পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা সিলেটে ধর্মঘট ডেকে বসে গেল ১৩ সেপ্টেম্বর। যাত্রী ভোগান্তির কথা ভেবে সেই রাতেই ত্বরিত আলোচনা করে ধর্মঘট প্রত্যাহার করায় প্রশাসন। অতীতে অধিকাংশ পরিবহন ধর্মঘট থামাতে প্রশাসনকে এমন করিৎকর্মা ভূমিকায় দেখা যায়। তবে সরকারবিরোধীদের কর্মসূচির সময় গণপরিবহন বন্ধে জনদুর্ভোগ মাত্রা ছাড়ালেও তা নিরসনে তৎপরতা নেই।
বরং যখন যেখানে বিএনপির সমাবেশ, সেখানেই ধর্মঘট ডেকে গণপরিবহন বন্ধের বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল রোববারও বলেছেন, ‘এখানে আমার করার কী আছে!’ তাঁর ভাষ্য, পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা বিএনপিকে ভয় পায়। সে কারণে দলটির কর্মসূচির সময়ে বাস বন্ধ রাখে।
গত ১৫ অক্টোবর ময়মনসিংহে, ২২ অক্টোবর খুলনায় ও ২৯ অক্টোবর রংপুরে বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশের আগের দিন থেকেই অঘোষিত ও ঘোষিত ধর্মঘটে গণপরিবহন বন্ধ ছিল। যেসব দাবিতে ধর্মঘট হয়েছিল, সেগুলো পূরণ বা প্রশাসনের কাছ থেকে আশ্বাস না পেলেও সমাবেশ শেষ না হতেই যান চলাচল স্বাভাবিক হয়ে যায়।
একাধিক বাস মালিক সমকালকে বলেছেন, পাতানো খেলায় যেভাবে নির্ধারিত থাকে কখন কী হবে, এসব ধর্মঘটও তেমন। তবে পাতানো ধর্মঘট রাজনীতিতে নতুন নয়। বিএনপিও ক্ষমতায় থাকতে হরতালে গণপরিবহন সচল রাখতে খুব উদ্যোগী থাকলেও আওয়ামী লীগের কর্মসূচির সময় একই কায়দায় গণপরিবহন বন্ধ করাত। ফেরি, লঞ্চও চলতে দিত না।
ভাঙচুর ও আগুনের ভয়ে মালিকরা গাড়ি চালাচ্ছেন না- সরকারি দলের নেতারা এ বক্তব্য দিলেও বিএনপির গেল চার সমাবেশে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। সমাবেশ শেষে বিএনপি নেতাকর্মীরা বাসে ফিরছেন। ভাঙচুরের ঘটনার একটি উদাহরণও নেই।
৫ নভেম্বর বরিশালে বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশ। খুলনা ও রংপুরের মতো এই বিভাগের পরিবহন নেতারাও মহাসড়কে অটোরিকশা, ইজিবাইক, নছিমন, করিমনসহ অবৈধ যানবাহন বন্ধের দাবিতে ৪ ও ৫ নভেম্বর ধর্মঘটের ডাক দিয়েছেন। বরিশাল বাস মালিক গ্রুপের সভাপতি গোলাম মাশরেক বাবলু সমকালকে বলেছেন, ‘৩ নভেম্বরের মধ্যে দাবি পূরণ না হলে ৪ ও ৫ নভেম্বর বাস বন্ধ থাকবে। ২৪ অক্টোবর বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে দাবিনামা দিলেও এখন পর্যন্ত বৈঠকের ডাক আসেনি।’
বৈঠক হবে কিনা- প্রশ্নে তিনি বলেছেন, ‘এ তো সরকার বলতে পারবে।’ হাইকোর্টের রায় না মেনে এত দিন মহাসড়কে তিন চাকার গাড়ি চললেও কেন ঠিক বিএনপির সমাবেশের সময়েই ধর্মঘট- এ প্রশ্নে গোলাম মাশরেকের দাবি, কারও দেখাদেখি বা নির্দেশে নয়, নিজেদের সিদ্ধান্তেই কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। দাবি পূরণ না হলেও খুলনা, রংপুরের মতো বরিশালেও বিএনপি কর্মসূচি শেষ হতে না হতেই যান চলাচল শুরু হবে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘ধর্মঘট দুই দিনের। এরপর গাড়ি চলবে।’
