চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার শহিদুল-জোছনার ভালোবাসামাখা জীবন। পাঁচ সদস্যের পরিবারে নিত্য টানাটানির চোট থাকলেও আনন্দ কখনও দেয়নি উড়াল। শহিদুল ইসলাম ওষুধের দোকানের কর্মচারী। বছরখানেক আগে জোছনা খাতুনের ঘরে নামে ‘আঁধার’। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে চিকিৎসক জানিয়ে দেন, তাঁর দুই কিডনিই অকেজো। লাগবে সপ্তাহে দু’বার ডায়ালাইসিস। প্রতি মাসে ডায়ালাইসিসে খরচ পড়ে প্রায় ২০ হাজার টাকা। ধারকর্জ করে টানা এক বছর নিয়মিত ডায়ালাইসিস চালিয়েও যান। চিকিৎসার পেছনে টাকা ঢালতে গিয়ে জায়গা-জমি যা ছিল, সব বেচে শহিদুল ফতুর। স্বল্প আয়ে নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যের বাজারে সংসার চালাতে একসময় খেই হারান তিনি। টাকার অভাবে বন্ধ হয়ে যায় জোছনার চিকিৎসা। দুই মাস ডায়ালাইসিস বন্ধ থাকায় স্বজনদের কাঁদিয়ে গত সপ্তাহে চল্লিশ বছর বয়সে জোছনার ঠিকানা হয় ‘দূরাকাশে’; যেখান থেকে আর কেউ ফেরে না।
জোছনার মৃত্যু হলেও কিডনি রোগ নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে নিঃস্ব আইয়ুব হোসেন। তাঁর কিডনি রোগের শুরু তাও চার বছর। তাঁকেও নিতে হয় সপ্তাহে দু’বার ডায়ালাইসিস। অর্থ সংকটে পড়ে এ বছরের শুরু থেকে সপ্তাহে একবার ডায়ালাইসিস নিতে বাধ্য হচ্ছেন তিনি। সাম্প্রতিক সময়ে জিনিসপত্রের দাম বাড়ার প্রেক্ষাপটে মাসে একবার ডায়ালাইসিস করান আইয়ুব। তিনি বলেন, ‘মাসে আটবার ডায়ালাইসিস করতে বলেছেন চিকিৎসক। বেসরকারি হাসপাতালে আগুন খরচ। তাই সরকারি প্রতিষ্ঠানে ডায়ালাইসিস করি। নিয়মিত ডায়ালাইসিস করতে না পারলে মৃত্যুর ঝুঁকি জেনেও আমি অসহায়।’
জোছনা কিংবা আইয়ুবের মতো অনেক কিডনি রোগীর করুণ গল্প এখন হাসপাতালে হাসপাতালে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গেল ছয় মাসে টাকার অভাবে অন্তত ২০ শতাংশ রোগী ডায়ালাইসিস বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন। এতে বেড়ে গেছে এ রোগে মৃত্যুঝুঁকি। নিত্যপণ্যের দাম কয়েক দফা বাড়ার মধ্যে গত পাঁচ মাসে ডায়ালাইসিসে ব্যবহূত ইনজেকশন হেপারিনের দাম বেড়েছে ৩০ শতাংশ।
ফলে এরই মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান ডায়ালাইসিস সেবার দাম বাড়িয়েছে।
কিডনি ফাউন্ডেশনের এক পরিসংখ্যান বলছে, কোনো না কোনোভাবে কিডনি রোগে ভুগছেন দেশের প্রায় দুই কোটি মানুষ। আর আক্রান্তদের মধ্যে প্রতিবছর ৪০ হাজারের মতো রোগীর কিডনি পুরোপুরি বিকল হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিডনি রোগীর চিকিৎসা হয় দু’ভাবে- এক. ডায়ালাইসিস, অর্থাৎ যন্ত্রের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে কিডনির কাজ করানো; দুই. কিডনি প্রতিস্থাপন। দুই ধরনের চিকিৎসাই অনেক ব্যয়বহুল। ব্যয়বহুল হওয়ায় রোগী বা স্বজনের বিদ্যমান আয়েও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে কিডনি রোগ। বছরে ৪০ হাজার মানুষের কিডনি অকেজো হলেও মাত্র ১০ হাজার মানুষ ডায়ালাইসিস চিকিৎসার সুযোগ পাচ্ছেন। বাকি রোগীরা ডায়ালাইসিসের সুযোগ পাচ্ছেন না। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ রোগী শুরুর ছয় মাসের মধ্যে এ সেবা নেওয়া বন্ধ করে দেন। কিডনি রোগের চিকিৎসা খরচ এবং সুযোগ-সুবিধা কোনোটাই পর্যাপ্ত নয়। ঢাকায় সরকারি হাসপাতাল ছাড়াও ব্যক্তিমালিকানায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কয়েকটি ডায়ালাইসিস সেন্টার গড়ে উঠেছে। ঢাকার বাইরে বড় কয়েকটি শহরে সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে সীমিত পর্যায়ে এই চিকিৎসা ব্যবস্থা আছে। তবে বেশিরভাগ জেলায় কিডনি রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থা সেভাবে নেই। সব মিলিয়ে ১৪০ সেন্টারে ডায়ালাইসিস সেবা দেওয়া হচ্ছে, যার বেশিরভাগই রাজধানী ঢাকায়।
