি সহমর্মী ছিলেন। কিন্তু বর্তমানে তারা নিজেরাও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এসব মধ্যবিত্তের নৈতিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক দিক থেকে মূল্যবোধ সৃষ্টি করার যে জায়গায় ছিল, সেটি এখন আর নেই। এটি বড় ধরনের সামাজিক ঘাটতি।
ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমাদের দেশে উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু বৈষম্য বেড়েছে। এক্ষেত্রে তিনটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো হলো-নৈতিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক। নৈতিক বিষয় হলো অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন। সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।