তিন চাকার গাড়ি বন্ধে ধর্মঘট হলেও রংপুরে ও খুলনায় বিএনপির সমাবেশের দিন শুধু মহাসড়কে নয়; অলিগলিতে চলেনি অটোরিকশা, ইজিবাইক, নছিমন, করিমন। এই অদ্ভুত অঘোষিত মৈত্রীর পর ৪ ও ৫ নভেম্বর ধর্মঘট ডেকেছে বরিশাল জেলা মিশুক, বেবিট্যাক্সি, ট্যাক্সিকার ও অটোরিকশা চালক শ্রমিক ইউনিয়ন।
রোববার রাতে সংগঠনের সভাপতি কামাল হোসেন লিটন মোল্লা সমকালকে বলেন, ডিজেলের বর্ধিত দামের সঙ্গে সমন্বয় করে ভাড়ার তালিকা ও সহজ শর্তে ড্রাইভিং লাইসেন্সের দাবিতে সব ধরনের তিন চাকার যান চলাচল বন্ধ থাকবে। তিন চাকার শ্রমিকরা বাস মালিকদের নির্যাতনের শিকার। আগে থেকেই আন্দোলন চলছে। বিএনপির সমাবেশের সঙ্গে ধর্মঘটের সম্পর্ক নেই।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী সমকালকে বলেন, ‘সবাই বোঝে এগুলো পাতানো ধর্মঘট। বিরোধীদের কর্মসূচি ঠিকই হয়। তবে ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ যাত্রীরা। রোগী হাসপাতালে যেতে পারে না। পরীক্ষার্থী পরীক্ষা দিতে পারে না। সাধারণ মানুষের ভোগান্তি দূর করতে গণপরিবহন সচল রাখা সরকারের দায়িত্ব। সরকারই যদি বলে আমাদের কী করার আছে, তাহলে মানুষ কোথায় যাবে?’
পরপর তিন সপ্তাহে তিনটি বিভাগীয় নগরে একই কায়দায় গণপরিবহন বন্ধ হয়েছে, আগামী সপ্তাহে আরেক নগর বন্ধ হতে যাচ্ছে।
পরিত্রাণে সরকার কী করছে- প্রশ্নে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নূরী সমকালকে বলেন, বিভাগীয় কমিশনার, ডিসি, এসপিরা এ বিষয়ে বলতে পারবেন। যান চলাচল স্বাভাবিক রাখতে মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে কিনা- প্রশ্নে সচিব বলেন, এগুলো স্থানীয় প্রশাসনের কাজ। তাদের জিজ্ঞাসা করুন।
বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার মো. আমিনুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ২৬ অক্টোবর আইনশৃঙ্খলা সমন্বয় সভায় পরিবহনের নেতারা ছিলেন। হাইকোর্টের নির্দেশনা মেনে মহাসড়কে তিন চাকার যানবাহন বন্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পুলিশকে বলা হয়েছে। তিনি জানান, পরিবহনের নেতাদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলাপ চলছে। যদিও পরিবহন নেতারা বলছেন, প্রশাসন তাঁদের ডাকেনি। জনদুর্ভোগ এড়াতে ধর্মঘট প্রত্যাহার করাতে উদ্যোগ আছে কিনা কিংবা ৩ নভেম্বরের আগে পরিবহন নেতাদের নিয়ে বৈঠক হবে কিনা- এ বিষয়ে বিভাগীয় কমিশনার বলেন, ‘এখন পর্যন্ত কথা চালিয়ে যাচ্ছি। লাগলে বৈঠক ডাকব।’
