ডেঙ্গু রোগীর জন্য গত মে মাসে রাজধানীর হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে রক্তের প্লাটিলেট বা অণুচক্রিকার প্রয়োজন হয়েছিল ১২ ব্যাগ। জুনে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২০ ব্যাগ। এরপর এ চাহিদা দ্রুত বাড়তে থাকে। জুলাইয়ে প্রয়োজন হয়েছে প্রায় ১০০ ব্যাগ, আগস্টে ১৫০ ব্যাগের মতো আর সেপ্টেম্বরে এ চাহিদা পৌঁছায় ৩০০ ব্যাগে।
বিজ্ঞাপন
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিশ্লেষণ, একটি হাসপাতালে রক্তের এ চাহিদা বৃদ্ধির তথ্যকে দেশে ডেঙ্গুর ব্যাপক বিস্তারের প্রকৃত চিত্র হিসেবে ধরে নেওয়া ঠিক হবে না। হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর জন্য শয্যাসংখ্যা বাড়ানোয় রোগী ভর্তি বেড়েছে। সে কারণে রক্তের চাহিদাও বেড়েছে। তার পরও এটি উদ্বেগজনক।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির রক্তকেন্দ্রের মেডিক্যাল অফিসার ডা. জাহিদুর রহমান গতকাল বুধবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের এ কেন্দ্রে ডেঙ্গু রোগীর জন্য রক্তের প্লাটিলেটের চাহিদা গত মাসের তুলনায় প্রায় চার গুণ বেড়েছে। গত তিন দিনে সরবরাহ করা হয়েছে প্রায় ২০০ ব্যাগ প্লাটিলেট। যাঁরা এ চাহিদা নিয়ে আসছেন তাঁদের বেশির ভাগ রক্তদাতা সঙ্গে নিয়ে আসছেন। সাধারণত চারজন রক্তদাতার রক্ত থেকে এক ইউনিট বা এক ব্যাগ প্লাটিলেট সংগ্রহ করা হয়। এতে ব্যয় বাড়ানো হয়নি। আগের মতোই চার হাজার ৪০০ টাকা।
গতকাল রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির এ রক্তকেন্দ্রে আরো কয়েকজনের সঙ্গে রক্তের প্লাটিলেট সংগ্রহ করতে এসেছিলেন পল্লবীর ব্যবসায়ী তানসেন জুলফিকার। তিনি জানান, তাঁর একমাত্র ছেলে পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থী ১০ বছরের তাহসিন জুলফিকার ঢাকা শিশু হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন। পরিস্থিতি খুবই জটিল হয়ে পড়েছিল। প্লাটিলেট নেওয়ার অবস্থায়ও ছিল না সে। এখন কিছুটা উন্নতির দিকে। চিকিৎসকের পরামর্শে পরিচিত চারজন ডোনারের মাধ্যমে প্লাটিলেট সংগ্রহ করতে এসেছেন তিনি। তাঁর বাসার মালিক এবং ওই বাসার একজন ভাড়াটেও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত।
ঢাকা শিশু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, তাহসিন জুলফিকারের মতো আরো দুই শিশু সেখানে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন।
হাসপাতালটির পরিচালক অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘শিশুদের জটিলতার মধ্যে বেশির ভাগ শিশুর শক সিনড্রোম হচ্ছে। ফুসফুসে প্রচুর পরিমাণে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। কোনোভাবে পেসার ওঠানো যাচ্ছে না। বিশেষ করে মোটা বাচ্চাদের সমস্যা বেশি হচ্ছে। রোগীর প্রেসার কমে গেলে, খুব বেশি রক্তক্ষরণ হলে এবং রক্তের প্লাটিলেট ১০ হাজারের নিচে নেমে গেলে রোগীকে প্লাটিলেট দিতে হচ্ছে। ’ তিনি জানান, গত এক দিনে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১৩ জন রোগী। আর বর্তমানে ভর্তি আছে ৭৫ জন। এর মধ্যে তিন শিশু আইসিইউতে আছে। চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত ৭৯৬ জনকে এই হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির রক্তকেন্দ্রের পাশাপাশি ডেঙ্গু রোগীদের জন্য রক্তের এ চাহিদা পূরণ করছে পুলিশ ব্লাড ব্যাংক, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনসহ আরো কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।
কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের রক্তদান কর্মসূচির সংগঠক শামীমা নাসরিন মুন্নি গতকাল কালের কণ্ঠকে জানান, গত জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত তাঁরা প্রতি মাসে গড়ে দেড় হাজার ব্যাগ প্লাটিলেট সরবরাহ করে আসছিলেন। কিন্তু জুলাই মাসে এ চাহিদা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে গেছে। চলতি অক্টোবর মাসে এই চাহিদা চার হাজার ব্যাগ ছেড়ে যেতে পারে।
সিত্রাং কমিয়েছে মশা
কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, সিত্রাংকে কেন্দ্র করে দুই দিন প্রবল বৃষ্টি হয়েছে। যখন ঝড়-বৃষ্টি হয় তখন বাসার বাইরে উড়ন্ত মশার ৮০ শতাংশ মারা যায়। আবার লার্ভার যে প্রজননস্থল সেগুলো বৃষ্টির কারণে ডুবে যায়। ফলে অনেক লার্ভা মরে যায়। সে জন্য দেখবেন এখন মশা কম।
তবে এতে ডেঙ্গু কমে যাবে এমনটা ভাবা ঠিক নয়। কারণ ডেঙ্গু হয় মশায় কামড়ানোর চার থেকে সাত দিন পর। ফলে ঝড়ের কারণে এডিস মশা কমলেও ডেঙ্গু কমতে লাগবে আরো সাত দিন।
রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ডা. জাহিদুর রহমান বলেন, ‘আমার ধারণা, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের কারণে সারা দেশে ঝোড়ো বাতাসের সঙ্গে প্রচুর বৃষ্টিপাত হওয়ায় ডেঙ্গুর বাহক এডিসসহ অন্য মশা অনেকটাই কমে এসেছে। এর ফলে আগামী সপ্তাহে হয়তো ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কমে আসবে। ’
আরো ৯২৩ রোগী হাসপাতালে ভর্তি
গতকাল বুধবার সকাল ৮টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় নতুন আরো ৯২৩ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এই একই সময়ে মারা গেছে দুজন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, নতুন ভর্তি হওয়া রোগীদের ৫২০ জন ঢাকার বাসিন্দা। ঢাকার বাইরে অন্য বিভাগের ৪০৩ জন। এ নিয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৩৮০। এর মধ্যে ঢাকার ৫৪টি হাসপাতালে ভর্তি আছে দুই হাজার ২০৭ জন। ঢাকার বাইরে এক হাজার ১৭৩ জন।