১০ বছর ধরে কিডনি রোগী নিয়ে গবেষণা করছেন কিডনি ফাউন্ডেশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক হারুন আর রশিদ। তিনি সমকালকে বলেন, দেশে ডায়ালাইসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপনের সুবিধা এখনও সেভাবে গড়ে ওঠেনি। অর্থ সংকটে ৭০ শতাংশ রোগী ডায়ালাইসিসের সুযোগ পাচ্ছেন না। সাম্প্রতিক সময়ে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে রোগীর বড় একটি অংশ ডায়ালাইসিস নেওয়া ছেড়ে দিয়েছে। এ রোগে নিম্ন আয়ের মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিডনি রোগীর সুচিকিৎসায় ডায়ালাইসিস বিনামূল্যে দেওয়ার পক্ষে মত দেন এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।
কিডনি রোগীদের ডায়ালাইসিস হয় এমন কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সরকারি হাসপাতালে প্রতিবার ডায়ালাইসিসে দেড় হাজার টাকা খরচ হলেও বেসরকারি পর্যায়ে নেওয়া হচ্ছে ৪ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা। পরিবহন ও অন্য খরচ যুক্ত হয়ে সেটা দাঁড়ায় ১২ হাজারের ওপরে। এভারকেয়ার কিংবা ইউনাইটেড হাসপাতালে এই খরচ ৪০ হাজার টাকার ওপরে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে কম খরচে ডায়ালাইসিস করা হলেও একজন কিডনি রোগীর মাসে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গরিব রোগীরা ডায়ালাইসিসের আওতায় আসেন না। এর মূল কারণ, খরচ ও ডায়ালাইসিস সুবিধার অপ্রতুলতা।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী বলেন, আর্থিক কষ্টে ৭০ শতাংশ রোগী ডায়ালাইসিস করতে পারেন না। অনেকেই টাকা জোগাড়ে ব্যর্থ হওয়ায় সপ্তাহে দুইবারের বদলে একবার ডায়ালাইসিস করান। কিডনি রোগীর ডায়ালাইসিসের সুব্যবস্থা নিশ্চিত করলে সুস্থ জীবনযাপন করা সম্ভব। আমি নিজেও সপ্তাহে তিনবার ডায়ালাইসিস নিচ্ছি। অকালমৃত্যু প্রতিরোধে সরকারের উচিত ডায়ালাইসিসের জন্য ভর্তুকি দেওয়া। অনেকবার সরকারকে এ সেবা বিনামূল্যে করার জন্য আবেদন করেছি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ডায়ালাইসিস সেবা বিনামূল্যে দেওয়া হয়। কারণ, ডায়ালাইসিস করতে করতে হঠাৎ বন্ধ করে দিলে ছয় মাসের মধ্যে রোগীর অকালে মৃত্যু হয়। দেশে বিদ্যমান মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন কিডনি রোগীবান্ধব নয় উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, এখানে নিকটাত্মীয়ের কাছ থেকে কিডনি নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তাতে তেমন কোনো সফলতা আসছে না। কারণ, সবার নিকটাত্মীয় কম এবং থাকলেও কিডনি নেওয়ার উপযুক্ত নয়। কেউ যদি নিজ ইচ্ছায় কাউকে কিডনি দান করতে চান, তাঁকে সুযোগ দেওয়া উচিত। এটা নাগরিক অধিকার। এ নিয়ে আমরা বহু আগে থেকেই আইনি লড়াইয়ে আছি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কিডনি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, ডায়ালাইসিস শুরুর পর এক বছরের মধ্যে অর্ধেক রোগী চিকিৎসা বন্ধ করে দেন। দ্রব্যমূল্য ও ওষুধের দাম বাড়ার প্রভাবে আরও ১০ শতাংশ মানুষ ডায়ালাইসিস বন্ধ করে দিচ্ছেন। বিষয়টি এখন বিশেষভাবে ভাবতে হবে। এ ছাড়া বেসরকারি পর্যায়ে ডায়ালাইসিসের দাম নির্ধারণ করে দেওয়া উচিত।