খুলনায় বিএনপির সমাবেশের দিন সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিয়োগ পরীক্ষা ছিল। গণপরিবহন বন্ধ হয়ে সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় খুলনা ও বাগেরহাট শহরের কেন্দ্রগুলোতে ২২ হাজার পরীক্ষার্থীর মধ্যে ১৪ হাজারের বেশি পরীক্ষায় বসতে পারেননি। আগের শনিবার ময়মনসিংহে বিএনপির গণসমাবেশের দিনে এসএসসি পরীক্ষার্থীরা দুর্ভোগে পড়ে। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, গত শনিবার সারাদেশ থেকে রংপুর শহর বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। বিএনপির সমাবেশে দলটির নেতাকর্মীরা এলেও অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহান লাখো মানুষ।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী গত সপ্তাহেই দাবি করেন, বেসরকারি বাস ধর্মঘটে বন্ধ হলেও রাষ্ট্রায়ত্ত পরিবহন সংস্থার বিআরটিসির বাস ঠিকই চলছে। বিআরটিসির বাস বন্ধ হলে ব্যবস্থা নিতেন। তবে রংপুরে বিএনপির সমাবেশের সময় কয়েকটি রুটে বিআরটিসির বাসও চলেনি।
সংস্থাটির চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম দাবি করেন, বিআরটিসি বাস বন্ধের খবর ঠিক নয়। যেসব রুটে বাস বন্ধ ছিল, সেগুলোর তথ্য জানানোর পর তিনি সমকালকে বলেন, ‘ডিপো ম্যানেজাররা আমাকে কিছু জানাননি। বিআরটিসির বাস বন্ধ থাকার কারণ নেই। বরিশালেও চলবে।’ বরিশাল ডিপোর এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এখনও নির্দেশনা আসেনি। হয়তো চলবে না।’
রুট পারমিটের শর্তানুযায়ী চাইলেই বাস বন্ধ রাখতে পারেন না মালিকরা। শ্রম আইন অনুযায়ী, শ্রমিকরা ধর্মঘট করতে পারবেন ১৫ দিনের আলটিমেটাম দিয়ে। পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) মুখপাত্র মাহবুব-ই রাব্বানী সমকালকে বলেন, ‘সড়ক পরিবহন আইন বা ১৯৮৪ সালের মোটরযান বিধিমালায় এ বিষয়ে কিছু বলা নেই। তবে যাত্রীদের জিম্মি করা যাবে না। রুট পারমিটের শর্তে আছে কিনা বলতে পারছি না।’ বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদারের বক্তব্য জানাতে পারেনি সমকাল। তবে গত সপ্তাহে তিনি বলেছিলেন, ধর্মঘটগুলোর বিষয়ে তাঁর জানা নেই।
বরিশাল মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব মীর জাহিদুল কবিরের অভিযোগ, কর্মসূচি পণ্ড করতে সরকারি নির্দেশে পাতানো ধর্মঘট হচ্ছে। রাজনীতি ও পরিবহন খাত-সংশ্নিষ্টরা বলছেন, পরপর তিনটি নগরে একই কায়দায় গণপরিবহন বন্ধ হওয়া নিশ্চিত করে কারও নির্দেশে এগুলো হচ্ছে। এতে বিএনপিরই লাভ। গণসমাবেশ বেশি প্রচার পাচ্ছে। জনসমাগম কমবেশি যা-ই হোক, ভুগছে সাধারণ মানুষ।
সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি মসিউর রহমান রাঙ্গার ভাষ্য, পাতানো ধর্মঘট নয়, বিএনপির কর্মসূচিতে গাড়ি ভাঙচুরের ভয়েই মালিকরা বাস চালাচ্ছেন না। তবে সাম্প্রতিক সময়ে আগুন ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেনি- এ তথ্য জানানোর পর তিনি বলেন, ‘সমিতির মহাসচিবের সঙ্গে কথা বলুন। তিনি ভালো বলতে পারবেন এ বিষয়ে।