আগামী মাসে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের বা আকুর দায় পরিশোধ করতে হবে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার। ইতোমধ্যে রিজার্ভ কমে ৩৫ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে এসেছে। যদিও সফররত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের প্রতিনিধিদলের হিসাবে সাড়ে ৮ বিলিয়ন ডলার কম। আমদানি কমলেও বকেয়া আমদানির দায় বেড়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে যখন দুশ্চিন্তা কাটছে না, এর সাথে নতুন করে যুক্ত হলো রেমিট্যান্স। চলতি অক্টোবরের ২৭ দিনে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে মাত্র ১৩৬ কোটি ডলার। শুক্র শনিবার ছুটি ছিল। আর কর্মদিবস আছে মাত্র একটি। সবমিলে মাস শেষে রেমিট্যান্স প্রবাহ না বেড়ে বরং কমে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত আগস্টে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল প্রায় ২০৪ কোটি ডলার। সেপ্টেম্বরে তা হঠাৎ প্রায় ৫০ কোটি ডলার কমে ১৫৪ কোটি ডলারে নেমে আসে। চলতি মাসে ইতোমধ্যে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছে তাতে মাস শেষে গত মাসের সমান রেমিট্যান্স আসবে না। অথচ, রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ার বড়ই প্রয়োজন ছিল মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
রেমিট্যান্স প্রবাহ হঠাৎ কেন কমে যাচ্ছে, এমন প্রশ্ন করা হয়েছিল কয়েকটি ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপকের কাছে। তারা জানিয়েছেন, রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো মূল্য বেঁধে দেয়া। কারণ, আগে প্রতি ডলারের বিপরীতে ১১৫ টাকা পেতেন প্রবাসীরা। কিন্তু রেমিট্যান্সের এ মূল্য হঠাৎ কমিয়ে প্রাথমে ১০৮ টাকা, পরে ১০৭ টাকা ৫০ পয়সা এবং সর্বশেষ আরো ৫০ পয়সা কমিয়ে ১০৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়। বলা হয়েছিল, ডলারের উচ্চ মূল্য ঠেকাতে রেমিট্যান্সের মূল্য বেঁধে দেয়া হয়। এতে দুই এক মাস পর আবারো রেমিট্যান্স প্রবাহ স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কিন্তু গত দুই মাস পার হতে চললেও রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়েনি, বরং কমে যাচ্ছে।
রেমিট্যান্স কমে যাওয়ায় বেকায়দায় পড়ে যাচ্ছে বেশির ভাগ ব্যাংক। কারণ, যারা বেশি মূল্য দিয়ে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করে আমদানি দায় মেটাতেন তারা আর পারছেন না। এমনি একটি ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপক জানান, আন্তঃব্যাংকে রেমিট্যান্স পাওয়া যাচ্ছে না দীর্ঘ দিন ধরে। বেশি দরে রেমিট্যান্স আহরণ করে কোনোভাবে বৈদেশিক বাণিজ্যে লেনদেন করে আসছিলেন। কিন্তু মূল্য বেঁধে দেয়ায় এখন আর বেশি দরে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করতে পারছেন না। এতে ব্যাংকের গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলতে পারছে না। অনেকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী শতভাগ মার্জিন নিয়ে আসছেন। অর্থাৎ পণ্য আমদানির সমপরিমাণ স্থানীয় মুদ্রা নিয়ে আসছেন। কিন্তু ব্যাংক ডলার সংস্থান করতে না পারায় গ্রাহকের পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলতে পারছে না। এতে তার ব্যাংক থেকে ভালো ভালো গ্রাহক চলে যাচ্ছেন। এর প্রভাবে ব্যাংকের বৈদেশিক বাণিজ্য থেকে আয় অস্বাভাবিক হারে কমে যাচ্ছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়বে ব্যাংকের আয়ে।
এ দিকে রেমিট্যান্স কমে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে নীতিনির্ধারকদের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ছে। কারণ নভেম্বরে আকুর দায় পরিশোধ করতে হবে। অপর দিকে সরকারের অতিপ্রয়োজনীয় কেনাকাটায় সরকারি ব্যাংকগুলোকে রিজার্ভ থেকে ডলার সরবরাহ করছে। পণ্য আমদানির জন্য এলসি খোলার হার কমলেও বকেয়া এলসির ব্যয় মেটাতে হচ্ছে বেশি হারে। আবার সফররত আইএমএফের প্রতিনিধিরা প্রায় সাড়ে ৮ বিলিয়ন ডলার কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন। সবমিলেই বৈদেশিক মুদ্রার মজুদে চাপ আরো বেড়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন নীতিনির্ধারক জানিয়েছেন, ডলারের সঙ্কট এখনো আছে। অনেকেই ডলারের সঙ্কটের কারণে আমদানি দায় নিষ্পত্তি করতে পারছে না। মুদ্রার এ বিনিময় হার যে কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা বলা যাচ্ছে না। এজন্য মুদ্রানীতিতে বিশেষ করে সুদহারের বিষয়ে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, প্রবাসী ও রফতানিকারকরা উভয়ই ডলার আহরণ করছে, কিন্তু মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে পার্থক্য রাখা হয়েছে ৯ টাকা, এটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। তিনি মনে করেন, এ কারণেই ডলারের অভিন্œ দর কার্যকর হচ্ছে না। তিনি মনে করেন, ধীরে ধীরে রফতানিকারকদের ডলারের মূল্য বাড়ানো দরকার। এ ক্ষেত্রে সুদহার দিয়ে টাকাকে সাপোর্ট দেয়া দরকার। অন্যথায় সরবরাহ পরিস্থিতি সহসাই উন্নতি হবে না বলে তিনি মনে করেন।
বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, প্রতিবেশী দেশগুলোতে মার্কিন ডলারের বিপরীতে তাদের স্থানীয় মুদ্রার বিনিময়মূল্য ব্যাপক হারে কমে গেছে। এমনি পরিস্থিতিতে রেমিট্যান্সের ডলারের মূল্য কমানোর ফলে প্রবাসীদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা হুন্ডি হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যাবে। এর ফলে কাক্সিক্ষত হারে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্সপ্রবাহ কমে যাবে। ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে তারই প্রমাণ পাওয়া গেছে।