চলমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় কৃচ্ছ্রসাধনের উদ্যোগ কাজে আসছে না। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ক্যাটাগরি (শ্রেণি) ভাগ করে দেওয়া হলেও এর প্রভাব নেই বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি)। বরং উলটো চিত্র বিরাজ করছে। চলতি অর্থবছরের ৩ মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) এডিপি’র বাস্তবায়ন বেড়েছে। এ সময় মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো খরচ করেছে ২৪ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা। বাস্তবায়ন হার দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৪৩ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময় খরচ হয়েছিল ১৯ হাজার ৫৫৯ কোটি টাকা, বাস্তবায়ন হার ছিল ৮ দশমিক ২৬ শতাংশ। অথচ অর্থবছরের শুরুতেই প্রকল্পের ব্যয়ে লাগাম টেনেছিল সরকার। ভাগ করে দেওয়া হয় এ, বি ও সি ক্যাটাগরিতে (শ্রেণি)। আগের অবস্থা সব ঠিক থাকলেও কৃচ্ছ সাধনের এই সময়ে এত বেশি ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেছেন, এক্ষেত্রে কৃচ্ছ সাধনের উদ্দেশ্য পূরণ হয়নি। এদিকে প্রকল্পের গ্রেড উন্নয়নে তোড়জোড় শুরু করেছে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা এবং অর্থছাড়সহ অন্য সময়ের সবকিছু একই থাকলেও এবার কেন এত বেশি ব্যয় হয়েছে-সেটি বড় প্রশ্ন। যদি এমন হতো যে আগের সমস্যাগুলোর সমাধান হয়েছে ফলে অর্থবছরের শুরুতেই খরচ হচ্ছে। তেমনটি তো হয়নি। এর বাইরে সরকার নিজে থেকেই কৃচ্ছ সাধনের জন্য কিছু প্রকল্প স্থগিত, কিছুর ২৫ শতাংশ অংশ বন্ধ করে দিয়েছে। এরপরও খরচ বাড়ছে কেন। তবে খতিয়ে দেখতে হবে কোন ধরনের প্রকল্পে বেশি খরচ হচ্ছে। যদি দেশীয় অর্থায়নে বাস্তবায়িত কিন্তু বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি করতে হচ্ছে তেমন প্রকল্পে বেশি ব্যয় হচ্ছে তাহলে বিষয়টি চিন্তার। আবার জনতুষ্টির প্রকল্পে ব্যয় বাড়িয়ে দিলে সেটি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাধা হবে। সরকারের উদ্দেশ্য পূরণ হবে না। এখানে কি ধরনের ফাঁক আছে সেটি গভীরভাবে দেখতে হবে।
সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকার এডিপি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। জুলাইয়ে প্রায় ৬৩৬ উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দে কাটছাঁট করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে চলমান প্রকল্পগুলোকে এ, বি ও সি শ্রেণিতে ভাগ করে দেওয়া হয়। এর মধ্যে গুরুত্ব বিবেচনায় ৬৪৬টি প্রকল্প রাখা হয়েছে ‘এ’ শ্রেণিতে। এগুলোর বরাদ্দে হাত দেওয়া হয়নি। কিন্তু ‘বি’ শ্রেণিতে পড়েছে এমন ৬৩৬টি প্রকল্পের সরকারি অংশের ২৫ শতাংশ অর্থ স্থগিত করা হয়। বাকি ৭৫ শতাংশ ব্যয়েও ছিল নানা নির্দেশনা। তবে ‘সি’ শ্রেণিতে থাকা প্রায় ৯০টি প্রকল্পের অর্থ স্থগিত করে দেওয়া হয়। এর ফলে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হতে পারে বলে আশা করা হয়েছিল। কিন্তু এডিপি’র ব্যয় বেড়ে চলায় এতে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা সচিব মামুন-আল-রশীদ যুগান্তরকে বলেন, এটা ভালো লক্ষণ। কেননা অর্থবছরের শুরুতেই ব্যয় বাড়ছে। কৃচ্ছ সাধন করা হলেও যেসব প্রকল্পে টাকা দেওয়া হচ্ছে তারা সেই টাকার সর্বোচ্চ ব্যবহার করছে। প্রতিযাগিতামূলক পরিস্থিতিতে সবাই নড়েচড়ে বসেছে। এছাড়া একেক প্রকল্পের একেক ধরন। তাই যেগুলোতে বরাদ্দ কমানো বা স্থগিত করা হয়েছিল সেগুলোর মধ্যে এখন আবার কিছু প্রকল্প স্বাভাবিক করা হচ্ছে। কেননা তখন তাড়াহুড়ো করে ক্যাটাগরি ভাগ করা হয়েছিল। এখন গুরুত্ব বুঝে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো গ্রেড উন্নত করে নিচ্ছে। এটা দোষের কিছু নয়।
বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত ৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে চলতি অর্থবছর। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যয় হয়েছিল ১৭ হাজার ৩০১ কোটি টাকা। এডিপি বাস্তবায়ন হার ছিল ৮ দশমিক ০৬ শতাংশ। এছাড়া ২০১৯-২০ অর্থবছরে খরচ হয় ১৭ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা, বাস্তবায়ন হার ৮ দশমিক ০৬ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ৪ মাসে খরচ হয়েছিল ১৪ হাজার ৯২৭ কোটি টাকা, সে সময় এডিপি বাস্তবায়ন হার ছিল ৮ দশমিক ২৫ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরের ৩ মাসে এডিপি বাস্তবায়নে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা মন্ত্রণালয় ও বিভাগ হলো-স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ ৬১ দশমিক ২৩ শতাংশ, আইএমইডি ২৮ শতাংশ, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ২৩ শতাংশ, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ২০ শতাংশ এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ ২১ শতাংশ। ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণায় ২১ দশমিক ১৩ শতাংশ, বিদ্যুৎ বিভাগ ১৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ এবং জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ ১৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়ন করেছে। অন্যদিকে গত ৩ মাসে এডিপি বাস্তবায়নে পিছিয়ে থাকা মন্ত্রণালয় ও বিভাগ হচ্ছে-বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন শূন্য দশমিক ২৭ শতাংশ, দুর্নীতি দমন কমিশন শূন্য ১৭ শতাংশ এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ১ টাকাও খরচ নেই। এছাড়া অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের শূন্য দশমিক ১৫ শতাংশ এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের শূন্য দশমিক ১০ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে।
জানতে চাইলে আইএমইডি’র সচিব আবু হেনা মোর্শেদ জামান বলেন, এখানে প্রশ্ন ওঠার কোনো কারণ নেই। কেননা এই ব্যয় বৃদ্ধি ইতিবাচকভাবে দেখতে হবে। যেসব প্রকল্প ‘এ’ ক্যাটাগরির সেগুলোতে সবাই বেশি নজর দিচ্ছে। সেই সঙ্গে যেসব প্রকল্প ৭৫ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ পাচ্ছে সেটির ওপরই সার্বিক এডিপি বাস্তবায়ন হিসাব করা হয়েছে। যেসব প্রকল্প স্থগিত সেগুলোও হিসাবে নিয়ে আসা হয়নি। তাই সরকারের উদ্দেশ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিছু হচ্ছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো তাদের ‘বি’ ও ‘সি’ শ্রেণির প্রকল্পগুলোর গ্রেড বা শ্রেণি উন্নয়নে তোড়জোড় শুরু করেছে। সেই সঙ্গে চলছে বরাদ্দ পুনর্বিন্যাস। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ থেকে ২৭টি প্রকল্পের নতুনভাবে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর পাঠানো এক চিঠিতে বলা হয়েছে অর্থ বিভাগের নির্ধারিত সিলিং অতিক্রম না করার শর্তে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে এসব প্রকল্পের বরাদ্দ পুনর্বিন্যাসের অনুরোধ করা হলো। এছাড়া জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে ‘সি’ শ্রেণির ৮টি প্রকল্প চলমান রাখতে প্রস্তাব দেওয়া হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। এসব প্রকল্প সচল রাখতে অতিরিক্ত ২৮১ কোটি ২৭ লাখ টাকা বরাদ্দও চাওয়া হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রস্তাবের পক্ষে মত দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। আরও জানা যায়, ১১ আগস্ট জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে নতুন অনুমোদিত ৮টি প্রকল্পের জন্য ৫১ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ চাওয়া হয় পরিকল্পনা কমিশনের কাছে।